বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বান


গত ২ ডিসেম্বর রাতে দেয়া এক বিবৃতিতে ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনরত নেতা-কর্মী ও জনগণের পাশাপাশি সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে যার যার ভূমিকা পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারকে বলেছেন, উৎপীড়ন ও নির্মূল অভিযান এবং চক্রান্ত ও অন্তর্ঘাতের পথ ছেড়ে সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনার পথে এগিয়ে আসার জন্য। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে বলেছেন, বিশেষ দলের ক্রীড়নক হওয়ার পরিবর্তে একতরফা নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল স্থগিত করতে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বলেছেন, দেশপ্রেমিক অবস্থান নিয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে। আর আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, সরকারের গু-া-সন্ত্রাসীরা পৈশাচিক হত্যাকা- ও ধ্বংসাত্মক নানা কর্মকা-ে তৎপর রয়েছে বলেই তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে একজন নিরীহ মানুষও কোনো হামলার শিকার না হয় এবং কোথাও যাতে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পদের ক্ষতি না হয়। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ও জনগণের প্রতি সে আন্দোলনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতির শেষাংশে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, ‘ইনশাআল্লাহ বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত ও অতি নিকটবর্তী।’
আমরা দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর অবস্থান থেকে দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার এই আহ্বানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত মনে করি। কারণ, কোনো একটি প্রসঙ্গেই তিনি যুক্তি ও তথ্য ছাড়া কিছু বলেননি। যেমন সরকারের অপকৌশল ও কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ১৮ দলীয় জোটসহ বিরোধী দলগুলো যখন দেশ এবং দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করছে, তখন মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করার এবং দমন-নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি সরকার নিয়েছে জনগণ এবং আন্তর্জাতিক জনমতকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। তিনি যুক্তি ও ব্যাখ্যাসহ অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের গু-া-সন্ত্রাসীরাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় সুপরিকল্পিতভাবে অগ্নিসংযোগ ও মানুষ হত্যার নৃশংস কর্মকা- চালিয়ে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ দুর্বৃত্তরাই চলন্ত যানবাহনে পেট্রল ঢেলে ও আগুন জ্বালিয়ে পৈশাচিকভাবে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ মানুষ পুড়িয়ে মারছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে নিরাপদে থেকে ক্ষমতাসীন নেতারা সব দোষ চাপাতে চাচ্ছেন আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীদের ওপর। তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বেগম খালেদা জিয়ার কথাগুলোর মধ্যে অনস্বীকার্য যুক্তি রয়েছে। বিশেষ করে চলন্ত যানবাহনে পেট্রল ঢেলে ও দগ্ধ করে মানুষ হত্যার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে তিনি যে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন, তার পেছনে চারদলীয় জোট সরকারের সময় শেরাটন হোটেলের সামনে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার মতো ‘ঐতিহাসিক’ সত্যতা রয়েছে। তাছাড়া দুটি প্রশ্নেরও উত্তর লক্ষ্য করা দরকার। প্রথম প্রশ্নটি হলো, আন্দোলনরত বিরোধী দল কেন এমন নৃশংস কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়বে যার কারণে জনমত তাদের বিপক্ষে চলে যাবে? দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, ক্ষমতাসীনরা পুড়িয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ তুললেও আজও পর্যন্ত কেন বিরোধী দলের একজন কথিত দুর্বৃত্তকেও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়নি বা হচ্ছে না? প্রশ্ন দুটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যথেষ্ট যোগ্য ও সক্ষম। সুযোগ দেয়া হলে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করা তাদের জন্য কয়েক মিনিটের বিষয় হওয়ার কথা। তা সত্ত্বেও একদিকে কোনো একজন প্রকৃত দুর্বৃত্তকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে না এবং অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষ ও বয়সে প্রবীণ নেতাদের বোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অভিযোগে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে বলেই বেগম খালেদা জিয়া প্রশ্ন দুটি না তুলে পারেননি। পর্যালোচনায় কিন্তু তার অভিযোগের সত্যতাই প্রমাণিত হবে। আসলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় গু-া-সন্ত্রাসীদের দিয়ে হত্যার পৈশাচিক অভিযান সরকারই চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বেগম খালেদা জিয়া যথার্থই বলেছেন। ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে এবং জনগণকে নিজেদের পক্ষে টানতে চাচ্ছেন। কিন্তু সুচিন্তিত হলেও ক্ষমতাসীনদের এই ষড়যন্ত্র হালে পানি পায়নি বরং তাদের নোংরা উদ্দেশ্যই ধরা পড়ে গেছে। সাধারণ মানুষও বুঝে ফেলেছে, র‌্যাব পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চোখের সামনে যানবাহনে আগুন আসলে কারা দিচ্ছে এবং কারা মানুষ পুড়িয়ে মারছে।
সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই ক্ষমতাসীনদের উচিত মানুষ হত্যার পৈশাচিক অভিযান বন্ধ করা এবং প্রকৃত দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও উচিত দেশপ্রেমিক অবস্থান নেয়া এবং বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করা। তারা সততার সঙ্গে তৎপর হলেই দুর্বৃত্তরা ধরা পড়বে বলে জনগণ বিশ্বাস করে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকেও প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের কর্তব্য সব দলের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করা, দলবিশেষকে ক্ষমতায় আনার সিঁড়ি নির্মাণ করা নয়। কমিশনের তাই সরকারের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। বরং বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবং প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ঘোষিত তফসিল স্থগিত করে কমিশন এখনো জাতীয় স্বার্থে অবদান রাখতে পারে। সেটাই কমিশনের কর্তব্যও। সরকারের জন্যও এখনো সময় ও সুযোগ রয়েছে। আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল জাতীয় পার্টিও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়ার ফলে সরকারের সামনে সব পথই বন্ধ হয়ে গেছে। ইনু-মেনন ধরনের দু’চারজন মাত্র নিন্দিত ও গণধিকৃত ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কোনো নির্বাচন করলে তার ফলাফল প্রত্যাখ্যাত হবে তাৎক্ষণিকভাবে। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের উচিত জনগণের ভাষা ও পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং সংকীর্ণ রাজনীতির পথে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা ছেড়ে গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসাÑ যার আহ্বান বেগম খালেদা জিয়া জানিয়েছেন। একথাও বুঝতে হবে যে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে নিশ্চিতভাবেই বিজয় অর্জন করবে। সুতরাং বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যার যার অবস্থান থেকে জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা পালন করার মধ্যেই সকলের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তেমন ভূমিকা পালন করাই এখন সকলের দায়িত্ব।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads