বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১২

''টাকা নইলে মৃত্যু''


 ‘বেল্লাল ভাই, সামনে ঈদ। বিশ লাখ টাকা দরকার। টাকাগুলো একটি খামে ভরে রাখবেন। আগামী তিন দিনের মধ্যে ফোন করবো। ফোন পাওয়ার ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে জায়গামতো পৌঁছে দিবেন। র‌্যাব কিংবা পুলিশকে জানাবেন না। কোন চালাকিও করবেন না। অন্যথায় আপনার বড় ভাইয়ের পরিণতি ভোগ করতে হবে। টাকা না দিলে মৃত্যুর জন্য রেডি থাকবেন। কাফনের কাপড় পাঠালাম।’ এভাবেই রাজধানীর ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করছে সন্ত্রাসীরা। গত ১১ই সেপ্টেম্বর রাজধানীর প্রিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ মো. বেলাল হোসেনের কাছে চাঁদা দাবি করে ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করা একটি চিঠি পাঠিয়েছে এক সন্ত্রাসী। ‘রাজু ভাই’ নাম ব্যবহার করে সে চিঠির সঙ্গে কাফনের দু’টুকরা কাপড়ও পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিকার চেয়ে তিনি মিরপুর মডেল থানায় জিডি করেছেন। পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের কাছেও অভিযোগ করেছেন। গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলের ম্যানেজার সাইদুর রহমান বলেন, প্রিন্স গ্রুপের স্বত্বাধিকারী বেলাল হোসেনসহ তারা ৮ ভাই। ২০০৫ সালে চাঁদার দাবিতে মিরপুর ১ নম্বরে বেলাল হোসেনের ভাই কাজী শহিদুল হককে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এ কারণে এ ধরনের হুমকি পেয়ে বেলাল হোসেনসহ তার স্বজন ও কর্মচারীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের সুবল ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ীর ফোন নম্বরে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। সময় বেঁধে দিয়েছে দুই ঘণ্টা। ওই সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছে। এ ঘটনায় তিনি বিচলিত হয়ে পরিচিত সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। সঙ্গে সঙ্গে ওই নম্বর ট্র্যাকিং করে পুলিশ কর্মকর্তারা মাদারীপুরের লুন্ডি গ্রামের লোকেশন জানতে পারেন। একই ভাবে চাঁদার দাবিতে মিরপুরের মিষ্টি ব্যবসায়ী সুমন ও তার পিতাকে হত্যার আলটিমেটাম দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। সুমন বলেন, পাঠান নামে এক সন্ত্রাসী বিভিন্ন ফোন থেকে হত্যার হুমকি দিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করছে। গত দু’সপ্তাহ ধরে ফোনে মেসেজ পাঠাচ্ছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ২ লাখ টাকা রেডি রাখার জন্য দুই দিন সময় বেঁধে দিয়েছে। এ ঘটনায় তিনি পল্লবী থানায় জিডি করেছেন। ওদিকে ঈদ সামনে রেখে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ভিনদেশী মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছে চাঁদা দাবি করছে। দাবি করা চাঁদা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না দিলে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এসব হুমকিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। সমপ্রতি বিজিএমইএ’র মহাসচিব এহসান-উল-ফাত্তাহ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনের কাছে একই অভিযোগ করেছেন। অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত ২৪শে সেপ্টেম্বর থেকে বিজিএমইএ-র সদস্য প্রতিষ্ঠান প্যানউইন গ্রুপের প্যানউইন ফ্যাশন লি. কারখানার ডিজিএম শাহজালাল রশীদ বাবুর মোবাইল ফোনে শাহাদাত ভাইয়ের নির্দেশে চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। এছাড়া ভিনদেশী বিভিন্ন ফোন নম্বর থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে তারা। চাঁদা না দিলে তার প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এতে কারখানার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। চাঁদার দাবিতে সন্ত্রাসীদের প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে পল্লবী থানায় জিডি করেছেন গাড়ি ব্যবসায়ী ইলিয়াস। তিনি অভিযোগ করেন, কখনও মোহাম্মদপুরের নবী, কখনও কসাই পরিচয় দিয়ে সন্ত্রাসীরা তার মোবাইলে চাঁদা দাবি করছে। সন্ত্রাসীদের দাবি- পল্লবীতে ব্যবসা করতে হলে মাসে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। অন্যথায় লাশ প্যাকেট করে গুমের হুমকি দিয়েছে। ইলিয়াস মানবজমিনকে বলেন, গত ৩০শে সেপ্টেম্বর থানায় জিডি করেছি। কিন্তু প্রতিকার পাইনি। পরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। তাতেও কাজ হয়নি। এখনও ওই সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে ফোনে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানী জুড়ে প্রায় ৫০০ চাঁদাবাজ গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক অঙ্গসংগঠনের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ওই সন্ত্রাসীরা নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদার ফরমান জারি করছে। এমন অভিযোগে প্রতিদিনই ২৫-৩০টি অভিযোগ জমা পড়ছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে। গোয়েন্দারা জানান, বেশির ভাগ চাঁদাবাজ স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। এদের সাঙ্গপাঙ্গরাই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে থাকে। আবার মাদারীপুরের একটি চাঁদাবাজ গ্রুপ আছে যারা বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে ফোনে ফোনে চাঁদা দাবি করে। তারা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় টাকা পাঠিয়ে দিতে বলে। এর বাইরে পুরান ঢাকার নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদ বাহিনীর কিলার গ্রুপের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। ঈদ উপলক্ষে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। চাঁদার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের ফোনে ফোনে। কৌশলে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। শুধু স্থানীয় প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীরাই নয়। ঈদ সামনে রেখে পুলিশ, ক্ষমতাসীন অঙ্গসংগঠন এবং বিভিন্ন ব্যানারে রাজধানী জুড়ে অভিনব কৌশলে চাঁদা তোলা হচ্ছে। আর চাঁদার টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে পুলিশ, দলীয় লোকজন ও সন্ত্রাসীদের নামে। ভুক্তভোগীরা জানান, ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য ততই বাড়ছে। বাড়ছে চাঁদাবাজির সংখ্যা ও চাঁদার হার। গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এবারের ঈদকে সামনে রেখে তিন ধরনের চাঁদাবাজি হচ্ছে। আপসে, কৌশলে চাপ দিয়ে ও হত্যার হুমকি দিয়ে। ব্যবসায়ীরাও তাদের ম্যানেজ করে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। সূত্রমতে, পুরান ঢাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা আদায় করছেন শাসক দলের নেতারা। এছাড়া ফুটপাথ থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার, শপিং মল, মার্কেটে ও মহাসড়কে চাঁদাবাজির মোচ্ছব শুরু হয়েছে। লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট ও বিভিন্ন বাস টার্মিনালেও চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে নানা কৌশলে চাঁদার টাকা তোলা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিস সেন্টারের ডিসি মো. মাসুদুর রহমান বলেন, রাজধানীতে চাঁদাবাজিসহ যে কোন ধরনের অপরাধ দমনের জন্য অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। কেউ চাঁদা দাবি করলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সহায়তা নেয়ার জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকেই সূত্রাপুর, কোতোয়ালি ও বংশাল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। এদিকে সদর ঘাট, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স, কো-অপারেটিভ মার্কেট সোসাইটি, কুসুমে বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্স, শাহআলী শপিং কমপ্লেক্স, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, তালতলা সুপার মাকের্ট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট ও পুরান ঢাকার বেশির ভাগ মার্কেটে চাঁদাবাজির মোচ্ছব শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় কখনও শীর্ষ সন্ত্রাসী আবার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের নামে টাকা তোলা হচ্ছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সমপ্রতি মিরপুর এলাকা থেকে একাধিক চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কৌশলে ব্যবসায়ীদের কাছে তারা চাঁদা দাবি করেছে। ওই চাঁদাবাজদের পাকড়াও করতে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads