বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১২

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ ও তার বিচার করতে হবে



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
‘আমরা সবাই চোর, এই চোরের রাজত্বে’—এই জয়গানই এখন বর্তমান সরকারের দ্বারা দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে। এই গানে সর্বশেষ কণ্ঠ মেলানেওয়ালা হলেন বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হলেও তার কথাবার্তা ও কাজকর্ম দেখেশুনে মনে হয় তার নীতি হলো, ‘চোর চুরি করছে তাকে করতে দাও’। এই ধরনের দুর্নীতি দমন কমিশন যে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা তো দূরের কথা, কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে, এটা মনে করার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
অকারণে একথা বলা হচ্ছে না। বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ৭ অক্টোবর এমন সব কথা বলেছেন যার থেকে এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। এবছর ৯ এপ্রিল তত্কালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি চালক প্রায় মধ্যরাতে ৭০ লাখ টাকাসহ তিন আরোহী নিয়ে বর্ডার গার্ডের হেড কোয়ার্টারে ঢুকে চোরদের ধরিয়ে দেন। তার কথা হলো, টাকা নিয়ে অফিসাররা সুরঞ্জিতকে দেয়ার জন্য তার জিগাতলার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। এই ঘটনার পরদিন সকালে বর্ডার গার্ড টাকাসহ তিন অফিসার ও ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়। সুরঞ্জিতের এপিএস দাবি করেন, তারা সুরঞ্জিতকে টাকা দেয়ার জন্য যাচ্ছিলেন না এবং টাকা তার নিজের! ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ৭০ লাখ টাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টে জমা দেন! আদালত থেকে নিয়ে দুদক এবং সরকারের কোনো মহল থেকেই কার্যকরভাবে এ প্রশ্ন তোলা হয়নি, কীভাবে একজন এপিএসের কাছে ৭০ লাখ টাকা নগদ থাকতে পারে, কোথা থেকে এ টাকা এলো এবং মধ্যরাতে সে টাকা গাড়িতে বোঝাই করে কেন তারা সুরঞ্জিতের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। তাছাড়া টাকাটি যে এপিএসের, তার কি ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণ তার কাছে ছিল, যাতে বিনা প্রশ্নে তিনি সেই টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকলেন অর্থাত্ হজম করলেন? ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণের কথা এখানে বিশেষভাবে বলা হচ্ছে এ কারণে যে, ড্রাইভার আজম খানের কয়েক দিন আগে আরটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাত্কার প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, গাড়ির আরোহী রেলের অফিসাররা যে সুরঞ্জিতকে টাকাটা দেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তার কোনো ডকুমেন্টারি ড্রাইভার আজমের কাছে নেই। ডকুমেন্টারি ছাড়া নাকি অন্য কোনো ভিত্তিতে কারও বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না! এটা তো বোঝা গেল, কিন্তু ড্রাইভার বর্ডার গার্ডের অফিসে গাড়ি ঢুকিয়ে চুরির যে ব্যাপারটি জনসমক্ষে হাজির করলেন, তার ভিত্তিতেই তো রেলের তিন বড় কর্তা নিজেদের চাকরি থেকে অব্যাহতি পেলেন এবং মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও পদত্যাগ করতে হলো। কোন ডকুমেন্টারি প্রমাণের ভিত্তিতে এত কাণ্ড সরকারকে করতে হলো, এটা তো দুদকের চেয়ারম্যানকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা যায়। তিনি এর কি জবাব দেবেন?
বাংলাদেশে চোরদের থেকে বড় গলা আর কারও নেই। সেটা যদি না হতো তাহলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষখোরি ধরা পড়ার পর তার পক্ষে বুক ফুলিয়ে জনসভায় পর্যন্ত গলাবাজি করে নিজেকে সত্ ও সাধু প্রমাণ করার চেষ্টা তিনি করতেন না। ড্রাইভার আজম টিভি সাক্ষাত্কারে বলেছেন যে, গাড়ির মধ্যে তিনি নিজের কানে শুনেছেন একথা অফিসারদের বলতে যে, টাকা সুরঞ্জিতের কাছে যাচ্ছিল এবং তাকে রেলের কর্মচারী নিয়োগ বাবত ১০ কোটি টাকা ঘুষ দেয়া হবে। ৯ এপ্রিল প্রথম ধরা পড়ার পর এবং ক’দিন আগে ড্রাইভারের সাক্ষাত্কার প্রচারের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শুধু লজ্জিত হওয়াই উচিত ছিল তাই নয়। বলা দরকার ছিল, ‘ধরনী দ্বিধা হও’। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি নিজেকে নির্দোষ ঘোষণা করে উল্টো ড্রাইভারকেই কারও প্রমোট হিসেবে উল্লেখ করেছেন! এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ঘটনার ৬ মাস পর সে হঠাত্ করে কোথা থেকে ও কেন আবির্ভূত হলো? হবে না কেন? বর্ডার গার্ড তাকে ছেড়ে দেয়ার পর তাকে গুম করে সরকার কর্তৃক খুন করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল এবং এখনও আছে। কাজেই তাকে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। তাছাড়া তিনি যেহেতু চুরি-ঘুষখোরির বিষয়টি সবার অবগতির জন্যই ৯ এপ্রিল তারিখে গাড়ি বর্ডার গার্ডের হেড কোয়ার্টারে ঢুকিয়েছিলেন, সে কারণে এ ব্যাপারে আরও অনেক কথা বলার তার প্রয়োজন আছে। এটাই কারণ যেজন্য তিনি শেষ পর্যন্ত টিভিতে সাক্ষাত্কার দিয়েছেন। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। দুদক চেয়ারম্যানের ভাষায়ই বলা উচিত্ ছিল—ড্রাইভারের মতো ‘ছোট’ চাকরি করা লোক যে জনগণের পকেট মেরে সরকারি লোকদের পকেট ভর্তির এই কীর্তি প্রকাশ করার জন্য নিজের চাকরি খতম ও জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে এসেছেন, এর জন্য সাধুবাদ তার অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু এই সাধুবাদের পরিবর্তে দুদক চেয়ারম্যান যেভাবে ড্রাইভার হিসেবে আজম খানকে হেয়প্রতিপন্ন করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোম্পানিকে সাধু সাজানোর চেষ্টা করেছেন, তার থেকে হীন ও ঘৃণ্য কাজ আর কী হতে পারে!
ড্রাইভার আজম খানের টিভি সাক্ষাত্কারের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে। কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞানহীন এ ধরনের লোকেরা স্বেচ্ছায় কোনো পদ বা কোনো স্বার্থ ত্যাগ করার লোক নন। কাজেই তিনি জনসভায় পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ ঘোষণা করে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছেন! বাংলাদেশ যে চোর-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে; এর থেকে তার বড় প্রমাণ আর কী দাখিল করা যায়! এই কালো হাতি যে তার ‘সত্ ও শুভ্র’ মাহুতের পৃষ্ঠপোষকতার জোরেই চুরি-ঘুষখোরির পর বুক ফুলিয়ে বেড়াতে পারছেন, এতে সন্দেহ নেই। ৯ এপ্রিলের ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত রেলমন্ত্রী হিসেবে সুরঞ্জিতকে পদত্যাগ করতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগে যাকে এভাবে পদত্যাগ করতে হয় তাকে আবার নতুন করে মন্ত্রিত্বের গদিতে বসানো যায় কীভাবে? দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত কোনো দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। দুনিয়ার সব থেকে বড় দুর্নীতিবাজ শাসক শ্রেণীর দেশ হিসেবেই বাংলাদেশে এটা সম্ভব হয়েছে। যে দেশে মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, চিকিত্সা, শিক্ষার জন্য হাহাকার করে বেড়ায়—সেখানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো একজন দুর্নীতিবাজ লোককে কেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে গদিতে বসিয়ে রেখে তার জন্য মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে? এ কাজটিও কি বড় ধরনের দুর্নীতি নয়? এ কাজ যিনি করেন তিনি কি চোরের মা নন? কিন্তু এই দুর্নীতির বিষয়ে দুদক কি কোনো প্রশ্ন করেছে? বোধ হয় ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণের অভাবেই এটা বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি! তবে এতদিন পর এ ব্যাপারে হাইকোর্টের টনক নড়েছে!! তারা সরকারকে কারণ দর্শাতে বলেছেন কেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা কেন এতদিন চুপ করে ছিলেন, এটাও কি এক রহস্যজনক ব্যাপার নয়?
ড্রাইভার আজম খানের টিভি সাক্ষাত্কারের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের দাবি ব্যাপকভাবে হচ্ছে। এটা বিরোধী দল বিএনপির কাজ—এটা বলে সরকার নিজের পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এর দ্বারা কোনো কাজ হবে না। কারণ এ দাবি বিএনপি করতে পারে, কিন্তু তার থেকে বড় আকারে এ দাবি এখন ফিরছে জনগণের মুখে মুখে, সারা দেশজুড়ে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করতেই হবে। শুধু তাই নয়, আদালতে তার চুরি-ঘুষখোরি-দুর্নীতির প্রকাশ্য বিচার হয়ে তার উপযুক্ত শাস্তি হতে হবে। এর মাধ্যমেই প্রকাশ্য হবে রেল মন্ত্রণালয় আজ কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে, রেলের ব্যবস্থাপনা আজ এত সঙ্কটাপন্ন কেন।
চোরকে রক্ষা এবং শুধু রক্ষাই নয়, তাকে পুরস্কৃত ও সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যেই বাধ্য হয়ে রেলমন্ত্রী থেকে পদত্যাগের পর সুরঞ্জিতকে আবার মন্ত্রী করা হয়েছে। যে প্রধানমন্ত্রী এ কাজ করেন তার খবর কী? তিনি কি সাধু? কোনো সাধুর নেতৃত্বে কি দেশে চোরের রাজত্ব কায়েম হতে পারে? এসব প্রশ্ন এখন দেশবাসীর সামনে। খরগোশের মতো চোখ বুজে থেকে সরকার নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু সে চেষ্টা পদ্মা নদীতে বালির বাঁধের মতোই ধসে যেতে বাধ্য। এই ভবিষ্যত্ই এখন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সামনে।
৯.১০.২০১২

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads