শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র ও সঙ্কট উত্তরণের উপায়


গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র এখন বাংলাদেশের আলোচনার একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আমল হিসেবে পরিচিত নির্বাচিত সরকারের সময়ে এখন যা হচ্ছে তা সামরিক স্বৈরাচারকে লজ্জিত করছে বলে মন্তব্য করছেন অনেকেই। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক যুগের নতুন করে সূচনা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে অবশ্য ২০০৭ সালের পর দুই বছর এতে ব্যত্যয় ঘটে। ধারণা করা হয়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে। যদিও এ নির্বাচনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মোটা দাগের জাল-জ্বালিয়াতির নানা প্রমাণ এখন বের হতে শুরু করেছে। এর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তেমন একটা প্রশ্ন উত্থাপন করেনি বিগত নির্বাচন নিয়ে। 

তবুও এই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর যে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সে ব্যবস্থাকে তুলে দিয়েছে শাসনতন্ত্র থেকে। এরপর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য বিরোধী মত দমন থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষ নির্মূল এবং রাজনৈতিক কারণে খুন-গুম পর্যন্ত স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দেশ চালাতে যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করে, তা নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতান্ত্রিক শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জনগণের মতামত অনুসারে সরকার গঠিত হয়। আর সরকার জনগণের মতামত গ্রহণ করে নির্বাচনের মাধ্যমে। কোনো দেশের নির্বাচন যদি অবাধ, মুক্ত ও প্রতিনিধিত্বশীল না হয়, তা হলে সে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। আবার যথার্থ জনমতের প্রতিফলন ঘটার মাধ্যমে কোনো সরকার ক্ষমতায় এলেই সে সরকার গণতান্ত্রিক হবে এমনটি সব সময় হয় না। বিশ্বে সর্বাত্মকবাদী শাসনের প্রতিভূ এডলপ হিটলার ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। এরপর তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বকে পদানত করতে চেয়েছেন। তার এ কামনা জার্মান জাতিকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ বিপর্যয়ের রেশ কাটাতে জার্মানদের বহু দশক পার করতে হয়েছে। 

হিটলারের মতো উদাহরণ আরো বহু রয়েছে নির্বাচিত স্বৈরাচারের। গণতন্ত্রের সাথে স্বৈরশাসনের সম্পর্কটা হলো বিপরীতমুখী। এই দুইয়ের মূল পার্থক্য রয়েছে ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রশ্নে। গণতন্ত্রে একটি দেশ জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে শাসিত হয়, যেখানে শাসিতরা স্বাধীনতা লাভ করে এবং আইনের সম ব্যবহার পায়। অন্য দিকে স্বৈরাচার মানে হলো এক ব্যক্তির শাসন। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেলে সেখানে জনগণের স্বাধীনতা বা আইনের সম ব্যবহার আর থাকে না। গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন বলে এর ইতিবাচক আবেদনের কারণে স্বৈরশাসকেরাও জনগণের শাসনের কথাই বলে। জনগণের গণতন্ত্র বা সর্বহারার গণতন্ত্রÑ সর্বাত্মক ধরনের শাসনকেও এ ধরনের নানা গণতান্ত্রিক নামে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়। গণতন্ত্রের মতোই বিপ্লব মুক্তিযুদ্ধÑ এসব জনপ্রিয় শব্দকেও বিভিন্ন দেশের শাসকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে চালানোর চেষ্টা হয়েছে এখানে। এখন দেশের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের মাধ্যমে ভিন্নভাবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার নাম দেয়া হচ্ছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এভাবে কৌশলগত শব্দ প্রয়োগ করে স্বেচ্ছাচারী শাসন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য আড়াল করার প্রচেষ্টা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে।

বাংলাদেশে এখন যে রাজনৈতিক সঙ্কট ও হানাহানি চলছে তার একটি পদ্ধতিগত সমাধান বের করা সম্ভব না হলে এ সঙ্ঘাত সংঘর্ষের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না। ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, দলে দলে নির্মূলের যে প্রতিহিংসা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা চললে বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্র ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থনীতি হয়ে যাবে স্থায়ীভাবে পঙ্গু। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু পদ্ধতিগত সংস্কারের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। 

প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাধারণ যে মিল রয়েছে সেটিকে ভিত্তি করে কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করে সেটিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে প্রতিষ্ঠিত করা। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘোষণায় যে তিনটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে সেটিকে ভিত্তি ধরা যেতে পারে। এ তিন মূল বিষয় হলো গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ। এ বিষয়ে কোনো দলের বিরোধ বা আপত্তি নেই। 

দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র বলতে যে জনগণের শাসন বোঝায় সেটিরও বিভিন্ন ধরন রয়েছে। বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষ এবং বিদ্যমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় এনে এককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে ফেডারেল ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। এখানে পাঁচটি বা সাতটি প্রদেশ হতে পারে। প্রতিটি প্রদেশে থাকবে পৃথক রাজ্যসভা ও সরকার। এতে এক দিকে সব সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার এখন যে রাজধানী কেন্দ্রিকতা রয়েছে, তার অবসান ঘটবে। অন্য দিকে ক্ষমতার মিশ্র মেরুকরণতা সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ বড় কোনো দল জাতীয়পর্যায়ে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও আঞ্চলিক পর্যায়ে সরকার গঠন তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এতে কোনো বড় দলের জন্য একেবারে ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার কোনো ঝুঁকি থাকবে না। জনগণ একটি দলকে কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতায় না পাঠিয়ে সে দলকে প্রদেশিকপর্যায়ে ক্ষমতায় পাঠিয়ে পরীক্ষার সুযোগ পাবে। প্রতিবেশী ভারতে এখন কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় থাকলেও বেশির ভাগ রাজ্যে রয়েছে অ-কংগ্রেসি সরকার। ফলে এক ধরনের ভারসাম্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই ধরনের উদাহরণ মালয়েশিয়া বা পাকিস্তানের ব্যাপারেও দেয়া যায়। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতায় রয়েছে বারিসান ন্যাশনাল আর তিন বড় রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে বিরোধী পিপলস ফ্রন্ট। পাকিস্তানে কেন্দ্রে ক্ষমতায় রয়েছে নেওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ। আর পাঞ্জাবে মুসলিম লিগ ক্ষমতায় গেলেও সিন্ধুতে ক্ষমতায় রয়েছে বিরোধী দল পিপিপি, খায়বার পাখতুন খোয়ায় ইমরানের পিটিআই। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা চালু হলে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সরকার হলেও একাধিক প্রদেশে বিএনপির অথবা কেন্দ্রে বিএনপির সরকার হলেও একাধিক প্রদেশে আওয়ামী লীগের সরকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে। কোনো কোনো প্রদেশে জাতীয় পার্টি, জামায়াত বা বাম দলগুলোও সরকার গঠন করতে পারে। এতে সরকার উৎখাতের জন্য যে রাজনৈতিক আন্দোলন ও হানাহানি এখন চলছে, তার অবসান ঘটতে পারে। 

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা হলো জনগণের রায়ের সাথে চূড়ান্ত ফলাফলের আনুপাতিক অসামঞ্জস্যতা। কোনো দল ৪০ বা ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮০ বা ৮৫ শতাংশ আসনে জয়ী হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো সময় বেশি ভোট বা সমানসংখ্যক ভোট পেয়েও বিরোধী দলে বসার দৃষ্টান্তও এখানে রয়েছে। এ ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিফলন হয় এমন একটা নির্বাচনব্যবস্থায় যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন এ সময়ে। এ জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আদলে দলভিত্তিক আনুপাতিক নির্বাচনে যাওয়া যেতে পারে। যেখানে দল তার আদর্শ ও প্রার্থী তালিকা এবং তাদের প্রতিনিধিত্বশীল এলাকা ঘোষণা করবে। আর দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হবে। দলটি যে এলাকায় বেশি ভোট পাবে সে এলাকার জন্য মনোনীত সংসদ সদস্যকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। দ্বিতীয় বিকল্প হতে পারে নেপালের মতো। নেপালে গণপরিষদ নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশের মতো আসনে সরাসরি ভোটের ভিত্তিতে জয়ীরা এমপি হয়েছেন। বাকি দু-তৃতীয়াংশ আসনে দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় কোনো দল একবার ক্ষমতায় যাওয়ার পর মাত্রা ছাড়ানো স্বৈরাচারী হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। 

তৃতীয়ত, নেতৃত্বের বিকাশ ও স্বৈরাচারীপ্রবণতা রোধের জন্য একজন নেতার পরপর পাঁচ বছর মেয়াদে একবারের বেশি অথবা চার বছর মেয়াদের হলে দুইবারের বেশি ফেডারেল প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী না হওয়ার বিধান রাখা। মাঝখানে বিরতি দিয়ে আবার তিনি দায়িত্ব নিতে পারবেন। তবে কোনো ক্রমেই একজন ব্যক্তি তিনবারের বেশি এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত না হওয়ার বিধান থাকবে; অর্থাৎ ১২ বা ১৫ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কেউ পালন করতে পারবেন না। 

চতুর্থত, সংসদের একটি উচ্চকক্ষ থাকবে, যেটার গঠন ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো হতে পারে। তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর উচ্চ পরিষদের পদাধিকার বলে সদস্য থাকার বিধান থাকবে। 

উপরোল্লিখিত ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখন যে হানাহানি চলছে, তা অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারবে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে প্রশ্ন আসতে পারে এ ব্যবস্থা কী করে সাংবিধানিক অবয়বের অংশ করা সম্ভব হবে? এটি দুই ভাবে করা যেতে পারে। প্রথমত, বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তাতে ছয় মাসের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে যে সরকার রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে এসব সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছবে। এরপর যে দলই পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাক না কেন, এর আলোকে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে সমঝোতা হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ নির্বাচন করা যে গণপরিষদ ন্যূনতম এক বছর সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করে তার আলোকে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করবে। 

উপরোল্লিখিত প্রস্তাবগুলো আগে থেকে চূড়ান্ত না হলেও এর আলোকে দেশকে চলমান সঙ্কট থেকে মুক্ত করার উপায় বের করা সম্ভ^ব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের অগ্রসর হওয়া খুবই কঠিন। এখনকার সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক সংহতি বিপর্যয়কর খাদের কিনারায় এসে উপনীত হয়েছে। চার হাজার কোটি টাকার পোশাকের ক্রয়াদেশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে চলে গেছে। পোলট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি। একই অবস্থা অন্যান্য শিল্পেরও। এ অবস্থা কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না। আমাদের উত্তরণের একটি পথ বের করতেই হবে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads