বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিশ্ববিচ্ছিন্ন দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হওয়ার পরিণাম


আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ কি ক্রমেই একটি বিশ্ববিচ্ছিন্ন দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রেরপরিচিতি পেতে যাচ্ছে? এমন আশঙ্কা যতই প্রবল হচ্ছে, ততই নানা ধরনের শঙ্কা বাড়ছে প্রবাসী বাংলাদেশী এবং দেশের শিল্পোদ্যাক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। প্রবাসীদের উদ্বেগের প্রকাশ ঘটছে দেশের বাইরে সভা-সেমিনারে তাদের বক্তব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে। দেশের উদ্যোক্তারা সাদা পতাকা মিছিল করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আকুতি জানিয়েছেন। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গঠন তাতে দেশটি পণ্য আমদানির জন্য চীন, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। আর পণ্য রফতানির জন্য বিশেষভাবে নির্ভরশীল ইউরোপ ও আমেরিকার ওপর। চীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশ সস্তা পণ্য ও কাঁচামালপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। এ নিষেধাজ্ঞা প্রতিরক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত হলে সশস্ত্রবাহিনীর ব্যবহার্য অনেক অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ ও খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য অচল হয়ে পড়তে পারে। আর ভারত যদি বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তা হলে বাংলাদেশের বেশ কিছু কৃষিপণ্য ও কাঁচামালের জন্য বিকল্প উৎস দেখতে হবে। এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের আমদানি ও উৎপাদন ব্যয় বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে এর প্রভাব বহুবিদ হতে পারে। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ পণ্য রফতানির ওপর। ইরানের ক্ষেত্রে যে সর্বব্যাপী অবরোধ আরোপ করা হয়েছে সে রকম হলে বাংলাদেশের ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক লেনদেন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবরোধ আরোপ করলে বাংলাদেশ অর্ধেক পণ্যের রফতানি বাজার হারাবে। ইইউ পূর্ণাঙ্গ অবরোধ আরোপ না করে শুধু যদি জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয় তাহলেও ইউরোপে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি দুই-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যদি অবরোধে অংশ নেয় তাহলে বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের জ্বালানি সঙ্কটে পড়বে। ভেনিজুয়েলার মতো বিকল্প বাজার থেকে তেল সংগ্রহ করতে হলে এর ব্যয় পড়বে অনেক বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার আওতায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেললে রেমিট্যান্সে মারাত্মক ধস নামবে। জাপান, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সাথেও রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাপক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। জাপান এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা দেশ ছিল। এখনো বিপুল পণ্য বিশেষত যানবাহন ও ভারী যন্ত্রপাতি জাপান থেকে আমদানি হয়। জাপানের মতোই সিঙ্গাপুর থেকেও বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য আমদানি হয়। দুই দেশেরই বাণিজ্য ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের প্রতিকূলে। এসব দেশ অবরোধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অংশ হলে বাংলাদেশ বড় রকমের চাপে পড়বে। 

কোনো দেশ বা অঞ্চল বিশেষের পরিবর্তে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে কোনো দেশে অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে সেটি হয় সর্বাত্মক ও বড় রকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী। ইরানের মতো কম বিদেশনির্ভর অর্থনীতির দেশের ওপর জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তাতে শেষ পর্যন্ত দেশটি পশ্চিমের সাথে এক ধরনের সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। অথচ রাশিয়া ও চীনের মতো দেশও ইরানকে টিকে থাকার জন্য বিশেষ সহায়তা করেছে। 

জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে এর আওতা যত ব্যাপক হবে তার প্রতিক্রিয়াও ততটা ব্যাপকতর হবে। এই নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি বা আইডিবি পর্যন্ত বিস্তৃত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে টিকে থাকা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন অন্য কোনো দেশের অংশ হওয়ার যুক্তি প্রবলভাবে উঠতে পারে। স্বাধীন সিকিম প্রতিবেশী দেশের সাথে একীভূত হওয়ার সময় এ ধরনের যুক্তি উঠেছিল। 

কেন বাংলাদেশের ওপর অবরোধ আরোপ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে এ প্রশ্ন উঠতে পারে। সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণেই এই আশঙ্কা প্রবল হতে শুরু করেছে। আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যু ঘটানোর রায় কার্যকর না করতে বলেছিলেন। আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো একই ধরনের অনুরোধ জানিয়ে টেলিফোন করেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন। জাতিসঙ্ঘের হিউম্যান রাইটস কমিশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এর কোনোটাতেই সাড়া দেননি। তিনি একতরফা নির্বাচনে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করেছেন। আর দ্রুততম সময়ে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে যাকে দিয়েই টেলিফোন করানো হোক না কেন বাকিদের ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর করা হবে বলে জানিয়ে দেন।

প্রধানমন্ত্রীর এই কট্টর অবস্থানের প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হচ্ছে নানাভাবে। আমেরিকান সিনেট গত বুধবার জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নিয়ে এক শুনানির আয়োজন করে। এই জরুরি শুনানিতে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত পাস হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকারের রাজপথে গণহত্যা ও বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন ও সহিংসতা নিয়ে অলোচনা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনেনডেজ। উপস্থিত ছিলেন ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রভাবশালী ১৮ জন সিনেটর। এই শুনানির সিদ্ধান্তে থাকছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আরোপের বিষয়টি, যার প্রভাব পড়বে গোটা দেশের অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্প খাতে। বাংলাদেশ সরকারের নীতি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আরো কী কী ব্যবস্থা থাকছে তা দুই-এক দিনের মধ্যে বিস্তারিত জানা যেতে পারে। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে শুনানির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়। ওবামা প্রশাসনের পদস্থ আমলা নিশা দেশাইকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়। আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধাপরাধের নি¤œমানের বিচার, ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন, গণহত্যা ও সহিংসতা নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন।

আমেরিকান কংগ্রেসের পাশাপাশি ইউরোপীয় পার্লামেন্টও বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইইউ সংসদ আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করার অনুরোধে সাড়া না দেয়ায় বিশেষভাবে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে। ইইউ পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশীয় ডেলিগেশন আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যু ঘটানোর রায় কার্যকরে দুঃখ প্রকাশ করে আইসিটি যাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তাদের দণ্ডাদেশ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে। ডেলিগেশনের প্রধান জিন লিম্বার্ড বলেছেন, ‘আমরা কোনো দেশেই এ ধরনের দণ্ড চাই না। বাংলাদেশে প্রথম দণ্ডাদেশ কার্যকর করার পরই ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একটি পূর্ণাঙ্গ অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ পন্থা বাংলাদেশকে অনুসরণ করা উচিত। এ অবস্থান যে ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্মিলিত অবস্থান তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকার ইইউ কূটনীতিকদের প্রথমবারের মতো সাভারের বিজয় দিবসে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে। ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথেরিন অ্যাস্টন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলে তাদের অবস্থানের ব্যাপারটি স্পষ্ট করেছেন। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের সিনিয়র মিনিস্টার সাঈদা ওয়ারসি বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে ফিরে বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কমবেশি সহিংসতা বাংলাদেশে আরো হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো ভয়াবহ সহিংসতা আর কখনো দেখিনি। এসব প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশ পরিস্থিতির ব্যাপারে অনেকটা অভিন্ন অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও একই ধারার বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। হংকংভিত্তিক এশিয়ার শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বাংলাদেশী মানুষের জীবন রায় জাতিসঙ্ঘকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বুধবার জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনকে লেখা বাংলাদেশ : ইউএন শুড অ্যাক্ট ইমিডিয়েটলি টু সেভ বাংলাদেশী লাইভসশীর্ষক এক খোলা চিঠিতে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) উল্লেখ করেছে, ‘বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিদিনই সরকারি এজেন্টদের দ্বারা বিরোধী দলের লোকজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এ মুহূর্তে র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা লোকজনকে আটক করছেন। এমনকি বিভিন্ন জেলায় সরকারি দলের লোকদের দেখিয়ে দেয়া বিরোধী রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের প্রতিশোধ নিতে বিরোধীদের উসকানি দিচ্ছে সরকারি দল। প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রক্তয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সহিংসতায় বাংলাদেশে অন্তত ১০৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই মৃত্যুগুলো সরাসরি সরকারের একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টা এবং বিরোধী দলের তা প্রতিবাদের সাথে সম্পর্কিত। এ রকম জীবন হত্যা অনতিবিলম্বে বন্ধ হতে হবে। আর এটি নিশ্চিত করতে সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।এই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতার জন্য জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত অসকার ফার্নান্দেজ তারানকোকে পাঠানোর বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখে সংস্থাটি। যদিও জাতিসঙ্ঘের দূত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ শুরুর ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন কিন্তু দেশটিতে নির্বিচারে হত্যা কমেনি। মতাসীন জোট তাদের দলীয় ক্যাডারদের আইনশৃঙ্খলা রাকারী সংস্থাকে সহযোগিতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশে আদালত এবং মিডিয়া মূলত সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মিডিয়াকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া দেশটিতে মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তথ্য দিতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের রাখা হয়েছে ব্যাপক নজরদারিতে। এএইচআরসি বলেছে, জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা ছাড়া বাংলাদেশে সহিংসতা বাড়তেই থাকবে। এ ব্যাপারে সম্ভাব্য পদপে নিতে সংস্থাটির প থেকে জাতিসঙ্ঘকে অনুরোধ করা হয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এখন আর শুধু উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে না, একই সাথে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোও চেষ্টা করেছেন সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের, যাতে এখানে শান্তিপূর্ণ ও সহিষ্ণু পরিবেশ ফিরে আসে। তার সেই প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। সরকার একতরফা নির্বাচনকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই তারানকো তার বাংলাদেশবিষয়ক প্রতিবেদন মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করতে পারেন। এরপর বিষয়টি বিশ্বসংস্থার নিরাপত্তা পরিষদে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সেনাসংখ্যা কমিয়ে আনা হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে আইভরি কোস্টে দুই ব্যাটেলিয়ন বাংলাদেশী সেনার একটি পুনঃস্থাপন করার কথা। বলা হচ্ছে, এ সময় বাংলাদেশী সেনার পরিবর্তে আফ্রিকার তিনটি দেশ থেকে সেনা সংগ্রহের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে জাতিসঙ্ঘ। 

বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির কী পরিণতি হতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে সবাই শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন। প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের আকাক্সার কথাটি জানানো হয়েছে। তারা চারটি লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছে এখনকার পরিস্থিতিতে। প্রথমত. ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচনকে সম্পন্ন করে সে সরকারকে কাজ করতে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বিএনপিকে বলা হচ্ছে এ সরকারকে মেনে নিলে তারাই ৬ মাসের মধ্যে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেবে। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই নির্বাচন হবে, শুধু জামায়াত অংশ নিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত. বিরোধী দলকে ৫ তারিখের নির্বাচনের আগে সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য সরকারি দলের সাথে সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে এবং তাতে একটি ঐকমত্যে উপনীত হতে সহায়তা করা হবে। তৃতীয়ত. নতুন সরকারের এ সময়ে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে এবং বাকি মামলা শেষ করা হবে। চতুর্থত. এ সময়ে ভারতের সাথে ট্রানজিট প্রদানের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এ সব ব্যাপারে বিরোধী পক্ষকে সম্মত করার জন্য নানা প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে। এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতাদের বলা হচ্ছে, তার দলের নেতারা যাতে সরকারে ও সংসদে অংশ নেয়। নতুন সরকারের ছয় মাস পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাতে জামায়াত অংশ নিতে পারবে না আর এর মধ্যে বিএনপির মেরুদণ্ড এমনভাবে ভেঙে দেয়া হবে যে, তাদের নির্বাচনে জেতার অবস্থা আর থাকবে না। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় জাতীয় পার্টি জনগণের ভোট নিয়ে তখন সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। 

বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে প্রতিবেশী দেশের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে কী পরিণতি হবে সেটি অনুমান করা যায়। দেশের এই সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির ব্যাপারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অনুমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, একতরফা নির্বাচন হলে বা যে প্রক্রিয়ায় আগামীতে সরকার গঠিত হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রথম শিকার হবে দেশের অর্থনীতি। কারণ সরকার গঠিত হলেও সেই সরকারকে টিকে থাকতে হবে অনেকটা জোরজবরদস্তি করে। আর এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বিনিয়োগ কমে যাবে। দেশের অর্থনীতির প্রায় ৬০ ভাগ এখনো আমদানি-রফতানি অর্থাৎ বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। তাই দেশের অবস্থা স্থিতিশীল না থাকলে আমদানি-রফতানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতির ওপর। অন্য দিকে সাবেক কেবিনেট সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সাদত হুসাইন বললেন আরো বড় আশঙ্কার কথা। তার মতে, এ রকম একতরফা নির্বাচনে, বিশেষ করে যে নির্বাচনে ইতোমধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেলেন, তাতে করে প্রথমত দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হবেন। দ্বিতীয়ত. এ রকম নির্বাচন দেশ-বিদেশে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট খারাপ হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা বিদেশের বিমানবন্দরে বাড়তি নজরদারির মধ্যে আসতে পারেন। ইমিগ্রেশন অফিসারেরা বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখলে অতিরিক্ত সময় নিতে পারেন। এমনকি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। জরুরি প্রয়োজনে অনেকে ভিসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। সাবেক এ সচিব আরো আশঙ্কা করেন, যদি এ রকম একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা সরকার গঠিত হয়, তাহলে সেই সরকারের নৈতিক ভিত্তি থাকবে অত্যন্ত দুর্বল। তখন সেই দুর্বল সরকারের আদেশ-নিষেধ মানার ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সরকারের সব নির্দেশ নাও মানতে পারে। এতে করে রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে- এ বিষয়টি নিশ্চিত করে কেউ বলতে না পারলেও একটি বিপর্যয় যে অপেক্ষা করছে তাতে সংশয়ের অবকাশ খুব একটা থাকছে না। সেটি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। আর স্বল্পমেয়াদি কোনো সঙ্ঘাতে একটি স্থিতি এলে তাতে ক্ষতিটা পরে পুষিয়ে নেয়ার পর্যায়ে থাকতে পারে। বিহারের আলোচিত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের ক্ষমতায় থাকাকালে এক জাপানি মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এই মন্ত্রী লালুকে বলেছিলেন তারা সুযোগ পেলে বিহারকে জাপান বানিয়ে ফেলতে পারবেন। এর জবাবে লালু জাপানি মন্ত্রীকে বলেছিলেন, সুযোগ বলে তিনি জাপানকে অল্প সময়েই বিহার বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখেন। বাংলাদেশের নেতৃত্বের ওপর যেন লালুর আছর পড়েছে। বিহার নয় তারা এ দেশকে আফগানিস্তান সোমালিয়া বা সিরিয়া বানানোর গন্তব্যে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads