সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

প্রধানমন্ত্রীর রাগ



শাহীন রেজা
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাগ করেছেন। আর তাই তার সংবাদ সংগ্রহের জন্য বেসরকারি টিভি এবং পত্রিকাগুলো আমন্ত্রণ কিংবা অনুমতি কোনোটাই পাচ্ছে না। ঘটনাটি চলছে কয়েকদিন ধরে। প্রধানমন্ত্রীর বিরাগ নিয়ে পত্রিকাগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ পরিবেশিত হলেও এর মূল সূত্র কিন্তু একটাই—তা হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে তিনি তার প্রাপ্য ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন না। আর সেই সঙ্গে গভীর রাতে টিভি চ্যানেলগুলোয় টক শো’র নামে তার সরকারের মুণ্ডুপাত করা হচ্ছে।
টক শো নিয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ এবং রাগ অনেক দিনের। একবার তিনি টক শো’কে সরাসরি ‘টক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। অতিসমপ্রতি তিনি এই শোতে অংশগ্রহণকারীদের সিঁদেল চোরের সঙ্গেও তুলনা করতে পিছপা হননি। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে বাজার এখন বেশ উত্তপ্ত। কেউ কেউ বলছেন, মুজিব-ভক্ত আওয়ামী লীগার প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা এক টক শোতে সরকারি দলের দিকে অঙুলি নির্দেশ করে ‘তুই চোর’ শব্দটি ব্যবহার করার পর বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। আর এ উক্তিটি করে এবিএম মূসা সরকারি দল এমনকি প্রধানমন্ত্রীরও গাত্রদাহ সৃষ্টি করেন, যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এই বিশেষ শব্দটিকে নিজের কোর্ট থেকে কিক্ মেরে টক শো’র কোর্টে চালান করে দিয়েছেন। দুষ্ট লোকেরা বলছেন, এটি করতে পেরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অন্তত কয়েকটি রাত স্বস্তিতে ঘুমিয়েছেন। ছেলেবেলায় একটি প্রবাদ শুনেছিলাম, ‘দুষ্ট বলদের চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মিডিয়াবিমুখ আচরণে সেই প্রবাদটির কথা আবার মনে পড়িয়ে দিল। পত্রিকার কথা যদি ধরি তাহলে হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া অন্যসব পত্রিকাই কোনো না কোনোভাবে শাসক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে প্রায় সব চ্যানেলই তো সরকারি দলের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে। প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও প্রায় ডজনখানেক নতুন চ্যানেলের অনুমোদন দিয়ে রাতারাতি ‘টিভি-বান্ধব’ বনে যাওয়ার পরও নিউজ ট্রিটমেন্ট নিয়ে তার এ গোস্বায় (!) মিডিয়া পাড়ার লোকজন তো বটেই, সারা দেশের মানুষও আজ হতবাক। বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী এমন আচরণ (!) করতে পারেন—এটা বিশ্বাস করতেও তাদের কষ্ট হচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকার পরও যেসব ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন তারা কি এরই মধ্যে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যদি তাই হয়, তাহলে এটা কিসের আলামত? ভাটার টান যখন আসে তখন শুধু নদী নয়, নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত সব শাখা নদী, উপনদী, খাল এমনকি জলাশয়ও জলশূন্য হতে শুরু করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল কি এ থেকে কোনো সিগন্যাল লাভ করেছেন। আর করেছেন বলেই কি তার এই গোস্বা (!)?
ফিরে আসি টক শো প্রসঙ্গে। ‘আঙ্গুর ফল টক’-এর সঙ্গে যদিও এই টকের কোনো মিল নেই—তবুও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন একে ‘টক’ বলে উল্লেখ করেছেন তখন দুটো কথা বলতেই হয়—এই টক শোতে যারা আসেন তারা সবাই যে সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা করেন, তা কিন্তু নয়। সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক সুভাষ সিংহ রায় এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আরাফাতসহ অনেকেই নিজেদের সরকারের একজন মনে করে জোরগলায় মিথ্যাকে সত্য বানানোর চেষ্টায় যারপরনাই ব্যস্ত থাকেন। এছাড়াও সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীসহ বেশকিছু সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী, আমলা এবং সাংবাদিককে এসব অনুষ্ঠানে গলাবাজি করতে দেখা যায়। টক শো টক হলে এ সব অংশগ্রহণকারীর বক্তব্যও তো টক হতে বাধ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তাদের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলবেন? একটি বেসরকারি টিভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা— যিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের একজন বড়মাপের নেতাও, সেদিন তাকে দেখা গেল—অদ্ভুত এক যুক্তি উপস্থাপন করতে। তিনি জানালেন, সিঁদ কাটার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়ে বলেননি। এটি তার একটি হাস্যরসাত্মক উক্তি। তিনি হাস্যরসের সঙ্গে বক্তব্যটি খুবই হালকাভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। জনতার কাঠগড়া থেকে উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে রসিক সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়টিকে কে কীভাবে নিয়েছে আমি জানি না, তবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উল্লিখিত ওই ‘টক’ শোতে বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ায় দর্শকরা যে কিছুটা হলেও মজা পেয়েছেন, তা বলাইবাহুল্য। প্রিয় পাঠক, এ লেখার উদ্দেশ্য টক কিংবা মিষ্টি অথবা ঝাল তৈরি করা নয়। একজন প্রধানমন্ত্রী, যিনি একটি দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি রসিকতা করে কিছু বললেও তা যে আর রসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এ উপলব্ধিটি প্রধানমন্ত্রীর জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন তার সতীর্থ এবং মোসাহেবদের জন্যও। প্রধানমন্ত্রীকে রসিক বানানোর মধ্যে যে কোনো কৃতিত্ব নেই, তা বোঝার ক্ষমতা কি তাদের মধ্যে তৈরি হবে কোনো দিন?
টক শো’কে জনগণ মনে করে দ্বিতীয় পার্লামেন্ট— আর এ কারণেই তারা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বিভিন্ন চ্যানেলের টক শো দেখে থাকেন। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও কর্মক্লান্ত দেহ নিয়ে মধ্যরাতে এগুলো দেখার জন্য রিমোট হাতে তুলে নেন। আমাদের দেশের মহিলাদের কাছে টক বড়ই আদরণীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহিলা বলেই কি এই ‘টক’-এর প্রতি তার এমন বিশেষ আকর্ষণ? ‘টক’-এর সঙ্গে লবণ আর ঝাল মিশালে তা যে অতি উপাদেয়—তা কি আর বলতে? প্রধানমন্ত্রীর মোসাহেবরা তাদের নেত্রীর স্বপক্ষে উপরোক্ত যুক্তিটা তুলে ধরতে পারেন বেশ জোরেশোরে। তাতে ভাগ্যে শিকে লাভ হলেও হতে পারে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ কবিতা সংসদ
e-mail : shaheenrezapoet@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads