বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

কেন এই দুঃসময়?


বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ অভূতপূর্ব সঙ্কটময়। অথচ সঙ্কট উত্তরণের জন্য সরকারের কার্যত মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজ মারাত্মকভাবে বিপন্ন। এ জন্য সরকারকে যদি দায়ী করা হয়, তাহলে অন্যায় হবে না; বরং দায়ী যদি না করা হয় তাহলে বিস্ময়কর হবে।

আজকের কথিত সর্বদলীয় সরকারকে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার বললেও তেমন ভুল হবে না। সরকার জনগণের কোনো চাওয়া-পাওয়ার তোয়াক্কা না করে নিজস্ব ইচ্ছা ও চাওয়া-পাওয়াকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। একটি দলের কাছে জনগণ জিম্মি হয়ে আছে। এ থেকে মুক্তি অবশ্যই কাম্য। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ঘোষণা করেছিলেন, সরকার চারটি আদর্শকে অনুসরণ করবে। ১. জাতীয়তাবাদ ২. গণতন্ত্র ৩. ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ৪. সমাজতন্ত্র। দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো একটি গুরুতর আর্থসামাজিক সঙ্কট থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে যে উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, সেই কাজ ভালোভাবে অনুসরণ করলে অনেক সহজ হতে পারত। আজকের সরকার যে একতরফাভাবে দেশ পরিচালনা করছে, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মুজিবের আদর্শের বাইরে তারা অবস্থান নিয়েছে এবং জনগণের কাছে তারা অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, রাষ্ট্র কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। অবশ্যই এটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে ন্যায় এবং নীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা সেই সব আইনই উত্তম, যেসব আইনের উৎপত্তি এবং পরিচালনাসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ন্যায়ভিত্তিক। এই সরকারের কাছে জনগণের ভাষা, চাওয়া-পাওয়ার মূল্য অর্থহীন। সর্বস্তরের জনগণের জানমালের দায়িত্ব নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। জনগণের সঙ্কটের উত্তরণ ঘটাতে প্রধানমন্ত্রী ব্যর্থ। শুধু এটাই শেষ কথা নয়, নৈতিক দিক থেকে উৎকৃষ্ট ব্যক্তিদের সাথে উত্তম আচরণ করা হয়নি; বরং সমাজে যারা অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের, তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা হয়েছে নানাভাবে, নানা উপায়ে। জনগণের উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ সংবিধান এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই নির্বাচনকালীন সময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা দিতে হবে। গণতন্ত্র এখন পর্যন্ত পরিচিত শাসনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম বলে স্বীকৃত। অন্যান্য শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন সহজ হতে পারে না; কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ম-কানুন, আইন-কানুন জনগণের কল্যাণে পরিবর্তন সাধন করা যায়। সেটা সংবিধান হতে পারে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকবেন তাদেরকেও বদলাতে হয়। তবে সেটা নিয়মতান্ত্রিক পন্থার মধ্য দিয়ে। তাই গণতান্ত্রিক নিয়মে সংবিধান সংশোধনে কোনো জটিলতা নেই। সরকার হবে জনগণের, জনগণই বলবে শেষ কথা।

গণতন্ত্রের প্রধান মাধ্যম নির্বাচন। তাই নির্বাচনব্যবস্থাকে কোনোভাবেই কলুষিত করা যাবে না- নির্বাচনে নির্বাচক তার অভিরুচি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে অবশ্যই; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে যাচ্ছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে গরিষ্ঠ জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবেন কি না, সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন। সরকার যদি জনগণের বৃহাদংশের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে জনগণের কাছে নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। মোদ্দা কথা, শাসন বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশন কোনোটাই নিরপেক্ষ নয় কিংবা এত দিন তারা সরকারের দলীয় স্বার্থে কাজ করে চলেছে। তাই জনগণের কাছে এরা মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অবশ্যই নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য সব দলের সম্মিলিত চিন্তায় একটা নিরপেক্ষ ও যোগ্য সরকারব্যবস্থা কায়েম করতে হবে, তবেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে।

গণতন্ত্রে আমরা শুধু ভোটদানের ব্যবস্থাকেই অথবা নির্বাচনের যে পদ্ধতি তাকেই যদি শেষ কথা বলি, তাহলেও ভুল হবে। আসলে এটা একটি পদ্ধতি, লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিঁড়ি। বাড়িতে সিঁড়ি নির্মাণ করা হয় দোতলা, তিনতলায় পৌঁছানোর জন্য। তেমনি নির্বাচন একটি পদ্ধতি। নির্বাচনব্যবস্থা নিরপেক্ষতার পাশাপাশি আদর্শ শাসনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রার্থী মনোনয়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো অনেক বেশি সততা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অভিযুক্ত, অযোগ্য, অসাধু ও নীতিহীন ব্যক্তিকে কখনোই মনোনয়ন দেয়া ঠিক হবে না।

সব কথার সারকথা- শক্তি ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। তাই শক্তি ও ক্ষমতা হাতে পেলে এটার সদ্ব্যবহার করা উচিত। এর অপব্যবহার করা অপরাধ। শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে সর্বোচ্চ কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা যায়। সরকার যদি দুর্নীতিপরায়ণ, নিষ্ঠুর হয়- ন্যায়পরায়ণতা, মানবিকতা, ভয় ও লজ্জার তোয়াক্কা না করে, কোনো ক্রমেই জনগণকে শক্তিমান হওয়ার সুযোগ না দেয়, নীতি-ধর্ম পরিত্যাগপূর্বক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তা হলে তার পতন অনিবার্য। সেজন্য যথানিয়মে জনগণের সমর্থন লাভের প্রয়োজন। সন্ত্রাসী কেউ জন্মলগ্ন থেকে হয় না, সন্ত্রাস কোনো ধর্মের বা দলের পরিহার্য বিষয় নয়, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সন্ত্রাসের জন্ম হয়। সরকার এখানেও তার ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে। রাজনীতিবিদেরা হীনস্বার্থকে রাজনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে যুক্ত করেছেন। কবির, নানক, শ্রীচৈতন্য, লালন, রবীন্দ্র, নজরুল প্রমুখ মহান মনীষী ছাড়াও বারবার মানবতার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন- রাজনীতিবিদেরা যেমন গান্ধী, নেহরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজী সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সোহরওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, শেরেবাংলা ফজলুল হক প্রমুখ। তারা সব সময়ই স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে রাজনীতি করেছেন। সেখানে আমাদের সরকার সঙ্কীর্ণ স্বার্থরক্ষায়, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কিংবা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে অপরাজনীতিকে মোক্ষম হাতিয়ার করে নিয়েছে এবং দেশের জনগণকে কুটিল কৌশলের কাছে জিম্মি করেছে। অবিলম্বে জাতির এ থেকে মুক্তি অবশ্যই জরুরি।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads