শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১২

হেনরীর অলৌকিক উত্থান



 হেনরী এখন দেশময় ব্যাপক আলোচিত এক নাম। হলমার্ক কেলেঙ্কারি তাকে আলোচনার শীর্ষে তুলে দিয়েছে। যমুনা পাড়ের জেলা সিরাজগঞ্জের  মেয়ে, সেখানকারই বউ। স্কুল শিক্ষকের কন্যা। এক প্রয়াত সজ্জন রাজনীতিকের পুত্রবধূ। পুরো নাম জান্নাত আরা হেনরী। সংগীত শিল্পী। ছিলেন সাদামাটা জীবনের এক স্কুল শিক্ষিকা। পুরো পাল্টে গেছেন সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার পর। এখন তার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন হন্যে হয়ে খুঁজছে তার নামে-বেনামে সম্পদের অস্তিত্ব। হেনরী অবশ্য বলেছেন- সব অভিযোগ মিথ্যা, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
হেনরীর জন্ম সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের কড্ডা মোড়ের মিয়াবাড়িতে। পিতা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবু’র সঙ্গে বিয়ের পর হেনরীও স্কুলশিক্ষিকা হিসেবে চাকরি পান ৭০০ টাকা বেতনে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তার জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক সাদামাটা। পায়ে হেঁটে ও রিকশায় চলাফেরা করতেন। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের পর বদলে যান তিনি। মাত্র ৪ বছরেই হয়ে উঠে শত কোটি টাকার মালিক। বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোতাহার হোসেন তালুকদারের পুত্রবধূ এবং কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদিকা হওয়ায় বিগত সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ সদর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। দলীয় কোন্দলের কারণে চারদলীয় জোটের প্রার্থী রুমানা মাহমুদের কাছে হেরে যান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপারিশে সোনালী ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান হেনরী। সেই থেকে তার উত্থান শুরু। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার পর ঋণপ্রদান, ঋণ মওকুফ করা,  চাকরি বাণিজ্য, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও বদলি, বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য করে সাড়ে তিন বছরে হেনরী এখন প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও ক্ষমতার দাপটে স্কুলে শিক্ষকতা না করেই নিয়মিত তোলেন বেতন-ভাতা। হেনরীর আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে যাওয়ার কথা এখন নিজ দলের নেতাকর্মীসহ সিরাজগঞ্জে সবার মুখে মুখে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমেছে:   অনুসন্ধানে জানা যায়, জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী  রাজনীতির পাশাপাশি শহরের সবুজ কানন হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করতেন। নির্বাচনের হলফনামায় সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সদানন্দপুর এলাকায় নিজ নামে সাড়ে ১৭ শতাংশ কৃষিজমি (৩৪ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের), পৌরসভার ভাঙ্গাবাড়ী মৌজায় দশমিক ৩৬ শতাংশ সেমিপাকা বাড়ি (২ লাখ টাকা মূল্যের), ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বার্ষিক আয় ১ লাখ ২২ হাজার টাকা এবং স্বামীর নামে কৃষিজমি ৩ বিঘা (২ লাখ টাকার), অকৃষিজমি সাড়ে ৬ শতক (মূল্য ২ লাখ টাকা) ও নগদ ২ লাখ টাকার হিসাব উল্লেখ করেছেন হেনরী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গজারিয়া নামক স্থানে ৭ বিঘা জমির উপর শ্বশুর-শাশুড়ির নামে সখিনা-মোতাহার ফ্লাওয়ার মিলের কাজ শুরু করেছেন হেনরী। সদানন্দপুর এলাকায় তার পৈতৃক বাড়িতে পিতা আবদুল হামিদের মালিকানায় তার সহযোগিতায় একটি পাঁচতলা বাণিজ্যিক  ভবন ও শহরের চৌরাস্তায় একটি বহুতল বিশিষ্ট মার্কেটের নির্মাণকাজ চলছে। ইতিমধ্যেই মূল অবকাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। তার শ্বশুরবাড়িতে থাকার জন্য সবকিছু অত্যাধুনিক ভাবে সুসজ্জিত করেছেন। সম্প্রতি তার বাসা থেকে ৩১ ভরি স্বর্ণালংকার এবং নগদ ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা চুরি হয়। এ মামলায় পুলিশ ২০ ভরি স্বর্ণালংকার ও ৪৫ হাজার টাকা উদ্ধার করলে তিনি নিজেই মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়াও ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকায় ‘রজনীগন্ধা’ নামের বাড়িতে তার নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার উত্তরায় ৫ কাঠা জমির প্লট, প্রায় ৮৭ লাখ টাকার একটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-১৭৫৫) জিপ, একটি প্রাইভেট কারসহ (নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-২৭-৩৬০০) আরও সম্পদ। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিরাজগঞ্জ রুটে তার দু’টি বাস এবং একটি  কোম্পানিতে প্রায় কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। তার নামে ও বেনামে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে ধারণা দুদকের। স্বামী লাবু’র নামে ঠিকাদারি লাইন্সেস থাকলেও বর্তমানে তিনি কোন কাজ করেন না।
এদিকে, চলতি বছরের প্রথম দিকে হেনরীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। সে প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত  জেলার পাবনা কার্যালয় থেকে জান্নাত আরা হেনরী, তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু ও পালিত মেয়ে মুনতাহা হৃদয়ের ব্যাংক হিসাব ও বর্তমান স্থিতি সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে সিরাজগঞ্জের বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের কাছে পত্র দেয়া হয়। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ওই তিন জনের হিসাবে বড় অংকের টাকার লেনদেনের বিষয়ে দুদক নিশ্চিত হয়। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় সব নথিপত্র তলব করায় গত ৩০শে জুলাই প্রধান কার্যালয় ঢাকায় হস্তান্তর করা হয়। সমপ্রতি দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সম্পদের হিসাব চেয়ে তার কাছে নোটিশ পাঠানো হয়।  ১৮ই অক্টোবর এ বিষয়ে সশরীরে দুদুক কার্যালয়ে হাজির হন হেনরী। সাক্ষাৎ শেষে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমার কোন অবৈধ সম্পদ নেই। আমি রাজনৈতিক যড়যন্ত্রের শিকার। সোনালী ব্যাংকের লুটের (হলমার্ক গ্রুপ) টাকার ভাগ পেয়েই  হেনরী এখন শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলেও অনেকে মনে করছেন। এ বিষয়েও দুদক তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
সমপ্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় তাকে নিয়ে ফলাও করে সংবাদ প্রচারের পর ১৯শে অক্টোবর শহরের এসএস রোডে অবস্থিত শ্বশুরবাড়িতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন হেনরী।
সেখানে লিখিত বক্তব্যে হেনরী বলেন, শত শত টাকার মালিক হয়েছি মর্মে যে সব খবর প্রচার হয়েছে তা মিথ্যা ও কাল্পনিক। শত কোটি টাকা তো দূরের কথা এক কোটি টাকার মালিক হওয়াও আমার জন্য দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। আমার যে সব সম্পত্তি আছে তা বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দাখিলের মাধ্যমে বৈধ সম্পত্তি। আমি সবুজকানন স্কুলে শিক্ষকতা করি। এর পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক, সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের অডিট কমিটির পরিচালক এবং সোনালী ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের একজন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়াও বাংলাদেশ মহিলা কল্যাণ পরিষদ ও সমাজকল্যাণ পরিষদেরও সদস্য এবং বাংলাদেশ বেতারের ‘ক’ শ্রেণীর রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। ‘তোমায় গান শোনাবো’ শিরোনামে প্রতি মাসে আমার দু’টি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এসব উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ঢাকা ব্যাংকের মাধ্যমে কিস্তিতে একটি প্রাইভেট কার কিনেছি। এর অর্ধেক কিস্তি এখনও পরিশোধ হয়নি। রাজউকের উত্তরা প্রকল্পে শিল্পী কোটায় একটি প্লট লিজ নিয়েছি। এছাড়া, ঢাকায় আমার কোন ফ্ল্যাট বা প্লট নেই। শ্বশুরের বাড়ি ব্যতীত কোন বাসা বা বাণিজ্যিক ভবন নেই। ডেসটিনি বা কোন কোম্পানিতে আমার কোন শেয়ার নেই। সংবাদ সম্মেলন হেনরী ল্যান্ডক্রুজার জিপ বা ঢাকা রুটে তার কোন বাস নেই দাবি করেন। এসময়  আপনার ব্যবহৃত ওই ল্যান্ডক্রুজার জিপটি তাহলে কার- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ল্যান্ডক্রুজারটি তার স্বামীর এক আত্মীয়ের। তবে নাম বলতে পারেননি হেনরী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, বাবার বাড়ির ওই বিল্ডিং ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে করা হচ্ছে। সেখানে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। ফ্লাওয়ার মিলের জায়গা আমার শ্বশুরের। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ২ কোটি টাকা লোন নিয়ে সবেমাত্র মিল নির্মাণের প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে। আমি সংগীত পরিবেশন করি বলে সবাই আমাকে সংগীত শিক্ষক মনে করেন। আসলে আমি একজন সাধারণ শিক্ষক। শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতার পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলামিক স্টাডিস বিষয়ে আমার মাস্টার্সও করা আছে। স্কুলে অনুপস্থিতির বিষয়ে বলেন, প্রথম ২ বছর আমি শিক্ষা ছুটিতে ছিলাম। তারপর থেকে বিনা বেতনে ছুটিভোগ করছি। স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয় সে জন্য প্রথম থেকেই ম্যানেজিং কমিটি আমার বিপরীতে একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করেছে। তার পারিশ্রমিক আমি বহন করছি। হলফনামায় যে তথ্য ও সম্পত্তির বিবরণ দেয়া হয়েছে, সেখানে অর্জনকালীন সময়ের মূল্য দেখানো হয়েছে। বর্তমানে ওই সম্পত্তির মূল্য এখন অনেক গুণ বেশি। এদিকে, সিরাজগঞ্জ সবুজকানন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাহনাজ মাহফুজা পারভীন জানান, সংসদ নির্বাচনের পর তিনি দুই বছরের ছুটি নেন। সেই থেকে তার পরিবর্তে তার চাচাতো বোন অলিদা পারভীন জলিকে খণ্ডকালীন নিয়োগ দেয়া হয়। তবে তার নামে প্রতি মাসে বেতন দেয়া হয়েছে। স্কুলে না এসে কিভাবে বেতন পেলেন- এমন প্রশ্ন করলে তিনি আর কোন তথ্য দিতে পারবেন না বলে জানান। তবে তিনি বলেন, হেনরীকে মৌখিকভাবে বেতনের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে। অপরদিকে, সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারণায় আসার পর থেকে হেনরী তার চলাফেরায় পরিবর্তন এনেছেন। বিলাসবহল গাড়ির পরিবর্তে তিনি বর্তমানে বেশির ভাগ সময় রিকশায় সাদামাটা ভাবে চলাফেরা করতে শুরু করেছেন। দলীয় কার্যক্রমে যোগদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সভা-সমাবেশেও তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads