বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩

লাগ লাগ ভেলকিবাজি লাগ

প্রকৌশলী এস এম, ফজলে আলী 
 ছোট বেলায় গ্রামে দেখতাম একজন লোক বানর দিয়ে হাসি কৌতুকের খেলা দেখিয়ে মানুষকে বেশ জমাতো এবং বিনিময়ে কিছু পয়সা কামাই করতো জীবিকা নির্বাহের জন্য। তারা ডুগ-ডুগি বাজিয়ে বানরকে দিয়ে নানা কছরত করতো এবং মুখে গানের সুরে বলতো “লাগ লাগ লাগ ভেলকিবাজি লাগ” মানুষ সে সব তামাশা দেখে প্রচুর আনন্দ পেত এবং মানুষ খুশি হয়ে বানরের হাতে টাকা পয়সা তুলে দিতো। সাময়িক সময় নিরানন্দ মানুষগুলো কিছু আনন্দ পেত মন্দ কি? পেটে ভাত না থাকলে কি? তারা গ্রাম্য পরিবেশের উপযোগী হালকা ধরনের যাদুও দেখাতো। হাতের কারসাজিতে এক টাকাকে ৫০, ১০০ টাকা বানিয়ে দেখাতো। এতে গরীব মানুষগুলো প্রলুব্ধ হতো এই টাকা তারাও যদি বানাতে পারতো ্ কিন্তু তা হবার নয়।
এ ভেলকিবাজির খেলা অতি পুরাতন। পাঠক জানেন রোমের স¤্রাট নীরো রোম শহর যখন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, শত্রুরা আক্রমণ করে দেশ দখল করে নিচ্ছে আর তখন তিনি সমুদ্র তীরে বসে মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছেন। প্রজারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মন যা চায় তাই তিনি করবেন তাতে প্রজাদের এত মাথাব্যথা কেন? তিনি প্রজাদের ভেলকিবাজি দেখাতেই পারেন। বাংলাদেশ আজ চরম নৈরাজ্যের মধ্যে চলছে। মানুষ গুম, খুন, জ্বালাও-পোড়াও হরতাল ইত্যাদিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। কারণ শুধু একটাই বিচার মানি কিন্তু তাল গাছটা আমার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র লড়াই শুধু ক্ষমতা দখলের লড়াই। ক্ষমতা সাধারণ নিয়মে ভোটের মধ্যে অর্জন করতে পারবেন নাকি সে সন্দেহ থেকে এ লড়াই।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে কিভাবে ক্ষমতায় আসছে তা সবার জানা। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফল হলো হাসিনা সরকার। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনরা যখন ক্ষমতা দখল করে তখন শেখ হাসিনা গর্বের সাথে বলেছিলেন যে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার হলো তার আন্দোলনের ফসল। আর তিনি যখন ক্ষমতা পেলেন ঘোষণা করলেন মইনুদ্দিন-ফখরউদ্দিন সরকারের বৈধ-অবৈধ সব কর্মকা- সংসদে পাস করে নেবেন। তিনি সংসদে ব্রুট মেজরিটি সদস্যের বলে তা করিয়ে নিয়েছেন।
বিগত ৫ বছরে তার দল দেশের এমন কোন ভাল কাজ করেন নাই যাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ভোট দিয়ে তাকে আবার প্রধানমন্ত্রী বানাবেন। তার দলের কর্মীরা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, ওলামা লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ দেশটাকে যেভাবে লুটপাট করে খেয়েছে তাতে ভোটের আশায় গুড়ে বালি। তাই উপায়? ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে পর্যায় চলে গিয়েছিল তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বাংলাদেশের জন্য উত্তম পদ্ধতি ছিল। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। দেশে বিদেশে তার ভূয়সী প্রশংসাও হয়েছে। কিন্তু হাসিনা সরকারের কর্মকা-ে দেশ যেমন রসাতলে যাচ্ছিল তেমনি বিদেশী প্রভুদের আদেশ-নির্দেশ মোতাবেক দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিরাপত্তাহীন করিডোর, ট্রানজিট, শুল্কবিহীন মালামাল আমদানি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইত্যাদি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। হাসিনা বুঝতে পারছে তার পায়ের তলায় মাটি নেই। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তার দলের ভরাডুবি হবে। তাই ফন্দি এঁটে কাউকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানের ওপর মামলা ঠুকে হাইকোর্ট থেকে বিতর্কিত রায় দিয়ে ব্রুট মেজরিটি সদস্যের ভোটে সংসদে এক কথায় বাতিল করে দেয়। চীফ জাস্টিস খায়রুল হকের সে বিতর্কিত রায়েও কিন্তু পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার নির্দেশ ছিল। কিন্তু তা মানলে তো গতি থাকবে না। তারা সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে ১৯৭৩ সালের ইলেকশনের মতো ভোট পেপারে সীল ছাপ্পরের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ। ব্যালট বক্স চুরি, নিরীহ ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না যেতে পারে তার ভয়ভীতি দেখিয়ে পার হয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এটা ১৯৭৩ সাল নয়, ২০১৩ সালের মনমানসিকতার অনেক পরিবর্তন আছে।
প্রধানমন্ত্রী আপনার প্রথম ভেলকিবাজি হলো আপনি ঘোষণা করছেন আপনি প্রধানমন্ত্রীর পদ চান না। তবে আপনি চানটা কি? বিরোধী দলের দাবিতো একটি আপনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। কেন আপনি সেটা মানছেন না? আপনি পদত্যাগ করলে দেশ একমুহূর্তে শান্ত হয়ে যাবে। কোন হরতাল, পিকেটিং, বোমাবাজি থাকবে না। কিন্তু আপনার মুখের উচ্চারিত কথামত কাজ করছেন না বলেই তো দেশে এই নৈরাজ্য। জাতিকে আর ভেলকিবাজি দেখাবেন না।
দ্বিতীয় ভেলকিবাজি দেখাচ্ছেন মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগপত্র আপনার কাছে নিয়েছেন। অথচ তারা মন্ত্রীর পদে বহাল তবিয়তে আছে। বিশ্বে এমন কোন নজির আছে? এর দ্বারা মানুষকে কোন ভেলকি দেখাতে চান? আপনি সর্বদলীয় সরকারে বিরোধী দলের সামনে টোপ ফেলছেন? আপনি নিজেকে যতই চালাক মনে করেন,  দেশের মাুনষ তত বোকা নয়। আপনার ইচ্ছামত সর্বদলীয় সরকার করতে চাইলে তো যেদিন সে সর্বদলীয় (!) সরকার করবেন সেদিনই তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারতেন। তাতে আপনাকে কে বাধা দেবে?
আরেক ভেলকিবাজি ইদানীং দেখাচ্ছেন। আপনার জনসভায় প্রচুর মানুষ যায়। কেন যায় সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতি সভায় আপনি তাদেরকে তওবা পড়ান এবং দুই হাত তুলে আপনার দলকে ভোট দিতে বলেন। এসব সভায় কিছু লোক যায় এনামের বিনিময়ে কিছু যায় হুজুগে। আপনি মনে করছেন ঐ হাত তোলাওয়ালারা সবাই আপনার দলকে ভোট দেবে? আপনার পক্ষের পত্রিকার জরিপে মহাজোট সরকার ভোট পেতে পারে শতকরা ২৮ ভাগ আর ১৮ দল নাকি পেতে পারে শতকরা ৬৭ ভাগ। আপনার এসবি, এনএসআই, ডিবি তাদের প্রতিবেদন কি বলে?
এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগ ঈমানদার মুসলমান। তারা স্বাধীনতার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে যুদ্ধ করেছে। তারা ইমান আমলে মুসলমানই থাকতে চায়। কিন্তু ১৯৭২ সালে যে শাসনতন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল তা কি এ দেশের মানুষের মনোভাব ও ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে করা হয়েছিল? আপনার দল মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতন্ত্র, শাসনতন্ত্রে ঢুকিয়েছেন তার সাথে এ দেশের মানুষের ঈমান আকিদার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে? আপনি আরেক ভেলকিবাজি দেখালেন ৫ম সংশোধনীর বিসমিল্লাহির........রাহিম, এক আল্লাহয় বিশ্বাস ও সামাজিক, ন্যায় বিচার এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে পুনরায় সমাজতন্ত্র, তথা রাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষবাদ সংবিধানে ঢুকালেন। কাদের স্বার্থে ইহা  করলেন মানুষ তা বোঝে। প্রথম সংবিধান তৈরি করেছেন আপনার দল ভারত ও রাশিয়ার নির্দেশে। তাতে জনগণের সমর্থন ছিল না। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণমানুষের মনোভাব বোঝার জন্য রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ছাত্র-যুবক, শিল্পী সাহিত্যিক, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের মতামত নিয়েই সংবিধানের ৫ম সংশোধনী এনেছিলেন দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করে রেফারেন্ডাম দেন দেখেন তারা কি মত দেন।
আপনার ভেলকিবাজির তো শেষ নেই। প্রত্যেক জনসভায় বলে বেড়ান আপনি ৫ ওয়াক্ত নামায পড়েন কুরআন শরীফ পড়েন। তা হলে তো আপনি পাক্কা ঈমানদার মুসলমান। কিন্তু ইসলাম ধর্মকে সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য নানা পদক্ষেপ কেন? হেফাজতে ইসলামকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছেন কেন? তারা তো কোন রাজনীতি করে না? শুধু ইসলামের কথা বলে। যারা ইসলাম বিদ্বেষী তাদের প্রতিবাদ করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ইসলাম ধর্মকে প্রায় উৎখাত করেছেন। আপনি ভাল জানেন যে কোন ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে চরিত্রবান করে। তারা দেশের সুনাগরিক হয়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতির সেবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। শিক্ষার সাথে নৈতিকতার সুযোগ না হলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না। আর ভালো মানুষ না হলে তারা আপনার ছাত্রলীগ, যুবলীগ মার্কা লোক হবে যারা ছাত্র জীবনেই অবৈধভাবে টুপাইস কামাই করে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে কিন্তু ততে বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনা থাকবে না। আপনারা মাদরাসা শিক্ষার মধ্যে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ আবিষ্কার করে বেড়াচ্ছেন। এ সব বলে তো আপনারা সেই পাগলার আচরণ করেছেন। একটা লোক সাঁকো পার হবে কিন্তু সাঁকোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখানো সাঁকোটা নড়বড়ে এবং এক পাগলা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা মনে করলো পাগলায় আবার সে সাঁকোতে ওঠার পরে নাড়ানো শুরু করে কিনা। তাই পার থেকে লোকটি ডেকে বললো। পাগলা সাঁকো নাড়িস না। বাস যায় কোথায়? সে তখন জবাবে বললÑ ভাল কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসের ঢোল পিটিয়ে যেভাবে সরা বিশ্বে নাড়া দিচ্ছেন তাতে কিছু উগ্র লোক সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। সরকার দেশের প্রশাসন, আইন বিভাগ যেভাবে দলীয়করণ করে ফেলেছেন ও মেধাহীন করেছেন তাতে দেশের দফা-রফা হওয়ার জোগাড়। আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করছেন। একদিন এদের দ্বারা তাদেরকেও নাস্তানাবুদ হতে হবে। সমস্যা হলো আমাদের রাজনীতিবিদরা এই মোক্ষম কথাটাই বুঝতে চান না।
প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বলছি অহম ছেড়ে দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিন। আপনি বলে থাকেন সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না। কিন্তু ভেবে দেখেছেন বিগত সাড়ে চার বছরে সংবিধানটির খোল-নৈচা কিভাবে পাল্টিয়েছেন? তখন কি আপনার মনে হয় নাই সংবিধান পবিত্রÑ যখন তখন ইহা পরিবর্তন করা ঠিক না। আপনি পশ্চিমা দেশের কথা প্রায়ই বলে থাকেন যে, সেখানে চলতি সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। সে দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী হতে কারো ১০০ বছর কারো ২০০ বছর পার হয়েছে। আর সে সব দেশে সরকারি ও বিরোধী দলে এ রকম চুল ছেঁড়াছিঁড়ি আছে কি?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads