শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩

গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রা : অগ্নিপরীক্ষার মুখে


আজ ২৯শে ডিসেম্বর। আজ জাতির জীবনে অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। গত মঙ্গলবার একটি জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে অবিসংবাদিত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সারাদেশের মানুষকে ঢাকায় আগমন করতে এবং ঢাকায় মিলিত হতে আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সাথে একই দিন ঢাকা মহানগরীর অধিবাসীগণকেও ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মফস্বলের মানুষের ঢাকা আগমন এবং ঢাকা মহানগরীর মানুষের রাস্তায় নেমে আসাকে গধৎপয ভড়ৎ উবসড়পৎধপু বা গণতন্ত্রের অভিযান বলে বেগম খালেদা জিয়া বর্ণনা করেছেন। তিনি সরকারকে বলেছেন, ঢাকা অভিযানে বাধা না দিতে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছেন, অবৈধ সরকারের অন্যায় নির্দেশ মেনে জনগণের ওপর নির্যাতন না চালাতে এবং ঢাকা অভিযানে বাধা না দিতে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে, যদি ঢাকা অভিযানে বাধা দেয়া হয় তাহলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। ২৯শে ডিসেম্বর দিনটি সমগ্র বাংলাদেশের জন্যই অগ্নিপরীক্ষা। সরকার যদি এই অভিযানে বাধা দেয় তাহলে, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, জনগণ প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এর ফলে দেশ মারাত্মক অরাজকতায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে। তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ২৯ তারিখের পর ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশ নৈরাজ্য কবলিত হতে পারে।
     কিন্তু এই হুঁশিয়ারিতে তারা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। সাংবাদিক সম্মেলনে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচী ঘোষণা করার ৬ ঘণ্টার মধ্যেই বেগম  জিয়ার  বাসভবন বিপুল সংখ্যক র‌্যাব পুলিশ তথা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। পোশাকধারী এসব সিকিউরিটি ফোর্স ছাড়াও সাদা পোশাকেও বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য তার বাসভবন এবং তার গুলশান অফিস সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখে। র‌্যাব ও পুলিশের সদস্য দিয়ে তার বাসভবন এবং অফিস ঘিরে রাখা হলেও কার্যত বহির্জগৎ থেকে তাকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন রাখা হয়েছে। তার বাসভবন বা অফিস থেকে কেউ বেরুতে গেলে অথবা প্রবেশ করতে গেলে তাকে হয় বাধা দেয়া হচ্ছে না হয় গ্রেফতার করা হচ্ছে। ২৯শে ডিসেম্বরকে সামনে রেখে আওয়ামী সরকার প্রধান দুই বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে জনগণ থেকে বিছিন্ন করে একঘরে করার অপচেষ্টা করছেন। ঐ রাতেই বেগম জিয়ার বাসায় যাওয়ার পথে নরসিংদীর সাবেক সংসদ সদস্য সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুল এবং মহিলা সংসদ সদস্য শাম্মী আখতারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের দু’জনকে আদালতে নেয়া হয়েছে এবং রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। কোর্ট অবশ্য তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেনি। তবে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশকে  বলা  হয়েছে। এছাড়া শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর পুত্র তারিক আউয়াল, স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলামসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং সাংবাদিক শফিক রেহমানকে অফিসে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গণিকে গ্রেফতার করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পথে মৎস্য ভবনের সামনে বার সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত অবরোধ যে দিন শেষ হয়েছে সেই শেষ হওয়ার ৬ ঘণ্টা পর বাংলামটরের সামনে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা অব্বাস এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সহ ১৮জন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এই ১৮ জনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ২ জন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ বলেছে যে, এই ১৮ জনকে গ্রেফতার করার জন্য তারা ইতোমধ্যেই অভিযান শুরু করেছে। তবে এসব নেতা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ায় তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচনের আগেই বিএনপি এবং জামায়াতকে ক্রাশ করার জন্য আওয়ামী সরকার সমস্ত শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। অবশ্য এর প্রতিধ্বনি শোনা গেছে আওয়ামী লীগের কো-অর্ডিনেটর প্রাক্তন মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কণ্ঠে। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন ২৯শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের মাটিতে হয় বিএনপি থাকবে, না হয় আওয়ামী লীগ থাকবে।
দুই
বেগম জিয়া যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, সেটি একটি শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস কর্মসূচী। এই কর্মসূচিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতার কোন ইঙ্গিত নেই। অথচ সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অনাহুতভাবে  সেখানে সন্ত্রাসের গন্ধ আবিষ্কার করছেন এবং কোন অবস্থাতেই এই কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না বলে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সহ অনেকেই ঘোষণা দিচ্ছেন। ঢাকা মহানগরীর বেশ কয়েকজন বর্তমান এমপি এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত কয়েকজন এমপি-ইলেক্ট রাজধানীতে সদ্য প্রবেশকারী মানুষজনকে গ্রেফতার করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে এসব নতুন-পুরাতন এমপি বলেছেন যে, রাজধানীতে সন্ত্রাসীরা ঢুকেছে। এদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। ঢাকা মহানগরীতে মফস্বল থেকে মানুষের প্রবেশ প্রতিরোধ করার জন্য গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও সদরঘাটের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে পাহারা দিতে বলা হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড এবং ইউনিটে সতর্ক পাহারা বসানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদেরকে রাজধানীতে যারা আশ্রয় দেবে, তাদেরকেও গ্রেফতারের দাবি তোলা হয়েছে। পত্রিকাতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে গোপন রিপোর্ট দিয়েছে। ২৯শে ডিসেম্বরের কর্মসূচীতে নাশকতা হতে পারে, এই মর্মে নাকি ঐসব রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই গত বুধবার থেকে বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন এবং তার গুলশানস্থ অফিসের চারধারে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, ২৯ তারিখের কর্মসূচীতে সন্ত্রাস হবে, এমন একটি পূর্ব ধারণা নিয়ে সরকার পুলিশী তৎপরতা শুরু করেছে। কিভাবে সরকার এবং সরকারি দল বুঝতে পারলো যে, ২৯ তারিখে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি কর্মকা- ঘটবে? বেগম জিয়া যে কর্মসূচী দিয়েছেন সেটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচী। সেই কর্মসূচীতে বাধা দেয়ার অর্থই হলো, মতামত প্রকাশের কণ্ঠরোধ করা। সরকারের উচিত ছিলো ২৯ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং দেখা যে গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রার নামে কোন সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিবাদী অপকর্ম চালানো হয় কি-না। যদি হয়, তাহলে সেটি দমন করার পূর্ণ অধিকার সরকারের থাকবে এবং তখন যদি সরকার কোন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেই পদক্ষেপের প্রতি জনগণের সমর্থন থাকবে।
তিন
কিন্তু সে পথে যাচ্ছে না সরকার। তারা যেটা করছে সেটা ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার জার্মানীর হিটলার এবং ইটালির মুসোলীনিকেও হার মানিয়েছে। এর আগেই বলেছি যে, ঢাকায় পুলিশের গাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। সাথে সাথে বিএনপি’র মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমীর সহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরদিন রাজশাহীতে পুলিশের গাড়িতে কে বা কারা বোমা নিক্ষেপ করেছে। সাথে সাথে প্রাক্তন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এবং রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র বুলবুলসহ অসংখ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গতকাল এই ভাষ্য লেখার সময় পর্যন্ত প্রাক্তন মেয়র মিজান বা বর্তমান মেয়র বুলবুলকে পুলিশ খুঁজে পায়নি। উল্লেখ্য যে, এই দুই মেয়রই বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ইতোপূর্বে ঢাকায় বিএনপি’র সব সিনিয়র নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এরা হলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম. কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ অনেক সিনিয়র নেতা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে সাবেক মন্ত্রী এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মীর নাছির উদ্দিনকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সমস্ত সিনিয়র নেতা কারাগারে। জাতীয় পার্টির এরশাদও কারাগারে না হলেও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নজরবন্দী। গত শুক্রবার বেলা ৩টায় একুশে টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, বিএনপি’র স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার লে. জে. মাহবুবুর রহমান বলেছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া নজরবন্দী না হলেও অবরুদ্ধ রয়েছেন। তিনি নিজে সেখানে গিয়ে দেখে এসেছেন যে, বেগম জিয়াকে তার দল, আত্মীয়-স্বজন এবং দেশবাসী থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করে রাখা হয়েছে। মাহবুবুর রহমান বলেছেন যে, বেগম জিয়ার কাছে কেউ যেতেও পারছে না, আসতেও পারছে না। যাওয়া আসার চেষ্টা করলেই তাকে সাথে সাথে পাকড়াও করা হচ্ছে।
সারা দেশে চলছে গ্রেফতার অভিযান, প্রথমে ছিল ঢাকা মহানগরী। তার পর ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত বড় শহরে। এখন প্রতিটি জেলা সদর, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ লেভেলেও গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছে। এর সাথে যৌথ বাহিনী নাম দিয়ে যে অভিযান চালানো হচ্ছে সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে পাকবাহিনীর মতো নৃশংস ও “পোড়া মাটি নীতি” অবলম্বনের শামিল হচ্ছে। বিরোধী দলের অনেক নেতার বাড়ি ঘর যৌথবাহিনী গুঁড়িয়ে  দিচ্ছে। যুবক পুরুষ দেখলেই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে, সাতক্ষীরা হয়েছে এক বধ্যভূমি। “প্রথম আলো” সহ একাধিক পত্রিকার রিপোর্ট যে, সাম্প্রতিক হরতাল ও অবরোধে শুধুমাত্র সাতক্ষীরাতেই নিহত হয়েছেন ৪২ জন আদম সন্তান। সারা বাংলাদেশে গত ফেব্রুয়ারী থেকে এ পর্যন্ত চলে আসা আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৪শ’ আদম সন্তান। অন্য পত্রিকার কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী আসন্ন নির্বাচনের তফশীল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন ১২০ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৪জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। প্রথম আলোর মতে বাংলাদেশ হাঠাৎ পরিণত হয়েছে মৃত্যু উপত্যকায়। রানা প্লাজায় ধস এবং তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ে নিহতদের হিসাবে আনলে গত এক বছরে বাংলাদেশে প্রাণহানি ঘটেছে ২৪৪৬ জনের।
বাংলাদেশে অনেক জিনিসের দামই খুব মহার্ঘ। এখন দেখা যাচ্ছে সস্তা হয়েছে মানুষের প্রাণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, যার টাকা পয়সা নাই বা মামুর জোর নাই এমন ব্যক্তি নিহত হলে থানাও সেই কেস নিতে চাই না।
এমন পরিস্থিতিতে দেশ বাঁচাতে হলে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে, বেগম জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ২৯শে ডিসেম্বরের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ ছাড়া আর কোন উপায় নাই। এর পাশাপাশি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যে, কোন উস্কানিদাতা দালাল যেন এই আন্দোলনের মাঝে ঢুকে না পড়ে এবং আন্দোলনকে স্যাবোটাজ করে বা নস্যাৎ না করে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads