বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ ব্যর্থ করতে নতুন কৌশল


পাঁচ দফায় প্রায় মাসব্যাপী সফল অবরোধের পর ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বা গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রা নামে নতুন একটি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন তখন ধারণা করা হয়েছিল, সরকার নিশ্চয়ই ফ্যাসিস্ট তথা নিপীড়নমূলক কর্মকা- বন্ধ করে গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসবে। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটানো হয়েছে। এ ব্যাপারেও যথারীতি নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। গতকাল ভাঙ্গা ও ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত কয়েকটি স্থানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী জনসভায় বিরোধী দলের বিরুদ্ধে তিনি শুধু কঠোর ভাষায় বিষোদগারই করেননি, ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকেও এক হাত নিয়েছেন। বলেছেন, বেগম জিয়াই নাকি চলমান আন্দোলনে নিহতদের হত্যা করেছেন। এজন্য তাকে ‘হুকুমের আসামী’ করে ‘বাংলার মাটিতে’ তার বিচার করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন তাহলে হয়তো কথা বাড়াতে হতো না। অন্যদিকে তিনি নিজে বক্তব্য রাখারও অনেক আগে ময়দানে নেমে পড়েছে তার পুলিশ বাহিনী।  দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ হঠাৎ ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন ও গুলশান অফিসের সামনে গ্রেফতারের অভিযান শুরু করেছে। বুধবার রাতে সাবেক ও বর্তমান দু’জন সংসদ সদস্যসহ ১৮ দলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আইনজীবীদের নেতা ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ কয়েকজনকে প্রথমে আটক করে পরে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য অনেককেও হেনস্থা করেছে পুলিশ। বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন ও গুলশান অফিসের চারদিকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকার প্রকৃতপক্ষে বেগম জিয়াকে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। একই সঙ্গে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও নতুন করে রেকর্ড স্থাপন করেছে পুলিশ। ২৪ ডিসেম্বর রাতে বাংলামোটর এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগ এবং একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ডা. শফিকুর রহমানসহ ১৮ দলীয় জোটের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এত বড় নেতারা যে এ ধরনের অপরাধে জড়িত হতে পারেন না সে কথাটা বুঝতে এমনকি সাধারণ মানুষেরও অসুবিধা হচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে, সম্পূর্ণ সাজানো মামলায় নেতাদের আসলে ফাঁসানো হয়েছে। সরকার দেশের অন্য সব অঞ্চলেও নতুন উদ্যমে গ্রেফতারের অভিযান শুরু করেছে। বিএনপি ও জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মীকেই গ্রেফতার করা হয়েছে ও হচ্ছে। যাদের পাওয়া যাচ্ছে না তাদের বাসাবাড়িতে পুলিশ এমনভাবেই তল্লাশি চালাচ্ছে যাতে আতংক ছড়িয়ে পড়ে, যাতে নেতা-কর্মীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং কেউ যাতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধার কারণ হতে না পারেন।
আমরা সরকারের এসব নিপীড়নমূলক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে ভ-ুল করার এবং বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একদলীয় নির্বাচন করার অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই নতুন পর্যায়ে দমন-নির্যাতনের ফ্যাসিস্ট পথে পা বাড়িয়েছে সরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটা অবশ্য মোটেও নতুন কোনো পদক্ষেপ নয়। কারণ, এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধী দলের ওপর রীতিমতো যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তারা। বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ তো বটেই, মানব বন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও পালন করতে দেয়নি সরকার। এখনও যে দিচ্ছে না তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিতভাবেই। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গু-া-সন্ত্রাসীরাও মিছিল-সমাবেশের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এই হামলা চালানো হচ্ছে দেশজুড়েই। পাল্ল¬¬া দিয়ে চলছে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করার অভিযান। অনেকে গুম ও গুপ্তহত্যারও শিকার হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন। এভাবে সবদিক থেকেই সরকার ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। সরকারের ফ্যাসিস্ট সে নীতিরই সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে বানচাল করার লক্ষ্যে শুরু হওয়া দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার মধ্য দিয়ে।
ঘটনাপ্রবাহে একদলীয় বাকশাল শাসনের কথাও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার পথই ধরেছেন। ৫ জানুয়ারি কোনোভাবে সংসদ নির্বাচন করতে পারলেই প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটাবেন প্রধানমন্ত্রী। পিতা শেখ মুজিবের মতো তিনিও সব দলকে নিষিদ্ধ করে সর্বময় ক্ষমতা নেবেন নিজের হাতে। প্রতিষ্ঠা করবেন একদলীয় শাসন। বিরোধী কোনো দলকেই থাকতে দেবেন না তিনি। এমন অনুমানকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে,  বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে লক্ষ্যেই চাচ্ছেন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসতে। একই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে তিনি একের পর এক গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এভাবেই শেখ হাসিনা জাতিকে নতুন চেহারার বাকশাল দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা অবশ্য মনে করি, সবকিছই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। দেশ এখন আর ১৯৭৪-৭৫ সালের পর্যায়ে নেই। তাছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে দেশে এখন অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। সুতরাং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা উল্টো ফলেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়া বলে রেখেছেন, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’কে বাধাগ্রস্ত বা নস্যাৎ করার চেষ্টা করলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আমরা মনে করি, নতুন করে দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও মামলার পথে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী যত তাড়াতাড়ি বেগম খালেদা জিয়ার হুঁশিয়ারির মর্মার্থ অনুধাবন করবেন ততই তার নিজের ও সরকারের জন্য মঙ্গল। আমরা আরো আশা করতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসবেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করার পাশাপাশি দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলাসহ নিপীড়নমূলক কর্মকা-ের আশু অবসান ঘটাবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads