সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

দিদি তুমি কেন এসেছিলে?


ইকতেদার আহমেদ

জাতিসঙ্ঘ সদস্যভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্র একে অপরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বিশ্বাসী হলেও এটি ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্ব পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির ক্ষেত্রে সত্য নয়। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের (Cold war) অবসান পরবর্তী এখন বিশ্ব পরাশক্তি বলতে শুধু মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রকে বোঝালেও অচিরেই যে রাশিয়া ও চীন আবার বিশ্ব পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে চলে আসবে, ঘটনাপ্রবাহ অবলোকনে বিশেষত সাম্প্রতিক সিরিয়া ও ইরান পরিস্থিতি থেকে সে রকমই আভাস পাওয়া যায়।
আমাদের উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারত ভূখণ্ডের দিক থেকে যেমন বড় ঠিক তেমনই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অন্যান্য দেশের চেয়ে শক্তিশালী। ভারত বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সাথে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করলে তা উপমহাদেশটির স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সহায়ক হতো। বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কাছ থেকে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো বন্ধুত্ব ও স্নেহশীল আচরণ প্রত্যাশা করে।
বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বড় ভাই ও বড় বোনকে দাদা ও দিদি নামে সম্বোধন করে থাকে। তবে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন পিতৃব্য অর্থাৎ পিতার বাবাকে দাদা বলে অভিহিত করে থাকে। তবে উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে দাদা ও দিদি বয়োজ্যেষ্ঠ বিবেচনায় ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র এবং এর বিনিময়ে কনিষ্ঠরা তাদের কাছ থেকে স্নেœ, মমতা ও আদর প্রত্যাশা করে থাকে। বাংলাদেশ ভারতের বাহুতলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বিধায় বাংলাদেশ সব সময় ভারতের কাছ থেকে সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা প্রত্যাশা করে যেমন ছোট ভাই-বোনেরা দিদির কাছ থেকে প্রত্যাশা করে থাকে।
বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূখণ্ডগত অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়াÑ এ তিনটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশ্ব রাজনীতিতে অপরিসীম। যেকোনো বৃহৎ বা আঞ্চলিক পরাশক্তি এ তিনটি অঞ্চলের ওপর তার রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক প্রভাব অক্ষুণ রাখতে চাইলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এমন রাষ্ট্রে বন্ধুসুলভ সরকারের আবশ্যকতার ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। এ গুরুত্বের কারণেই বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন দল জয়ী হলে বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরাশক্তির স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে এর হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত, বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উদীয়মান বিশ্ব পরাশক্তি চীন। এর বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলো, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো ও রাশিয়ার আলাদা হিসাব-নিকাশ রয়েছে।
রফতানির দিক থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অংশীদার। অপর দিকে বাংলাদেশ ভারত ও চীন থেকে সর্বাধিক পরিমাণ পণ্য আমদানি করে থাকে। ভারত থেকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে থাকে এর প্রায় সমপরিমাণ পণ্য চোরাইপথে বাংলাদেশে ঢুকে। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পর্যটক হিসেবে স্থল ও আকাশপথে বিপুলসংখ্যক ভ্রমণপিপাসু লোক ভারতে গিয়ে চিকিৎসা ও কেনাকাটা বাবদ যে অর্থ ব্যয় করে থাকে তা সেখানকার বেসরকারি হাসপাতাল, হোটেল ও বিপণিবিতানগুলোকে সচল করে রেখেছে।
গণতন্ত্রঅর্থ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দল কর্তৃক সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা। এ উপমহাদেশ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভকালীন এ অঞ্চলের লোকজনের ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রে একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে না পারায় তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অবদমিত করে রাখায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রটির পূর্ব অংশ স্বাধীনতা-পরবর্তী রজতজয়ন্তী পালনের আগেই স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আভির্ভূত হয়। এ কথাটি ঠিক যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের অবদান ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী অদ্যাবধি ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে আসছে এবং সেখানে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হয়েছে এমন গুরুতর অভিযোগ কখনো উত্থাপিত হয়নি। ভারতের কংগ্রেস সরকারকে সব সময় আমাদের আওয়ামী লীগের মিত্র ভাবা হয়। ভারতের মতো আমাদের এখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ায় এবং বড় দুটি রাজনৈতিক দলের একাটির প্রতি অপরটির আস্থা না থাকায় নির্বাচন-পূর্ববর্তী কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ বিতর্কটির চিরস্থায়ীভাবে সুরাহার পথ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের বিতর্ক অবসানের প্রয়াস নেয়া হয়েছিল কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পুরনো বিতর্ক আবার নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। আগে যখন এ বিতর্কটি দেখা দিয়েছিল তখন বিদেশীদের একাধিক উদ্যোগ বিফল হয়েছিল। বর্তমানেও বিদেশীদের একাধিক উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভারতের পররাষ্ট্র সচিব দিদি সুজাতা সিং এবং জাতিসঙ্ঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগ।
দিদি সুজাতা সিং গত ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে একদিনের ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সুশীলসমাজের সাথে মতবিনিময় করেন। দু-একটি সূত্র থেকে দাবি করা হয়েছে দিদি সেনা প্রধানের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন কিন্তু এর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দিদি সুজাতা সিং সুশীলসমাজ ও সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সাথে মতবিনিময়কালে কী আলোচনা করেছেন তা জানা যায়নি। তবে জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদের সাথে আলাপকালে তাকে বোঝানের চেষ্টা করা হয়েছে যে, তিনি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে এ দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা ক্ষমতাসীন হবে যা উপমহাদেশের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করবে। দিদি সুজাতা সিং উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ বলতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দলটিকে বুঝিয়েছেন এবং এদের সহযোগী হিসেবে বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। দিদি সুজাতা সিং যখন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর দলভুক্ত জোট বিএনপির ক্ষমতাসীন হওয়াকে উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন ঠিক তখন দেখা গেল ২০১৪-এর প্রথমার্ধে ভারতে যে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এর প্রাক্-নির্বাচনী মহড়া হিসেবে বিবেচিত পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের চারটিতে আমাদের বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর অনুরূপ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিজেপির কাছে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে।
দিদি সুজাতা সিং সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের কথা না বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অংশগ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এতে তার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট প্রতিভাত আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও এর জোটভুক্ত দলগুলো অংশগ্রহণ করুক ভারতের ক্ষমতাসীন বর্তমান কংগ্রেস তা চায় না।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিজ অবস্থানে অনড় না থাকার ব্যাপারে অনেকে দুর্বল চিত্তের রাজনীতিক হিসেবে আখ্যা দিলেও দিদি সুজাতা সিংয়ের সাথে বৈঠক-পরবর্তী তিনি যে সাহসের সাথে সত্য কথাটি বলে দিলেন তাতে প্রতীয়মান হয় তার ওপর আরোপিত অপবাদ কিছুটা হলেও তিনি দূর করতে সমর্থ হয়েছেন।
উপমহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক থাকলেও ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের প্রতি উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন নেতিবাচক। শ্রীলঙ্কা এ উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ছিল। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও ছিল অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয়। কিন্তু ভারত শ্রীলঙ্কার এ সাফল্যকে ভালোভাবে দেখেনি। ভারতের মদদেই শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটিয়ে সে দেশের অর্থনীতিকে এক দিকে বিপর্যস্ত এবং অপর দিকে রাজনৈতিক বিভাজনের মাধ্যমে রাষ্ট্রটিকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। নেপালের রাজা বীরেন্দ্র যখন নিজ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন তখন একটি মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনার মাধ্যমে সপরিবারে রাজা বীরেন্দ্র নিহত হলেন। তার নিহত হওয়ার ঘটনাটি এখনো রহস্যাবৃত্ত। এ ঘটনার পেছনের চাবিকাঠি কার হাতে ছিল সে বিষয়ে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের তর্জনি ভারতের দিকে প্রসারিত। পাকিস্তান ভারতের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হলে এ দেশটি অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ হতো। পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার ব্যাপারে ভারত সব সময় তৎপর ছিল এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যের হাত প্রশস্ত করেছিল। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী প্রতিটি সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অগ্রগামী। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনেতিক উন্নয়ন আজ বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল। বাংলাদেশে যখন স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে সাফল্য প্রায় শতভাগ তখন পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের বাংলা, বিহার, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলের ট্রেনযাত্রীরা প্রত্যুষে ট্রেন লাইনের দুপাশে তাকালে দেখতে পান শত শত আবালবৃদ্ধবণিতা পশ্চাৎদিক প্রদর্শনপূর্বক প্রকৃতির ডাকে সাড়া প্রদানে ব্যস্ত।
ভারতের বর্তমান বিজেপি আরএসএস ও জনসঙ্ঘের ধর্মীয় মতাদর্শে রাজনৈতিকভাবে দীক্ষিত। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়া কোনোভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তাচেনতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভারত রাষ্ট্রটি সৃষ্টির অব্যবহিত পর শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অহিংস নেতাদের অন্যতম ভারত রাষ্ট্রের স্থপতি মহাত্মা গান্ধী সহিংস আরএসএসের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। এটা অনেকটা নিশ্চিত ভারতের আগামী লোকসভা নির্বাচনে গুজরাটের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হবে। এ নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজরাটে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল তাতে অনেক মুসলিম নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশু জীবন্ত দগ্ধ হওয়াসহ অসংখ্য মুসলিম প্রাণ হারিয়েছিল। এ কলঙ্কের তিলক যে মুখ্যমন্ত্রীর কপালে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নরহত্যার অভিযোগে ভিসা প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কিন্তু অমোঘ সত্য নরেন্দ্র মোদীই হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
আরএসএস ও জনসঙ্ঘের সমর্থনপুষ্ট বিজেপির নেতৃত্বেই আজ থেকে ২০ বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশে মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগে মুসলমানদের নামাজ আদায়ের স্থান পবিত্র বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
আমাদের দেশে দিদি সুজাতা সিংয়ের ভাষ্য মতে যখন জামায়াতে ইসলামী ও এর জোটভুক্ত বিএনপি উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ হিসেবে চিহ্নিত ঠিক এর তিন দশক আগে শিখদের আন্দোলন অবদমিত করার জন্য ভারতের অমৃতস্বরের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালিয়ে জার্নাল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেসহ শত শত শিখকে মন্দিরের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এর জের ধরে শিখ দেহরক্ষী কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী খুন হওয়ার পর খুনি দেহরক্ষীর পিতা সুচা সিং ও স্ত্রী বিমলা কাউরের লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিরোধী শক্তি দাবিদার ভারতীয় কংগ্রেস কি ঠেকাতে পেরেছিল?
গণতন্ত্রকে সামনে রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হলেও ভারতের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী পাকিস্তানের আটাকাবস্থা থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্ত না-ও হতে পারেন। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যেন মুজিব বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সে অভিপ্রায়ে মুক্তি বাহিনীর বিকল্প হিসেবে ভারত কর্তৃক মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। অতঃপর বঙ্গবন্ধু এ দেশে প্রত্যাবর্তন করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনে যখন সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখন ভারত জাসদ ও গণবাহিনী সৃষ্টির মদদ দিয়ে তার সরকারের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস মৃত্যুকালীন ভারতের সাথে আমাদের ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি ছিল কিন্তু এহেন বিয়োগান্তক দুঃখজনক ঘটনায় ভারত শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভারতের অসন্তুষ্টির মূল কারণ তিনি কেন স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অনুসরণ করছেন এবং ভারতীয় প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান করলেন ও ভাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হলেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে ভারত এখনকার মতো বরাবরই সক্রিয়। ভারত সব সময় চায় এ দেশে যে দল ক্ষমতাসীন থাকবে তাকে ভারতের প্রতি অনুগত হতে হবে। বাংলাদেশের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ আনুগত্যের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে দেখা যায়, বিশ্বস্ততার মাপকাঠিতে আওয়ামী লীগের স্থান সর্বোচ্চে। তাই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হওয়ার চেয়ে ভারতের কাছে মুখ্য হলো জনমত যা-ই হোক না কেন যেকোনোভাবে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পুনঃক্ষমতায় আনয়ন।
উপমহাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত সিকিমকে ভারতভুক্ত করার সময় দিদি সুজাতা সিংয়ের পিতা ভারতের প্রধামন্ত্রীর উপদেষ্টা ছিলেন। সিকিমের ভারতভুক্তিকে সার্বিক বিবেচনায় মানুষ হিসেবে অতি উত্তম বিবেচিত ভারতের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই অনৈতিক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তা ছাড়া নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় যখনই ভারতের অথনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণের উদ্ভব ঘটেছে তখনই দেখা গেছে জনমতকে উপেক্ষা করে ভারত তার নীতির প্রতি একান্ত অনুগত দলকে ক্ষমতায় রাখতে প্রয়াস নিয়েছে।
ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতা-পরবর্তী আরএসএস, জনসঙ্ঘ ও বিজেপির প্রত্যক্ষ মদদে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে যেভাবে প্রধান ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিধন করা হয়েছে এ ধরনের কোনো নজির বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেই। বাংলাদেশে ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন দু-একটি যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটেছে এর পেছনে সব সময় দেখা গেছে ভারতের অনুগত রাজনৈতিক দল অব্যাহতভাবে ভারতীয় সমর্থন লাভের অপচেষ্টায় এ ধরনের ঘটনা সংঘটনের প্রয়াস নিয়েছে এবং এ প্রয়াসে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির চেয়ে বিএনপি ও এর জোটভুক্ত জামায়াত কখনো অধিকতর কৌশলী এমনটি দেখাতে পারেনি।
দিদি সুজাতা সিং জ্যেষ্ঠ না হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস দলের প্রতি অনুগত বিবেচনায় দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে অতিক্রান্ত করে গত আগস্ট, ২০১৩ তাকে পররাষ্ট্র সচিবের পদে বসানো হয়। পদে আসীন পরবর্তী চার মাসের মাথায় পরিচিতিমূলক সফরের কথা বলে তিনি যেভাবে বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে ঝটিকা সফরে এসে আগামী নির্বাচনে কোন্ দলকে ক্ষমতাসীন করা হবে জনমতের উপেক্ষায় এর কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে গেলেন এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাসীন হওয়াকে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের উত্থান হিসেবে অভিহিত করলেন তা কোনোভাবেই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। তা ছাড়া জনমতের প্রতিফলনে যদি বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হয় সে ক্ষেত্রে ভারত কী কারণে অন্তরায় হিসেবে দাঁড়াবে? আর বিএনপি-জামায়াত জোট যদি উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ হয় সে ক্ষেত্রে আরএএস ও জনসঙ্ঘের সমর্থনপুষ্ট বিজেপি কি উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ নয়? আর বিজেপি উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ হয়ে থাকলে দিদি সুজাতা সিং কি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসীন হওয়া রুদ্ধ করতে পারবেন? নিজ দেশে রুদ্ধ করতে না পারলে তারা নিশ্চয়ই উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ নয়। মৌলবাদের সংজ্ঞা তো নিজ দেশ ও অপর দেশের ক্ষেত্রে ভিন্নতর হওয়ার কথা নয়। তাই বাবরি মসজিদ ভাঙাসহ একাধিক জঘন্য ও হিংস্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মদদদাতা আরএসএস ও জনসঙ্ঘের সমর্থপুষ্ট বিজেপি যদি উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ না হয় তাহলে কী করে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আস্থাভাজন বিএনপি-জামায়াত জোট উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ হয়? আমরা যদি ভারতের সৎপ্রতিবেশী ও কনিষ্ঠ ভ্রাতৃসুলভ হয়ে থাকি তবে দাদা ও দিদিদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা তারা স্নেœহ-মমতা ও ভালোবাসার বন্ধনে আমাদের আগলে রাখবে। কিন্তু আগলে না রেখে জনমতের উপেক্ষায় নিজ হীন স্বার্থ সিদ্ধির অভিপ্রায়ে যদি সাজানো নির্বাচনকে সমর্থন দিয়ে জনআকাক্সাকে পরাভূত করার প্রয়াস নেয় তাকে কি ছোট ভাইবোনের প্রতি দিদিসুলভ আচরণ বলা যায়? আর তাই তুমি কেন এভাবে এসে এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রতিফলনে সরকার গঠনের পরিবর্তে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট দলকে ক্ষমতাসীন করতে উদ্যোগী হয়েছো? দিদি তো সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থাকে। আর আমাদের ক্ষেত্রে তোমার এ অন্যায় আশাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads