শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

ভোটারবিহীন নির্বাচনের তামাশা


নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি। এক দিকে বিরোধী দলের হরতাল আর অবরোধ অন্য দিকে সরকারের পুলিশ বাহিনীর গুলি আর ধরপাকড়। এ পরিস্থিতিতে জনমনে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন দেশে ১৮ দলীয় জোটের ৭১ ঘণ্টার অবরোধ চলছে। অবরোধের প্রথম দিনেই আটটি তাজা প্রাণ চলে গেল না ফেরার দেশে। পুরো সময়টায় এ ধারা অব্যাহত ছিল। শেষ দিনটিতেও মারা যায় অন্তত সাতজন। সাধারণ মানুষ আজ পথহারা পথিকের মতো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় যাবে আর কোথায় বা গেলে পাবে মুক্তি সে চিন্তায় প্রত্যেকটি মানুষ আগামী দিনের সুন্দর বাংলাদেশের অপোর প্রহর গুনছে।
১৯৮৬ সালের ৭ মে তারিখে এরশাদও জাতিকে একটি নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন। সে নির্বাচন জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য সব দল বর্জন করার ব্যাপারে একমত পোষণ করতে সম হয়েছিল বিধায় সব বিরোধী দল ১৯ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেয়। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে আওয়ামী লীগ ২১ এপ্রিল ঘোষণা করে, তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। আওয়ামী লীগ সেদিন দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সাথে বেঈমানি করে স্বৈরশাসক এরশাদের মতাকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার সে সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ নিয়ে তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীলসমাজও বিস্মিত হয়েছিল। 
১৯৮৬ সালের মে মাসের সংসদ নির্বাচন দেখতে এসেছিল একটি ব্রিটিশ পর্যবেক দল। সে নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, জাল ভোট দেয়া, ব্যালট বাক্স চুরিসহ নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ করে পর্যবেক দলটি। স্বৈরাচার এরশাদকে পযবেক দল যখন এসব অভিযোগের প্রেেিত প্রশ্ন করে, প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ বলেছিলেন ২৩ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৮২টিতে ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে-তার মানে এই নয় যে, ব্যাপক কারচুপি বা সহিংসতা ঘটেছে।
১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করে স্বৈরশাসকের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী ভাবছিলেন বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে আসছে না সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন আওয়ামী লীগই পাবে। কিন্তু জনগণ আওয়ামী লীগকে লাল কার্ড দেখিয়েছিল। যার ফলে আওয়ামী-লীগ এক-তৃতীয়াংশ আসনও পায়নি। সে নির্বাচনে পরাজয়ের ইতিহাস আজকের তরুণ প্রজন্মরা মনে না করলেও খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রতি সেকেন্ডে তা অনুভব করেন বলেই এরশাদ মার্কা নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি ভোট চুরির অভিযোগ তুলেছিলেন। সে কারণে তিনি সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু তিনি তার কথায় অটল থাকতে পারেননি। অবশেষে অজ্ঞাত কারণে তিনি সদলবলে সংসদে প্রবেশ করেছিলেন। অনেকেই তখন বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ নেত্রীর এই নাটকীয় মত কেউ বুঝতে না পারলেও এরশাদ বুঝতে পারেন। সত্যিই হাসিনার কথা ১৬ কোটি মানুষ বিশ্বাস না করলেও এরশাদ বিশ্বাস করবে। এরশাদ আর হাসিনা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এরশাদ সকালে যা বলেন বিকেলে তা ভুলেন, আবার বিকেলে যা বলেন রাতের ঘুমে তা ভুলেন আর সে জন্যই এরশাদকে কাজী জাফর বিশ্বাসঘাতক উপাধি দিয়েছেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের আগ পযর্ন্ত প্রত্যেকটি নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে নির্বাচন কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন। কখনো তিনি বলেছেন সূ¥ কারচুপি, কখনো মিডিয়া ক্যু, কখনো ভোট ডাকাতির অভিযোগ করেছেন।
১৯৮৬ সাল আর ২০১৩ কে সমানভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ সে যুগের মানুষ আর আজকের মানুষের মধ্যে দিন রাত ব্যবধান। দেশে বিরোধী দলবিহীন একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ডেকে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি বিগত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের ফলাফল দেখি তাহলে দেখতে পাব যে, ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন ছাড়া আগের তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে প্রায় সমানসংখ্যাক ভোট পেয়েও সংসদে বেশি আসন লাভের ফলে দল দুটি পর্যায়ক্রমে সরকার গঠন করেছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোটের ব্যবধান ছিল যথাক্রমে (৩০.৮১ ও ৩০.০৮ ভাগ) প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান তিন লাখের কম হলেও জয়ী হওয়া আসনের ব্যবধান ছিল ৫২টি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দুই দলের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল (আওয়ামী-লীগ ৩৭.৪৪ ও বিএনপি ৩৩.৬০) যার বিপরীতে প্রাপ্ত আসনের ব্যবধান ছিল ৩০টি। ২০০১ সালের দুই দলের ভোটের ব্যবধান ছিল (বিএনপি ৮০.৯৭ ভাগ ও আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ ভাগ), যা প্রাপ্ত আসনের ব্যবধান ছিল ১৩১টি। ২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। আর বিএনপি ২৯টি আসনে জয়ী হয়েছিল। তাদের ভোটের ব্যবধান ছিল (৪৮.০৬ ভাগ ও ৩২.২৪ ভাগ)। নির্বাচনে দুই বড় দলের ভোটের ব্যবধান আকাশ জমিন নয়। কম বেশি হলেও দুই দলের সমানসংখ্যক সমর্থক রয়েছে, যা মাঝে মধ্যে শেয়ারবাজারের মতো ওঠানামা করে। সুতরাং এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট সাজানো নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করলে সে নির্বাচন কোনো দিনই গ্রহণযোগ্য হবে না। স্বৈরাচার এরশাদের মতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিপ্রেেিত শেখ হাসিনা যেভাবে ফিল্মি স্টাইলে সহযোগিতা প্রদান করেছিল, আজকের বাংলাদেশের সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিপ্রেেিত বিশ্বাসঘাতক এরশাদ ঠিক একই কাজ করেছেন হাসিনার প।ে কী বিচিত্র এ দেশ!
আমরা ল করেছি, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও সরকার পরির্বতনের প্রতিটি আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত মতামতকে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুরুত্ব দিত। কিন্তু আজকে আমরা দেখছি তার উল্টো। প্রিন্ট মিডিয়া আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আচরণ দেখে জাতি আজ হতাশার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। এক দিকে সরকারের
নিপীড়ন জেল জুলুম ধরপাকড় অন্য দিকে মিডিয়ার চাটুকারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে
তা দেখে মনে হচ্ছে ওই সব প্রিন্ট মিডিয়া আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার,
যা সচেতন প্রতিটি নাগরিককে ভাবিয়ে
তুলছে।
বাংলাদেশের জনগণ আর লাশের মিছিল দেখতে চায় না। হরতাল আর অবরোধ দিলেই পুলিশের বুলেট কেড়ে নিচ্ছে কতকগুলো তাজা নিরীহ প্রাণ। সরকার এক দিকে সমঝোতার নামে বিরোধী দলের সাথে মশকারা করছে, অন্য দিকে বিরোধী দলকে নিঃশেষ করার প্রয়াসেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করে রিমান্ডের নতুন রাজনীতি শুরু করছে। বিরোধী দলের আপসহীন নেত্রীই ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদকে মতা থেকে নামিয়ে গণতন্ত্রের শুভ সূচনা করেছিলেন। সরকারকে বিনয়ের সাথে বলব, চিরদিন চৈত্র বৈশাখ মাস থাকে না, মাঘ ফাল্গুন মাসও বছর ঘুরে আসে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads