শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

এ কোন রাজ্যে আমার বসবাস


এম আ ব দু ল্লা হ

গল্পটি আমার মরহুম আব্বাজানের কাছে শোনা। রূপকথার গল্প নয়, বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে আরবি সাহিত্যে গল্পটি স্থান পেয়েছে। সবিস্তারে গল্পটি তুলে ধরা পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। তাই গল্পের প্রাসঙ্গিক সারসংক্ষেপটাই তুলে ধরছি।
এক রাজ্যের সিংহাসনে এক উন্মাদ রাজা বসেছিল। সব কিছু ওলটপালট করে দেয়াই তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। একে একে রাজ্যের সবকিছুকে বদলে দিলেন। রাজার ফরমানে মানুষ শরীর ঢাকতে লুঙ্গি-পায়জামা আর লজ্জা নিবারণে পাঞ্জাবি পরত। আবার পাঞ্জাবির ওপরে পরতে হতো আন্ডারওয়্যার। চাকরকে সম্মান-সমীহ করতে হতো মনিব। বাজারে সোনার দামের চেয়ে লোহার দাম বাড়িয়ে দেয়া হলো। ঘি বিক্রি হতো নিম্নমানের তেলের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ দামে। ধান-চালের চেয়ে ঢের বেশি ভূষির দাম। এভাবে সব ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দিকে দিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
পাশের রাজ্যের এক হতদরিদ্র ক্রীতদাস তার মনিবের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ। মানসম্পন্ন খাবার না পেয়ে প্রায় কঙ্কালসার হয়ে পড়ে। সে যখন জানতে পারে যে পাশের রাজ্যেই সব স্বাস্থ্যকর খাদ্যের দাম পানির দরে এবং মনিবরা ভালো খাবার চাকরকে দিয়ে মন্দ খাবার নিজেরা খাচ্ছে। ক্রীতদাস পুষ্টিকর খাবার খেয়ে মোটাতাজা হওয়ার বাসনায় পাড়ি জমালো উন্মাদ রাজার দেশে। যথারীতি সস্তায় ঘি, মাখন আর পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে অল্পদিনেই বেশ মোটাতাজা হয়ে গেল। মহা আনন্দে দিন কাটতে লাগল ক্রিতদাসের।
এরই মধ্যে রাজার ফরমান অমান্য করার দায়ে এক প্রজার ফাঁসির হুকুম হলো। কার্যকর করতে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল। অভিযুক্তের গলা বেশ চিকন হওয়ায় রশি মাথা গলিয়ে বার বার বের হয়ে যাচ্ছিল। উন্মাদ রাজার ততোধিক উন্মাদ জল্লাদরা রাজার দরবারে হাজির হয়ে জানালো যে, যার প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়েছে তার ঘাড় সরু হওয়ায় ফাঁসির রশি আটকানো যাচ্ছে না। রাজার তাত্ক্ষণিক হকুম—এই বেকুবের দল, রাজ্যে কি ঘাড় মোটা মানুষ নেই, সে রকম একজনকে ধরে এনে ফাঁসি দিয়ে দাও। জু হুকুম জাঁহাপনা। রাজার বাহিনী ঘাড় মোটা লোক খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেল পাশের রাজ্য থেকে আসা সেই সদ্য মোটাতাজা হওয়া ক্রীতদাসকে। আর যায় কোথায়? রশিতে খাপের খাপ মিলে গেছে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাজার বাহবা কুড়ালো দায়ি্ত্বপ্রাপ্ত জল্লাদ দল।
গল্পটির সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের কোনো মিল আছে কিনা সেটা হয়তো পাঠকরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবেন। তবে গল্পটি আমার মনে পড়ল সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায়। সবকিছু যেন উল্টে গেছে। বাংলাদেশসহ যে কোনো দেশে মন্ত্রিত্বের জন্য যারপরনাই লবিং-তদবির হয়। মন্ত্রিত্ব পেতে যেমন অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, তেমনি তা রক্ষায় সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। কখন মন্ত্রিত্ব চলে যায় সে আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটে অনেকের। কোনো কারণে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দিতে চাইলে সরকারপ্রধানের হাতে-পায়ে ধরে চেয়ার রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। জোর তদবির করে, অনুনয়-বিনুনয় করে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের জন্য জাতীয় পার্টিকে রাজি করা হয়েছে। ৫ বছর ধরে যারা একটি মন্ত্রিত্বের বেশি পাওয়ার যোগ্য ছিল না তাদের এখন ৭টি দিয়ে সরকারপ্রধান কৃতার্থ হন। আবার মন্ত্রিত্ব রক্ষার চেষ্টার পরিবর্তে ছাড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও কোনো কুলকিনারা হচ্ছে না। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার জন্য ধরনা দিয়ে কাজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কুরিয়ার সার্ভিসে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্র পাঠানোর বিরল ঘটনাও দেখা গেল। আবার এমন বাণীও শোনা গেল যে, ‘মন্ত্রিত্ব এমন জিনিস যেখানে ঢোকা যায়, কিন্তু বের হওয়া যায় না।’ হাফডজনের বেশি মন্ত্রী ও তাদের ডজনখানেক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া মন্ত্রিসভার বৈঠক চলে নির্বিকারভাবে। ‘নির্বাচনকালে অনির্বাচিত সরকার মানব’ এ ঘোষণা দিয়ে অনির্বাচিত কয়েক হালি উপদেষ্টা সরকারে দাপিয়ে বেড়ান।
তারও আগে ঘটা করে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে মহাজোট সরকারের অর্ধশতাধিক মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র জমার অনুষ্ঠান জাতি দেখলেও তারা পক্ষকাল ধরে মন্ত্রী পদে বহাল থাকেন। তারও আগে সোহেল তাজ নামক এক প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করার পর চার বছর ধরে তা কবুল হয়নি।
গল্পের রাজ্যের সঙ্গে আরও মিল খুঁজে দেখতে পারেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেই মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহেও। কোন রাজ্যে বাস করলে সাবেক সেনাপ্রধান ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নয় বছরের সাবেক রাষ্ট্রনায়ক হুমকি দেন যে, আমাকে জোর করে ধরে নিতে চাইলে চারটি লোড করা পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করব। শুধু তাই নয়, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার জন্য গঠিত একটি ‘এলিট বাহিনী’ যখন নেতাকর্মীদের মাড়িয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সুস্থ চেয়ারম্যানকে রাত গভীরে চিকিত্সার জন্য(!) জবরদস্তিমূলকভাবে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সামরিক হাসপাতালে আটকে রাখেন, তখন আমাদের দেশের সঙ্গে গল্পের রাজ্যের চমত্কার মিল খুঁজে পেতে পারেন অনেকে।
দেশে দেশে যখন ক্ষমতা নির্ধারণী ভোটযুদ্ধে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তখন তিনশ’ সংসদীয় আসনের প্রায় অর্ধেক ১৪২টিতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া যায় না। ফাঁকা মাঠে রেফারি, লাইন্সম্যান কিংবা প্রতিপক্ষ টিমের উপস্থিতি ছাড়াই যখন এক পক্ষের প্লেয়াররা পোস্টে বল মেরে মেরে তামাশার গোল উত্সবে মাতে তখন সেই একপক্ষীয় প্লেয়ারদের সঙ্গে গল্পের রাজার মিল খোঁজা দুষণীয় মনে নাও হতে পারে। নির্বাচন থেকে কেউ সরে দাঁড়ালে প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও তার দল খুশি হয়। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অভিপ্রায় ব্যক্ত করামাত্র তা গ্রহণ করে প্রার্থিতা থেকে তার নাম বাদ দেয়া। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা গ্রাহ্য হয় না। পাতানো সংসদে সরকারে বিটিম হিসেবে দেখানোর জন্য এরশাদ, জিএম কাদের, রুহুল আমিন হাওলাদারসহ জাপা নেতাদের প্রত্যাহৃত মনোনয়নপত্রকে বৈধতা দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের বশংবদ ও ক্রিতদাস ইসির চেহারাটা আরও পরিষ্কারভাবে পরস্ফুিট হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ আইনসঙ্গতভাবে একতরফা প্রহসনের নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরও আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিশন শাখা বলছে, ‘নির্বাচন ছেড়ে যাবেন কোথায়, আপনাকে নির্বাচনে থাকতে হবে। আপনার প্রত্যাহার আবেদন গ্রহণ করলাম না। আপনি প্রার্থী। আপনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী এমপি।’
গল্পের রাজ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়ার মতো আরও অনেক লক্ষণ আছে হালের বাংলাদেশে। জননিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখন খুনে বাহিনী। যখন-তখন সরকারবিরোধীদের গুম করাও তাদের অন্যতম কাজ। খাল, বিল, নদীনালায় মাছের পরিবর্তে পাওয়া যায় লাশ আর লাশ। ঘাতকদের হাত থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখা যে র্যাব বাহিনীর দায়িত্ব তারা ঘরে ঢুকে রাজনৈতিক নেতাকে ধরে বাড়ির ছাদে নিয়ে গুলি করে নিচে ফেলে দেয়। এসব উল্টো চিত্রের সঙ্গে গল্পের সেই রাজ্যের পার্থক্য কোথায়?
গল্পের রাজ্যে ঘি’র চেয়ে তেলের দাম কম। আজকের বাংলাদেশে তেমনটা না হলেও নুনের চেয়ে যে খুনের দাম কম তা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। ১৫ টাকার পেঁয়াজ দশগুণ বেশি দামে ১৫০ টাকা কেজিতে খেয়ে যে দেশের মানুষ অচেতন ঘুমায় সে দেশের মসনদে গল্পের রাজা আসীন হওয়াতে দোষের কী!
আরও আছে অস্বাভাবিক চিত্র। পদ্মা সেতুর মতো বৃহত্ ও জনআকাঙ্ক্ষার প্রকল্প দুর্নীতির কারণে বাতিল ও বিশ্বব্যাপী দেশ-কলঙ্কিত হওয়ার পর দায়ী দুর্নীতিবাজকে দেশপ্রেমিকের খেতাব দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের অর্থ লোপাটের পর শুনতে হয় ‘চার হাজার কোটি টাকা তেমন কোনো টাকা নয়’। দেশের ৫৭ জন চৌকস সেনা সদস্যকে বিডিআর বিদ্রোহের মোড়কে নৃশংসভাবে হত্যা করেও দায়ীরা পার পেয়ে যায়। শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর লাখ-কোটি টাকা লুটের পর উল্টো বিনিয়োগকারীদের অভিহিত হতে হয় ফটকাবাজ হিসেবে। জাতীয় সংসদে স্পিকার ও সিনিয়র সদস্যরা ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’, ‘স্যাডিস্ট’সহ সব ধরনের নেতিবাচক শব্দে যার চরিত্র বিশ্লেষণ করেন, আবার সেই স্পিকার চেয়ার-বদলের পর সেই ব্যক্তিকে মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চাসনে বসান। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করলে পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে জেল-জুলুম-রিমান্ডের খড়গ নেমে আসে মাহমুদুর রহমানের মতো দেশপ্রেমিক সাহসী সাংবাদিক-লেখকদের ওপর। আদালতের বিচারপতি স্কাইপে প্রবাসীর সঙ্গে আলোচনা করেন কাকে আগে, কাকে পরে এবং কী ধরনের দণ্ড দেয়া হবে। সেই দণ্ডদানের বিনিময়ে প্রমোশনসহ কি কি সুবিধা মিলবে তাও আলোচনা হয়। মন্ত্রীরা আগাম ঘোষণা করেন আদালতের রায়ে কী দণ্ড হবে। রাস্তায় ফাঁসি ফাঁসি স্লোগান দিলে ফাঁসির আদেশ পাওয়া যায়। নিম্ন আদালতের দণ্ড বেড়ে যায় আপিল আদালতে। সংবাদ সম্মেলন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার ঘোষণা দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা হয়।
গল্পের রাজ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য খোঁজার মতো আরও উপসর্গ আছে। গণতন্ত্রের লেবাসধারী সরকার বিরোধী দলের বিক্ষোভ দমনে সরাসরি গুলি করার বিকল্প কোনো অ্যাকশনের কথা ভাবতে পারে না। লাখো প্রতিবাদী জনতার সমাবেশে লাইট বন্ধ করে দেড় লাখ গুলিবর্ষণ করে দাবি করা যায় সেখানে কোনো রক্তপাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। প্রধান বিরোধী দলের অফিসে একজন নিরীহ নেতাকে ধরতে রাত গভীরে মই দিয়ে ঢুকে, তালা কেটে, দরজা ভেঙে তাণ্ডব চালালেও গণতন্ত্রে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটে না। পঞ্চদশ সংশোধনী নামক এক বিষবৃক্ষের ফল হিসেবে দেশের স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র, মানবতা সব কিছু বিপন্ন হলেও সেই বিষবৃক্ষ রোপণকারীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ না করে উল্টো তার প্রতিবাদকারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয় এক শ্রেণীর দলদাস, সেবাদাস মিডিয়া ও তথাকথিত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী-ব্যবসায়ী। যে ক্রিয়ার কারণে সহিংস প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গীতা রানী দাসরা এসব উপসর্গ দেখে মুখের ওপর ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না’ মন্তব্য ছুড়লে লজ্জা হয় না।
গল্পের রাজার উচ্চ আদালত থেকে উন্মাদের স্বীকৃতি লাভের সৌভাগ্য না হলেও আমাদের হয়েছে। গল্পের রাজ্যটিতে কোন যুগে উন্মাদ রাজার শাসন ছিল তা সুনির্দিষ্ট করে আমার জানার সুযোগ হয়নি। বাবা বেঁচে থাকলে জানতে চাইতাম। তবে এ সভ্যতার যুগেও আমরা তেমন এক রাজ্যের বাসিন্দা কিনা তা গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads