সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

জালনোট তৈরির গুরু গ্রেফতার : সেও সরকারদলীয় নেতা



দেশজুড়ে দুর্নীতি, লুটপাট, জাল-জালিয়াতি কীভাবে ছড়িয়েছে, সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। শেয়ারবাজার, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্, রেলের কালো বেড়াল, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির কথা সবাই জানেন। এসব নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলের ভূমিকাও গোপন কিছু নয়। অনেক ধানাই-পানাইয়ের পর কোনো কোনো ঘটনার তদন্ত এবং কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও শেষ পর্যন্ত কী হবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস খালি চোখেই দেখা যায়। কারণ, প্রতিটি ঘটনায় ক্ষমতাধর মহলের যোগসাজশ বেরিয়ে আসে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত প্রভাবশালীদের সংখ্যাও কম নয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হলে গা বাঁচানো সহজ বলেই অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সর্বশেষ ১০০ কোটি টাকা জালনোটের ঘটনায় আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগের কেন্দ্রীয় নেতার জড়িত থাকার পেছনেও ভিন্ন কোনো কারণ নেই।
গত শনিবার ও রোববার দু’দিন ধরে পরিচালিত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ধরা পড়েছে নগদ ১০ কোটি টাকা ও জালনোট তৈরির সরঞ্জামসহ জড়িত নয়জন। দীর্ঘদিন ধরে জালটাকা তৈরি করে দেশ-বিদেশে রমরমা বাণিজ্য খুলে বসেছিল এ চক্রটি। এদের গুরু, যিনি সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন মুক্তিযোদ্ধা লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক, দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এ ব্যবসা করে সামান্য দোকান কর্মচারী থেকে হয়ে উঠেছে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক। নিজের আইনজীবী ছোট ভাইকে নিয়েই গড়ে উঠেছে তার জালটাকা ব্যবসার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। এই অপকর্মের শুরু বিগত আওয়ামী লীগ আমলে। ’৯৯ সাল থেকেই ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাট বাড়িকে ঘিরে জালটাকা তৈরি ও বিক্রির দুষ্কর্ম জমে ওঠে। সে সময় একবার ধরা পড়লেও বেশি দিন জেলে আটক থাকতে হয়নি তাকে। জামিনে মুক্তি পেয়েই বিপুল উদ্যমে দলবল গুছিয়ে বাণিজ্যিকভাবে তার জালটাকার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সীমান্ত শহরে গড়ে ওঠে নতুন নতুন কেন্দ্র। ভারতীয় টাকাসহ বিদেশি টাকাও জাল করা শুরু হয়। এবারে ঈদুল আজহা ও দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে নতুন নোটের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়ার সময়টিকেই বেছে নেয়া হয় জালটাকা ছাড়ার মোক্ষম সময় হিসেবে। ১০০ কোটি টাকার জালনোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। ধরা পড়ার আগেই বাজারে চলে গেছে ২০ কোটি জাল টাকা। তারপরও এদের ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তাদের প্রশংসা করতে হয়। এখন দেখা যাক ক’দিন আটক থাকতে হয় জালটাকা তৈরির গুরু আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগের এই মহান (!) নেতাকে।
দেশের বাস্তব অবস্থাই মানুষের মনে এমন প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। শেয়ারবাজার লুট থেকে শুরু করে বেশিরভাগ কেলেঙ্কারির হোতারা এখন পর্যন্ত নিরাপদেই রয়ে গেছে। কারণ, তারা সরকার দলীয় হোমড়া চোমড়া অথবা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট। ডেসটিনি, হলমার্ক নিয়ে যা শুরু হচ্ছে, তার শেষটা না দেখে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবে না। কারণ, সরকারের ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দগদগে ঘায়ের মতো সমাজের সর্বত্রই দৃশ্যমান। অপরাধ-অপকর্মে জড়িতরা অতি সহজে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। রাজনীতিকরাও যে এর বাইরে নয়, সেটাও জানা কথা। টিআইবির প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও এমনটাই বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায় দেশ দাঁড়িয়ে আছে সর্বনাশের শেষ কিনারায়। এমতাবস্থায় দেশে আর যাই হোক আইনের শাসন বা সুশাসন কল্পনা মুখের বুলিতেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য। এ পরিস্থিতিতে জালটাকা তৈরির গুরুর মতো যাদের রাজনৈতিক পরিচয়টাও বাহারি, তাদের জন্য ডিবি পুলিশের অভিযান থেকে সাময়িক অসুবিধা সৃষ্টির বেশি কিছু হবে, বিশ্বাস করার লোক কমই পাওয়া যাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads