শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

নিম্নমানের রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও ভাষা


একসময় রাজনীতিতে আদব লেহাজ ছিল। শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক আচার-আচরণেও একটা মূল্যবোধ ছিল। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা সব সময় রাজনীতিবিদদের সম্মান করতাম, তিনি যেই দল বা মতেরই হোন না কেন। এটা ছিল সামাজিক আদবের অংশ। এটাই ছিল আমাদের দেশের কালচার। সমাজে শিতি ও মানী লোকদের সম্মান করতে কারো কার্পণ্য ছিল না। হয়তো ৫০ বছর আগেও ট্রেনে ছাত্রদের বিশেষ সম্মান দেখানো হতো। রাজধানীতে রিকশাওয়ালা বা ঘোড়ার গাড়িওয়ালা ছাত্রদের সম্মান করত। আমাদের সময়েও ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আমরা ছিলাম পরম বন্ধু। নাটক সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সব ছাত্র সংগঠনের সদস্যই অংশ নিতো। বন্ধুতে বন্ধুতে হাতাহাতি, খেলা নিয়ে বা নাটক বা অভিনয় নিয়ে বচসা বা ছোটখাটো ধাক্কাধাক্কি হতো না যে তা নয়।
আমার স্কুলজীবনে প্রথম যে রাজনীতিবিদের সাথে পরিচয় হয় তিনি ছিলেন ফেনীর রাজাখাজা আহমদ সাহেব। শুনেছি, লবণ আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে বামপন্থী রাজনীতি করতেন। ৫৪ সালে গণতন্ত্রী দলের সদস্য হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। পরে ১৯৬২ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি যে দলই করুন না কেন তিনি ছিলেন সবার নেতা। আমার প্রথম কবিতা তার কাগজেই ছাপা হয়। ও রকম নেতা এখন আওয়ামী লীগে একজনও নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন দল-মত নির্বিশষে সবার ঠিকানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হকি স্টিক, সাইকেল চেইন ও সাপ এসেছে গভর্নর মোনায়েম খানের আমলে। তখন এনএসএফ নামে একটি ছাত্রসংগঠন ছিল, যারা সরকারকে সমর্থন করত। তবে এনএসএফে ভালো ছাত্ররাও ছিলেন। এই অবস্থা ছিল ৭০ সাল নাগাদ। ৬৯-এর দিকে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সময় ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের নেতা আবদুল মালেককে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ ও মস্কোপন্থী ছাত্রনেতারা। সামরিক আইন জারি হয়ে গেলে মালেক হত্যামামলাটি বিচারের জন্য সামনে চলে আসে। মালেক হত্যামামলার একজন আসামি ছিলেন মাহফুজ আনাম। তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের ছেলে। বিষয়টি জানতে পারলাম উর্দুতে লেখা খুররম মুরাদের স্মৃতিকথা মূলক বই লমহাত থেকে। ইংরেজিতে মোমেন্টস আর বাংলায় বলা যেতে পারে মুহূর্তগুলো। খুররম মুরাদ সাহেব ছিলেন ওই সময়ে ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি। আর তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেখানে আবুল মনসুর সাহেবের বড় ছেলে মঞ্জুর আনামও চাকরি করতেন। খুররমের সাথে মঞ্জুর আনামের খাতির ছিল। এই সুবাদে মাহফুজ আনামের বিষয়টি নিয়ে মঞ্জুর আনাম খুররমের সাথে আলাপ করেন এবং সহযোগিতা কামনা করেন। খুররম সাহেব বিষয়টি তদন্ত করেন এবং জানতে পারেন যে, মাহফুজ ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন না। এর মাধ্যমে খুররম মুরাদের সাথে আবুল মনসুর সাহেবের পরিবারের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পতন ও পরাজয়ের পর খুররম সাহেব আবুল মনসুর সাহেবের ধানমন্ডির বাসায় আশ্রয় নেন। আবুল মনসুর আহমদ খুবই আপনজনের মতো খুররমকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। একপর্যায়ে তাকে ক্যান্টনমেন্টে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেফাজতে পৌঁছে দিলে তিনি পাকিস্তান যেতে সম হন। আবুল মনসুর আহমদ যত দিন জীবিত ছিলেন তত দিন খুররমের সাথে তার যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল। খুররম মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে আসতেন তার নিকটাত্মীয়দের দেখার জন্য। এই তথ্যটি উল্লেখ করার কোনো বদ উদ্দেশ্য নেই। শুধু সে সময়ের রাজনীতি ও সামাজিক সম্পর্কে মূল্যবোধ এবং শিষ্টাচার কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝানোর জন্যই উল্লেখ করেছি। শুধু একবার ভাবুন, সে সময়ে আবুল মনসুর আহমদের পুত্র মাহফুজ আনামের নাম যদি আসামি তালিকা থেকে বাদ না দেয়া হতো তাহলে পুরো ঘটনা পরবর্তীপর্যায়ে কিভাবে ঘটত।
এখন কি এ রকম ঘটনা ঘটা সম্ভব? আমার তো মনে হয় সম্ভব নয়। এখন রাজনীতিতে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি সীমাহীনভাবে বেড়ে গেছে। দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক দেখেই আপনারা ভাবুন। তাদের ভেতর কিসের বিরোধ? আমরা তো মনে করি তারা দুজনই দেশের কল্যাণে নিবেদিত। দুজনের ল্যই বাংলাদেশের কল্যাণ। তাহলে দুজনের মাঝে এত দূরত্ব কেন? তবে ব্যক্তিগত জীবনে দুজনের ভেতর অনেক ফারাক। একজন খুবই কম কথা বলেন। আরেকজন বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন। একজন পিতার ঐতিহ্যে রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু স্বামী ছিলেন একজন বিজ্ঞান গবেষক। তেমন কথা বলতেন না। কখনো-সখনো বললেও কথার ভেতর পরিমিতি বোধ ও পরিশীলন ছিল। ইনি হচ্ছেন ড. ওয়াজেদ। অপর দিকে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন একজন সামরিক অফিসারের স্ত্রী। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার ভেতর জীবনযাপন করেছেন। ইনি রাজনীতিতে এসেছেন সময়ের প্রয়োজনে বাধ্যতামূলকভাবে। তার স্বামী জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল রার জন্য। শেখ হাসিনা ছাত্র বয়সে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু তার শ্রদ্ধেয় পিতা ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওই রকম মর্মান্তিক মৃত্যু না হলে তিনি রাজনীতিতে আসতেন কি না সন্দেহ ছিল। বেগম খালেদা জিয়াও রাষ্ট্রপতি জিয়া দুজনই রাজনীতিতে এসেছেন এক বিশেষ মুহূর্তে। দেশবাসী প্রথম জিয়ার নাম শুনে ১৯৭১ সালের ২৬/২৭ মার্চ। অচেনা এক মেজর হঠাৎ করে রেডিওতে ঘোষণা দিলেন, আমি মেজর জিয়া বলছি। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিচ্ছি। বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি আমাদের সমর্থন জানানোর জন্য। সে সময়ে বহু নামীদামি রাজনীতিক নেতা ও উচ্চ মর্যাদার সামরিক অফিসার ছিলেন। কিন্তু ভাগ্য জিয়া সাহেবকেই টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়েছে। শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। দীর্ঘ বিরতির পর আবার জিয়া সাহেবের নাম শুনলাম ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। তিনি আবার রেডিওতে এলেন এবং শৃঙ্খলাবিহীন সৈনিকদের আহ্বান জানালেন ব্যারাকে ফিরে যেতে। ভাগ্যই জিয়াকে বারবার ঠেলে পর্দার পেছন থেকে সামনে নিয়ে এসেছে। জিয়ার সাথে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, খুব ঘনিষ্ঠভাবে কথা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাথেও আমার বহু ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত আছে।
জিয়ার চরিত্রে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বেশ কিছু গুণ আছে বলে আমার মনে হয়েছে। জানি না আমি ভুল কি না। মওদুদ সাহেবও জিয়া সাহেব সম্পর্কে তার চলমান ইতিহাস বইতে একটি বিশ্লেষণ দিয়েছেন। জিয়াকে জাতির নেতায় পরিণত করেছে তার সততা ও চরিত্রের দৃঢ়তা। তার সততার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো মহলই কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। জিয়া তার প্রথম উপদেষ্টা কমিটিতে যাদের নিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন দেশের জ্ঞানী-গুণী। শুনেছি, তিনি নাকি তাদের সবাইকে স্যার বলে সম্বোধন করতেন এবং সেভাবেই সম্মান দেখাতেন। রাষ্ট্রপতি বা দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি কখনোই তেমন ভাব দেখাতেন না। আজকের এ লেখার প্রধান ল্য হলো রাজনৈতিক শিষ্টাচার। যা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে গেছে। সেটা জাতি অনুধাবণ করেছে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর ফোনালাপ থেকে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে নৈশভোজের দাওয়াত দিতে গিয়ে যেসব কথা উত্থাপন করেছেন তা একেবারেই সৌজন্য বর্জিত। কদিন আগে নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর টকশোতে বলেছেন, ওই আমন্ত্রণে কোনো মর্যাদাবান মানুষ অংশ নিতে পারে না। দাওয়াত দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা নিম্নœরুচির পরিচায়ক বলেই ভদ্রসমাজ মনে করেছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান করেছেন। আমি নিজে চোখে দেখেছি বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীকে কিভাবে সম্মান করতেন। যেকোনো অবস্থায় ও পরিস্থিতিতে তিনি মওলানা সাহেবকে স্মরণ করতেন। এমনও শুনেছি ও দেখেছি তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। তখন পুরনো নেতাদের বেশির ভাগই জেলখানায় ছিলেন। তিনি তাদের পরিবার-পরিজনের খবর নিয়েছেন। অনেককে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। জাতীয় ঐক্য ও বৃহত্তর শান্তির জন্য তিনি কোনো ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেননি। বঙ্গবন্ধুর পরে যাদু মিয়া, মিজান চৌধুরী, মালেক উকিল, শাহ আজিজ, সবুর খান, আতাউর রহমান খান, আসাদুজ্জমান সাহেব পর্যন্ত সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতি বজায় ছিল। জিয়া নিজেও পুরনো সব রাজনীতিককে সম্মান দেখিয়েছেন। ৭৯ সালের সংসদে বহু পুরনো নেতার উপস্থিতি ছিল। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতারা মনে করেন জিয়া রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসন করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপমানজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, ঠিক একই কারণে জিয়া সবাইকে সম্মানিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর পরের আওয়ামী জেনারেশনের কাছে রাজনৈতিক প্রতিপ মানে শত্রু। এই মানসিকতাই ধরা পড়েছে খালেদা জিয়ার সাথে শেখ হাসিনার ফোনালাপে। আমাদের বন্ধু মরহুম মুজাফফর যখন নিউ নেশনে কাজ করতেন তখন একবার শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেছিলেন তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ভাবভঙ্গি সম্পর্কে। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এটাই আমার পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। বঙ্গবন্ধু মাঠের বক্তৃতায় প্রতিপকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করতেন, কিন্তু কোনো ধরনের অশালীন কথা বলতেন না। ব্যক্তিগতপর্যায়ে দেখা হলে তিনি সবাইকে সম্মান দেখাতেন। সত্যি কথা বলতে কী এখন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই সুন্দর ও পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতে পারেন না। মুখ খুললেই মনে হয় তারা ঝগড়া ফ্যাসাদ করছেন। কারো কারো কথা বলার সময় গলা ফুলে যায়, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। এরা সবাই রাজনৈতিক প্রতিপরে প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ করেন। আমার ধারণা তারা সাধারণ মানুষকে তুষ্ট করার জন্যই হয়তো এ ধরনের ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করেন। গালাগাল করে কথা বলা বহু তথাকথিত সামাজিক ভদ্রলোকের পারিবারিক ঐতিহ্য। যেমন খুব ভালো মানুষের সন্তান নাসিম কথায় কথায় বলেন, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা এনেছে, গণতন্ত্র এনেছে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আওয়ামী লীগই রা করবে। ভদ্র ও পরিশীলিত ভাষার লোকেরা সবাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছে। বিনীত পরিশীলিতজনেরা নাকি এ দলে থাকতে পারেন না। আমার এ কথাগুলো খুবই কটু শোনা যাচ্ছে। অনেকেই বলবেন, এমন লোক কি বিএনপি বা অন্য দলে নেই? আমি বলব হয়তো আছে, কিন্তু তারা দৃশ্যমান নয়। আগেই বলেছি শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার কথাবার্তায় আকাশ পাতাল ফারাক। সে জন্যই আওয়ামী লীগের অনেকেই বলেন, আমাদের নেত্রী কথা বললেই আমাদের ভোট কমে যায়। দুই নেত্রীর ফোনোসংলাপেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
আমাদের চলমান রাজনীতির অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক উপাদান হলেন হো মু এরশাদ। তার ভাষা বা কথাবার্তা সহনীয়। কিন্তু মানুষটাই একেবারে পচা দুর্গন্ধময়। এমন একটি মানুষ এ দেশের সেনাপ্রধান ছিলেন, জোর করে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। স্বৈরাচার হিসেবে তার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন হয়েছে। দেশের মানুষ তাকে টেনে-হিঁচড়ে মতা থেকে নামিয়েছে। এই নিন্দিত মানুষটির সাথে কেন যেন শেখ হাসিনার একটি গোপন সম্পর্ক আছে যে সম্পর্কটি দিল্লি নির্ধারণ করে দিয়েছে। জোর করে মতা দখলের পরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি অখুশি নন। কলকাতার পত্রিকায় লিখেছে বন্দুকের নলে প্রজাপতি। এরশাদ নিজেও বলেছেন, তিনি দিল্লির সাথে কথা বলেই মতা দখল করেছেন। দেশের মানুষ বুঝতে পারে এরশাদের সাথে দিল্লির একটা গোপন সম্পর্ক আছে। কেন যে এই মানুষটাকে রাষ্ট্রপতি জিয়া সেনাপ্রধান করেছিলেন তা বোধগম্য নয়। পাকিস্তান ফেরত ও ভারতে গোপন ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকটাকে হয়তো জিয়া অনুগত হিসেবে পাবেন আশা করেছিলেন। অনেকেরই ধারণা এই লোকটাই জিয়াকে হত্যা করেছে। রাজনীতির বিশ্লেষকেরা অনেকেই বলে থাকেন, শেখ হাসিনা ও এরশাদ দুজনই দীর্ঘকাল ভারতে অবস্থান করেছেন। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সাথে দুজনেরই গভীর সম্পর্ক।
আমরা বাল্যকাল থেকেই শুনে আসছি রাজনীতিকেরা ব্যক্তিগত জীবনে একে অপরের বন্ধু। পুরনো রাজনীতিকেরা প্রায় সবাই শেখ সাহেবের বন্ধু ছিলেন অথবা মুরব্বি ছিলেন। শুনেছি, কমিউনিস্ট নেতা তোয়াহার হুলিয়া জারি হলে তিনি তাজউদ্দীনের বাসায় ছিলেন কিছু দিন। শেখ সাহেব বিষয়টা জানতেন। শেখ সাহেব নিয়মিত মওলানা ভাসানীর খবর নিতেন। রাজনৈতিক বক্তৃতায় মওলানা পুত্রসম শেখকে বহু বকাঝকা করতেন, কিন্তু কখনোই বাজে কথা বলতেন না। শেখ সাহেব নিজেও কখনোই বলতেন না। দেশের মানুষ সবাই জানেন, মওলানা সাহেব আর শেখ সাহেবের ভেতর পিতাপুত্রের মতো সম্পর্ক ছিল। ভারতের প্রভাবমুক্ত থাকার জন্য শেখ সাহেব সব সময় মওলানা সাহেবের সহযোগিতা নিয়েছেন। এখন রাজনীতিতে সেই সুদিন আর নেই। এর একমাত্র কারণ ভারত। অখণ্ড বাংলাদেশের অ্যাসেম্বলির স্পিকার ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন সাহেবের স্থাবর সম্পদ সরকার অধিগ্রহণ করার পর তার পরিবারের সদস্যরা শেখ সাহেবের সাথে দেখা করলে শেখ সাহেব তা মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও ভাষার ব্যবহার নিয়ে কদিন আগে আমার বন্ধু সৈয়দ আবুল মকসুদ একটি কলাম লিখেছেন। আমি তার বক্তব্যের সাথে একমত। সৈয়দ আবুল মকসুদ মওলানা ভাসানী সাহেবের ওপর একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। আমি নিজে মওলানা সাহেবের একজন পরম ভক্ত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের মহাসচিবই ভাষাগত দিক থেকে বেশ কিছুটা পরিশীলিত। তবে সৈয়দ আশরাফ দলীয় সংস্কৃতির কারণে মাঝে মাঝে পারিবারিক ঐতিহ্য রা করতে পারেন। তার মরহুম পিতা সৈয়দ নজরুল সাহেব খুবই বিনীত মানুষ ছিলেন। তিনি কখনোই উচ্চকণ্ঠে কথা বলতেন না। সৈয়দ আশরাফ দলীয় রাজনীতির কারণে একবার বলেই ফেললেন তিনি কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। সৈয়দ আশরাফের ধর্মহীনতাই নাকি তাকে দলের মহাসচিব হওয়ার সাহায্য করেছে। অপর দিকে মির্জা ফখরুল আওয়ামী নেতাদের বোলচাল, দেহভঙ্গি ও ভাষার সাথে কিছুতেই ম্যাচ করতে পারছেন না। মির্জার মতো ভদ্রলোকদের দিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি হবে না। তবে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান একজন খাঁটি ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে জানতেন না। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও ভাষাগত দিক থেকে শেখ হাসিনার চেয়ে হাজার মাইল দূরে আছেন। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads