শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১২

১৩ প্রকল্পে স্থবিরতায় বিশ্বব্যাংকের অসন্তোষ : পদ্মা সেতু থেকেও কিছুই শেখেনি সরকার



বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩টি প্রকল্পের বাস্তবায়নে চরম স্থবিরতা দেখা দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। দৈনিক আমার দেশ-এর রিপোর্টে জানা গেছে, কোনো কোনোটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। যেমন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পল্লী এলাকায় বিদ্যুতায়নের জন্য ১৭ কোটি ডলারের যে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ! অন্য প্রকল্পগুলোও এগোচ্ছে শম্বুক গতিতে। যেমন তিন-তিনটি বছর পেরিয়ে গেলেও ১৪৯ মিলিয়ন ডলারের ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়নিষ্কাশন প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র পাঁচ দশমিক ৭০ ভাগ। চট্টগ্রামে একই প্রকল্পের জন্য দু’বছরে অর্থছাড় হয়েছে শূন্য দশমিক তিন শতাংশ, যাকে ‘মাত্তরই’ না বলে উপায় থাকে না। সেখানে আসলে কোনো কাজই হয়নি। উল্লেখ্য, মোট ৩৩টি প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ৪৬০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্বব্যাংককে নিরাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। অসন্তোষের কথা জানিয়ে এক চিঠিতে বিশ্বব্যাংক সরকারকে বলেছে, প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে ত্রুটি এবং জনবল নিয়োগ ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় জটিলতাই এমন অবস্থার প্রধান কারণ। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু না জানালেও দ্রুত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার জন্য তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বলা দরকার, প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এই অসন্তোষ দেশের জন্য মোটেও শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। উদ্বেগের কারণ হলো, এমন একসময়ে খবরটি জানাজানি হয়েছে যখন পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগেই তদন্তকারী দল ঢাকা সফর করে গেছে। পদ্মা সেতুর জন্য ১২০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের বাড়াবাড়ি রকমের বাগাড়ম্বর ও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে উল্টো ‘পারসেন্টেজ’ খাওয়ার অভিযোগের কারণে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও এরই মধ্যে অত্যন্ত তিক্ত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় কর্তব্য যখন ছিল চলমান অন্য প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে সততার সঙ্গে সচেষ্ট হওয়া, সরকার সেখানে শোচনীয় ব্যর্থতা দেখিয়েছে। আমরা অবশ্য কেবলই ব্যর্থতা বলার মধ্যে থেমে যাওয়ার পক্ষপাতী নই, কারণ মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ‘মাত্তরই’ ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশের বাস্তবায়ন এবং দু’বছরে শূন্য দশমিক তিন শতাংশ অর্থছাড়ের তথ্য অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে অযোগ্যতা ও অদক্ষতাকেই প্রাধান্যে নিয়ে এসেছে। এদিকে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে ত্রুটিসহ বিশ্বব্যাংকের অভিযোগগুলোও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। সংস্থাটি শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছে যে, অর্থ আত্মসাতের গোপন উদ্দেশ্য নিয়েই ত্রুটিপূর্ণ কিছু প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে যদি পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতির বিষয়টিকে সামনে আনা হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগই অবশিষ্ট থাকে না। বরং স্বীকার করতে হয়, পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতা থেকেও কিছুই শেখেনি সরকার।
আমরা মনে করি, বিশেষ করে দুর্নীতির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক সামান্য বাড়িয়ে বলেনি। কারণ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়নের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম কয়েক মাস পর্যন্ত চুপচাপ কাটিয়ে অর্থবছরের শেষদিকে এসে প্রকল্প শেষ করা হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে। ২০১১-১২ অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় মাত্র এক মাসে ৯০/৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে দেখিয়ে রেকর্ডও করেছে। শোনা যায়, ‘আবুল হোসেন’দের দিয়ে নির্বাচনের জন্য তহবিল তৈরি করার কাজ চলছে বলেই লুটপাটের কবলে পড়েছে এডিপির প্রকল্পগুলো। এখন চলছে বিশ্বব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা। আমরা বেশি উদ্বিগ্ন আসলে জাতীয় স্বার্থের কারণে। কেননা বিশ্বব্যাংক যেসব প্রকল্পে সহায়তা করছে, সেগুলোর প্রতিটির সঙ্গেই প্রত্যক্ষভাবে জনস্বার্থ জড়িত রয়েছে। বিশ্বব্যাংক যদি পিছিয়ে যায় ও সহায়তা বন্ধ করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্তও হতে হবে জনগণকেই। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে বৈদেশিক সাহায্যের দিকটি। আমার দেশ-এর রিপোর্টেও বলা হয়েছে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের শম্ভুক গতি, ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে দেশে বৈদেশিক সাহায্যও কমতে শুরু করেছে। যেমন ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রতিশ্রুতি যেখানে ছিল ৪৫০ কোটি ডলারের, সেখানে অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র ২০৩ কোটি ডলার। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যও একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি তার কৈফিয়ত্ আদায় করা এবং তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী অফিসার-ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads