রবিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন, আতংকিত নির্বাচন কর্মকর্তারা


গতকালের পর- নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালে বিচারপতি এমএ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সব কমিশনারের বাসায়ই গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১৩ জুন ভোরে ১৪ দল আহূত ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীরা নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমানের মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের বাসায় গুলিবর্ষণ করে। পরদিন ১৪ জুন বিচারপতি এমএ আজিজের মগবাজারের পূর্ব নয়াটোলার বাসায় ককটেল বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ১২ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার স.ম. জাকারিয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজীপাড়ার বাসায় হামলা চালানো হয়। ১৫ নবেম্বর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে নির্বাচন কমিশনার মাহমুদ হাসান মনসুরের মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসায়।
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহ নেওয়াজের বাসভবন ও কমিশন সচিবালয়ের সামনে ককটেল হামলা হয়। এবার হামলার ভয়াবহতা বেড়েছে। দূর থেকে পেট্রোল বোমা ও গুলী চালানোর ঘটনা ঘটছে।
সব জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে সময় ১৫ দিন অতিবাহিত না করেই পুনরায় ১৪ নবেম্বর ২০১৩ সারা দেশের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের জরুরি ভিত্তিতে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ওই চিঠিতে দুই নির্বাচন কমিশনারের বাসা ও অফিসে নিরাপত্তা দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
নির্বাচনের আগে নির্বাচন অফিসগুলোতে হামলা ও অগ্নিকা-ের মতো নাশকতা হলে তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। যদিও সার্ভার ব্যাকআপ ও অতিরিক্ত নির্বাচনী মালামাল কমিশনের হাতে মজুদ রয়েছে। বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট বিভাগের একাধিক উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার বক্তব্য হলো, ‘আমরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। পুলিশ প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছি না।’ (সূত্রঃ দৈনিক আমাদের সময় ১৫ নবেম্বর ২০১৩)
সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনারদের বিরোধ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। শুধু কমিশনাররাই নন, এমনকি ইসি কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে মতদ্বৈধতা। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে কোনো ইস্যুতেই একমত হতে পারছে না পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কমিশনাররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন। দিন দিন এ দূরত্ব আরও বেড়েই চলছে।
১২ নবেম্বর ২০১৩ কমিশনার জাবেদ আলী বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য কমিশন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বললে খুব অসত্য বলা হবে না। বিএনপিসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছি, করছি এবং ভবিষ্যতেও করব। আমরা আশাবাদী, সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হবে।’
কিন্তু পরের দিন  সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কোনো যোগাযোগ নেই। এ বিষয়ে কমিশনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তা ছাড়া আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করা উচিতও নয়। কেউ যদি যোগাযোগ করেন, সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের।
সরকার ২০০৯ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ শব্দটি বাদ দেয়। তারপর এই কমিশন দায়িত্ব নেয়। সিইসিসহ অন্তত তিনজন এরপর নিয়মিত বাহিনীই দায়িত্ব পালন করবে-নিজেদের এই মতের পক্ষে থেকে তারা সর্বশেষ আরপিও সংশোধনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় ‘সশস্ত্র বাহিনী’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেননি।
কিন্তু ৪ নবেম্বর নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, ভোটকেন্দ্রের তুলনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসংখ্যা যথেষ্ট নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য এলিট ফোর্স হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ জানানো হবে।
৬ নবেম্বর একই সুরে সিইসি বললেন, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন ছাড়া এক দিনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।  সেই বিবেচনায় আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হবে।
১৩ নবেম্বর ২০১৩ কমিশনের বৈঠকে এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কমিশনার আবদুল মোবারক। তিনি বলেন, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে কমিশনের বৈঠকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ কমিশন থেকে গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে ইসির কর্মকর্তাদেরও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সম্প্রতি ইসির নাম পরিবর্তন ও পদোন্নতি নিয়ে কর্মকর্তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। আর কমিশন বৈঠকে নিজ নিজ মতামতকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন কমিশনাররা। এতে করে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনেকটাই দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। আর কমিশন সচিবালয়ের কাজকর্মে নেমে আসছে এক ধরনের স্থবিরতা। এ ছাড়া দশম সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও ইসি সচিবালয়ের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনাররা চাচ্ছেন ডিসিদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিতে। অন্যদিকে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা চাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের আঞ্চলিক অফিসার ও জেলা কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয়ের মধ্যে অনেকটাই মৌন দ্বন্দ্ব চলছে। এমনকি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটিও হয়েছে।
সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সংক্রান্ত ইসির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে ইসি কর্মকর্তাদের কথা কাটাকাটি হয়। বৈঠকে একজন নির্বাচন কমিশনার ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করার ঘোষণা দেওয়ায় ইসি কর্মকর্তারা তার পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও রিটানির্ং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হোক। এ নিয়েই শুরু হয় কথা কাটাকাটি। এমন সময় অপর একজন কমিশনার ঘোষণা দেন (বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন ১৯৯৬) ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আদলেই দশম সংসদ নির্বাচন হবে। তাই নির্বাচনের ফলাফল সংগ্রহ করা ইসির কর্মকর্তাদের দিয়ে সম্ভব নয়। এ জন্য ডিসিরাই যোগ্য।
কমিশনারের এমন ঘোষণায় ইসির কর্মকর্তারা বলেন, সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা যদি রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারেন তবে সংসদ নির্বাচনে পারবেন না কেন? তখন কমিশনার বলে উঠেন, সিটি নির্বাচন আর সংসদ নির্বাচন এক নয়। উত্তরে কর্মকর্তারা বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের চেয়েও কঠিন। কেননা এক সিটিতে কয়েকটি সংসদীয় আসন থাকে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও রাখার কথা ছিল। কিন্তু কমিশনাররা তা চাচ্ছেন না। এর আগেও নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠান, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ এ ধরনের একাধিক জরুরি ইস্যুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের দ্বিমত হয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়েও কমিশন একমত হতে পারছে না। এর আগেও মেহেরপুর জেলা নির্বাচন অফিসারকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মারধর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় এবং ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে।
সিইসিসহ কমিশনারদের এসব পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের কারণে কমিশনের সমন্বয়হীনতা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। কমিশনের জাতীয় নির্বাচনের মতো বিপুল কর্মযজ্ঞ সামাল দেওয়ার সামর্থ্য নিয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনা এবং সব দল নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু সে রকম কোনো পরিকল্পনা বা তৎপরতা দৃশ্যমান নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads