শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

চিরনিদ্রায় ভাষাসৈনিক অলি আহাদ



সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বনানী কবরস্থানে সমাহিত হলেন ভাষাসৈনিক ও ডেমোক্রেটিক লীগ চেয়ারম্যান অলি আহাদ। দু’দফা জানাজা শেষে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে। গতকাল সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে রাজধানী পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি..... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, জাতীয় সংসদের স্পিকার এডভোকেট আবদুল হামিদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সর্বস্তরের জনতার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর একটায় অলি আহাদের লাশ আনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে নামে সর্বস্তরের জনতার ঢল। তার লাশ দেখে অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। তৈরি হয় এক শোকাবহ পরিবেশ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাগপা, ন্যাপ, এনপিপি, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের জনসাধারণ এ মহান ভাষাবীরকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম দফা জানাজা। এতে অংশ নেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু, মহানগর সচিব আবদুস সালাম, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, ড্যাব মহাসচিব এজেডএম জাহিদ হোসেন, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ন্যাপ সভাপতি জেবেল রহমান গানি, এনপিপি সভাপতি শওকত হোসেন নীলু, পিপলস লীগের মহাসচিব এড. মাহবুব হোসেন, ডেমোক্রেটিক লীগ সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাহবুব উল্লাহসহ সর্বস্তরের জনগণ। এরপর তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। সেখানে তার দ্বিতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সন্ধ্যায় এ ভাষাসৈনিকের লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শ্রদ্ধা জানিয়েছেন খালেদা
ভাষাসৈনিক, রাজনীতিক অলি আহাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শমরিতা হাসপাতালে গিয়েছিলেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। চীন সফর শেষে গতকাল দেশে ফিরেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুপুর একটায় সরাসরি তিনি শমরিতা হাসপাতালে যান। সেখানে অলি আহাদের কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এ সময় মরহুমের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন তিনি।
অলি আহাদ জীবন বাজি রেখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন- ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন
সহযোদ্ধা অলি আহাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেন, তিনি জীবন বাজি রেখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন। তার সামনেই সালাম, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সবসময় সত্য কথা বলতেন। কখনও হীনমন্যতায় ভোগেননি। হতাশ হননি। 
রাষ্ট্র তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি- ভাষাসৈনিক রওশন আরা
ভাষাসৈনিক অলি আহাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরেক ভাষাসৈনিক রওশন আরা বলেন, গুলির মুখে তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন। জীবনের ভয় তিনি করেননি। কিন্তু রাষ্ট্র তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি। এ দুঃখ নিয়ে তিনি চলে গেলেন।
ক্ষমতার মোহ কখনও তার মধ্যে ছিল না- আবদুুল্লাহ আল নোমান
এ ভাষাবীরকে সম্মান জানাতে গিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।  তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন অন্যায় ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করার জন্য। ক্ষমতার মোহ কোনদিন তার মধ্যে কাজ করেনি।
মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন- সাদেক হোসেন খোকা
মহান এ ভাষাসৈনিকের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে অলি আহাদ প্রথম সারিতে ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধেও অবদান রেখেছিলেন। তিনি অন্যায়ের কাছে কোনদিন আপস করেননি।
সংগ্রামী জীবন
বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামে জীবনবাজি রেখে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ছিলেন তাদের একজন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে তাকেই প্রথম কারাগারে যেতে হয়। সক্রিয় এই রাজনীতিবিদ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক লীগের  চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সঙ্গে আশির দশকের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’-এর সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার চার সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কমে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে ৪ঠা জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ১৯৫২-এর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদকও তিনি। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তাকে প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে পাকিস্তানি পুলিশ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বহিষ্কার করে। ১৯৫২ সাল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথ ছিল উত্তাল। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্রছাত্রীরা জমায়েত হতে থাকে। সকাল ১১টায় কাজী  গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আবদুল মতিন প্রমুখ। নেতৃত্ব দিতে থাকেন এই সমাবেশের। ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। স্লোগানে  স্লোগানে কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন ও আব্দুল জব্বার মারা যান। ভাষাসৈনিক অলি আহাদের জন্ম ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ইসলামপুরে। তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তার তিন বোন ও পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিন বোন ও এক ভাই মারা গেছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads