রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

নীরব মানুষ সরব হচ্ছে



মো: বেলায়েত হোসেন
সরকারের অসহিষ্ণু, বেপরোয়া ও মারমুখী আচরণ এবং সীমাহীন দুর্নীতির ফলে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষ দুঃশাসনের দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বিরোধী দলের গণমিছিলে নীরব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে। শীর্ষ দুই নেতার অনুপস্থিতিতেও গণমিছিল ছিল লোকে লোকারণ্য। নীরব সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ গণমিছিলটি পরিণত হয় বিশাল গণজমায়েতে। সরকারের জনপ্রিয়তা যে একেবারে শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে, তারই বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে এই গণমিছিলে।
দুর্নীতির নানা কল্পকাহিনী দেশবাসীকে শুনিয়ে, রাজনীতিকে চরম বিপথগ্রস্ত করে এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে ২০০৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয় বর্তমান মহাজোট সরকার। কিন্তু বর্তমানে তাদের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মানুষ আজ তীক্ষè অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পেরেছে, নজিরবিহীন ও দুর্নীতির প্রতিযোগিতা এখন চলছে বাংলাদেশে। দুর্নীতির এই ভয়াবহ চিত্র আগে কখনো দেখা যায়নি বাংলাদেশে।
দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে নাম না জানা মানুষ শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। ব্যাংকে রাখা জনগণের আমানত পরস্পরে যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সীমাহীন দুর্নীতি, শোষণ ও আয়ব্যয়ের বৈষম্যে সমাজ বিকাশের স্বপ্নাতুর মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রতিনিয়ত সক্ষমতা হারাচ্ছে। দেশ থেকে বিপুল টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি। তাই নীরব মানুষ আজ জেগে উঠছে, সরকার জনরোষের মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে; যেকোনো সময় মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।
বস্তুত গত চার বছরে সরকার মানুষের ভেতর শুধু ক্ষোভই তৈরি করেছে। শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি নিয়ে মানুষের ভেতর ক্ষোভ আছে, রেলের কেলেঙ্কারি নিয়ে ক্ষোভ আছে; ক্ষোভ আছে হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপে টু কেলেঙ্কারি নিয়েও। কেননা এসবের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নজিরবিহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে। তা ছাড়া সীমাহীন দুর্নীতি ও নজিরবিহীন শোষণ এবং পরিকল্পনাহীন কর্মকাণ্ড, অব্যবস্থাপনা ও দুঃশাসনের কারণে গত চার বছরে প্রায় দুই কোটি মধ্যবিত্ত পরিবার নিম্নবিত্ত ও নিঃস্ব পরিবারে পরিণত হয়েছে। এসব মধ্যবিত্ত পরিবার ক্রোধে ফুঁসছে। তাদের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
কুইক রেন্টাল-নির্ভর জ্বালানিনীতি সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে নিচ্ছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ। ঘরে ঘরে অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিল আসছে। কয়েক মাস আগেও যে পরিমাণ বিল হতো এখন তা দ্বিগুণ, তিন গুণ হয়েছে। কোনো কোনো গ্রাহকের বিল দাঁড়িয়েছে চার-পাঁচ গুণ। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক ও নানা প্রশ্ন। এই দুর্নীতিগ্রস্ত, পরনির্ভরশীল ও রক্তচোষা জ্বালানি নীতি অব্যাহত থাকলে বিদ্যুৎ বিল দিতে দিতে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব ও ফকির হয়ে যাবে; দেশও দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হবে।
অন্য দিকে গত চার বছরেও মানুষের চোখে পড়ার মতো কোনো উন্নয়নকাজ সরকার করতে পারেনি, তা ছাড়া সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদাও পূরণ করতে পারেনি। দিনবদল হয়নি, মানুষ ঘরে ঘরে চাকরি পায়নি; বিনা পয়সায় সার ও ১০ টাকা কেজি চাল পাওয়া স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তাই সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেই ক্ষোভের আগুন জ্বলছে, এমনকি খোদ সরকারি দলের লোকজনের মধ্যেও।
সরকারের হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও দমন-পীড়নের ফলে দেশের রাজনীতিতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে, তার পুরোপুরি সুফল বিরোধী দলের ঘরে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে জনমত সংগঠিত হচ্ছে বিরোধী দলকে ঘিরে।
কার্যত দলের নীরব সমর্থকেরা যখন সক্রিয় হয় এবং রাস্তায় নেমে আসে, ঠিক তখনই রাজনীতিতে গণবিস্ফোরণ বা গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী পরিবারের কোটি কোটি নীরব সমর্থক রয়েছে দেশে। সরকারের দমন-পীড়ন ও সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের ফলে এ নীরব সমর্থকেরা এখন সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হচ্ছে। বিরোধী দলকে যেকোনো সহযোগিতা করতে তারা এখন প্রস্তুত। তারা কোনো নির্দেশের অপেক্ষা করবে না, তারা নিজে নিজেই নেতৃত্ব হাতে তুলে নেবে। এক-এগারোতে মইন-ফখরুদ্দীনের কুখ্যাত জরুরি সরকার এটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল।
ইসলামি শক্তিগুলোও সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তাদের নীরব সমর্থকেরাও অস্তিত্ব রক্ষায় রাজপথে নামার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। সব মিলিয়ে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তি এক হয়ে মাঠে নামলে শক্তির দিক দিয়ে এক মহাশক্তিতে পরিণত হবে। ফলে যেকোনো মুহূর্তে দেশে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। লক্ষণীয়, প্রায় এক লাখ কোটি টাকা শেয়ার মার্কেটের মাধ্যমে লুটে নেয়ায় জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড আজ ভেঙে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মন্দা, সমাজ হয়ে পড়েছে পুঁজিশূন্য।
প্রায় ৩৫ লাখ মধ্যবিত্ত পরিবারকে শেয়ার মার্কেটের মাধ্যমে শোষণ ও নিঃস্ব এবং সর্বস্বান্ত করে কোনো সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা দেখছেন এক আশ্চর্যজনক ঘটনা হিসেবে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমনটি হলে বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিবাদের জোয়ারে ভেসে যেত সে দেশের সরকার। কিন্তু বিরোধী দলের ইতিবাচক রাজনীতির কারণে এত বড় কেলেঙ্কারির পরও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পাচ্ছে। এসব মধ্যবিত্ত পরিবার সুযোগ পেলেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। এটি বুঝতে পেরে সরকার মারমুখী ও বেপরোয়া আচরণ করছে, যাতে কোনো কার্যকর আন্দোলন দেশে গড়ে উঠতে না পারে।
সরকারের বেপরোয়া ও মারমুখী আচরণের ফলে দেশে-বিদেশে একটা ব্যাপার অত্যন্ত পরিষ্কার হচ্ছে, সরকার সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। তারা যেনতেনভাবে দেশে একটি নির্বাচন করতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার উঠিয়ে দিয়ে একটি আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন গঠন করে ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে এবং হামলা-মামলা, ভয়ভীতি-আতঙ্ক সৃষ্টি করে একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার রঙিন স্বপ্নে শাসক দল এখন বিভোর। কিন্তু জনতার শক্তির জোয়ার দেখে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব মহল থেকেই অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে দেখতে চায়। এটি রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলের জন্য জন্য একধরনের বিজয় বলা যায়। দৃশ্যত রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলেকে দমন-পীড়নের ফলে প্রাথমিকভাবে সরকারি দল পরিতৃিপ্ত বোধ করলেও আলটিমেটলি এর চূড়ান্ত ফল যাবে বিরোধী দলের ঘরে।
জনরোষে সরকারের পতন ঘটুক তা প্রত্যাশিত নয়। প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার বিদায় নিক। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। জনতার মুখের ভাষা বুঝতে পারলে জনরোষে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। জনতা চায় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের পরিবেশ দেশে সৃষ্টি হোক। জনগণের এ যৌক্তিক দাবি মানা সরকারের অবশ্যই কর্তব্য। জনতার দাবি মানার মধ্যে দোষের কিছু নেই, বরং গর্ব আছে। কাজেই জনতার দাবি মেনে নিলে আগামীতে আর কিছু না হোক অন্তত বিরোধী দলের স্থানটি তারা ধরে রাখতে পারবে। না হয় জনরোষে বিদায় নিলে সামনে বিরোধী দলের স্থানটিও তাদের হাতছাড়া হতে পারে। আশা করি, শাসকদের বোধোদয় হবে।
e-mail : belaYet_১@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads