রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩

দেশ যখন ইতি ছেড়ে নেতির কবলে


জীবনে ব্যর্থতার একটা বড় কারণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। শুধু ব্যক্তি ও সমাজ জীবনেই নয়, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও কথাটি যথার্থ। সে জন্য সাধারণ তাগিদ হচ্ছে দেশ পরিচালনা যারা করেন, তাদের সব সময় নেতিবাচকতা পরিহার করে ইতিবাচক দৃষ্টি নিয়েই যাবতীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বিপরীতে যাওয়ার অপর অর্থ জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ব্যর্থতা আর জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলা, জাতীয় সাফল্য ও গৌরব অর্জনের বিষয়টি হাতের নাগালের বাইরে ঠেলে দেয়া। এই সহজবোধ্য উপলব্ধিটি আমাদের দেশের নেতানেত্রীদের মধ্যে বড়ই অভাব। আমাদের নেতাত্রেীদের মধ্যে ইতির চেয়ে নেতির অনুশীলনই প্রবল। ফলে বারবার আমরা মুখোমুখি হই নানামাত্রিক সঙ্কটের। যে সঙ্কট আমাদের সমাজ ও দেশকে করে তোলে অস্থিতিশীল। বাড়ে জনগণের দুর্ভোগ। অর্থনীতির চাকা হয়ে পড়ে অচল। এতে আমরা পড়ি অভাবনীয় মাত্রার জানমালের লোকসানে। ২০১৩ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলা যায়, এই গোটা বছরই আমরা এমনই একটি পরিস্থিতির মধ্যে কাটিয়ে এসেছি। আগামীকাল শেষ হচ্ছে এ বছরটি; কিন্তু বিদ্যমান সঙ্কট একটুও কাটেনি। বরং বাড়ছে জটিলতা। বাড়ছে অনিশ্চয়তা। অবস্থানগত কারণে যেখানে এ সঙ্কট কাটানোর দায় ছিল প্রধানত সরকারপক্ষের, সেখানে সরকারপক্ষ ইতির সড়ক ছেড়ে নেতির সড়ক ধরে চলার গতি আরো প্রবল থেকে প্রবলতর করছে। ফলে ২০১৩ সালকে একটি নষ্ট বছর কিংবা নেতির বছরছাড়া আর কোনো অভিধায় আখ্যায়িত করার সুযোগ নেই।
একটি সরকার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সরকার না হয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি সহজ ফর্মুলা হচ্ছে, জনগণের মন পাঠ করে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। এতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপে জনগণের অংশগ্রহণ সর্বাধিক মাত্রায় নিশ্চিত হয়। আর এ ধরনের সরকারি কোনো পদক্ষেপ বা কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ সর্বাধিক থাকায় সর্বাধিক সাফল্য যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি সরকারের জনপ্রিয়তাও কমে না, ধস নামা তো দ্বিতীয় চিন্তা। আমাদের বর্তমান সরকার সে উপলব্ধি নিয়ে চলতে পারেনি বলেই সরকার শুধু নেতির অনুশীলনেই ছিল বেশি মনোযোগী। ফলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা এ সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমে এসেছে। আর তাই সরকারকে প্ররোচিত করছে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ চালিয়ে বিরোধী দলবিহীন, ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকায় মরিয়া হয়ে উঠতে। যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে সরকারি দল ও যাদের মিত্র দলের ১৫৪ প্রার্থী এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। অবশিষ্ট ১৪৬ আসনের বেশির ভাগে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে লড়বেন হয় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (?) প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী পরিচয়ে কিংবা মহাজোটের শরিক দলের অন্য কোনো প্রার্থী। যেখানে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। অতএব ধরেই নেয়া যায় দেশের ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার ৫ জানুয়ারি এই অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে কার্যত নাবলেছে। এরপরও নির্বাচন অনুষ্ঠান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে, এমনটি আশা করা ভুল। শুধু দেশেই নয়, অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা খুলেই বলেছে, বিরোধী দলবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তবুও সরকার ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড়। সরকারের অনড় অবস্থান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচায়ক। অতএব এতে চূড়ান্তপর্যায়ে কোনো সাফল্য যে আসবে না, তা বলছে সব মহল। হতে পারে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনী নামিয়ে জোর-জবরদস্তির একটা নির্বাচন করে ফেলবে, তবে এ গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতভাবে থাকবে প্রশ্নবিদ্ধ। অতএব সরকারকে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এই নেতির সড়ক ছেড়ে ইতির সড়ক ধরেই হাঁটতে হবে। দেশের ৭০-৯০ শতাংশ চায়, দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হোক নির্দলীয় সরকারের অধীনে, এর প্রমাণ বিভিন্ন মতামত জরিপে দেখা গেছে। সরকার সমর্থক পত্র-পত্রিকার জরিপেও এর সত্যতা মিলেছে।
এই লেখা তৈরি করছি ২৮ ডিসেম্বর রাতে। রাত পোহালেই ২৯ ডিসেম্বর। বেগম খালেদা জিয়া ২৯ ডিসেম্বর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রতি নাজানানোর লক্ষ্যে দেশবাসীর প্রতি ঢাকায় মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসিবা গণতন্ত্রের অভিযাত্রানামে শন্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার এ কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়নি। তার পরও বেগম জিয়া যেকোনো মূল্যে এই কর্মসূচি পালনে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার ও সরকারি দল সর্বোচ্চ কঠোরতা অবলম্বন করে এই মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসিঠেকাবে। আওয়ামী লীগের নেতারা লাঠি হাতে অলিগলিতে ও রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান নিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কিছুতেই ঢাকায় ঢুকতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশ বাহিনীও এ মার্চ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানের কথাই উল্লেখ করেছে। এই কর্মসূচির পর থেকেই সারা দেশে যৌথবাহিনী গণগ্রেফতার করছে, এমন অভিযোগ উঠেছে। ২৭ ডিসেম্বর থেকেই ঢাকা অভিমুখে সব গণপরিবহন আসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২৮ তারিখ থেকে রাজধানীর গণপরিবহনও বন্ধ। বলা হচ্ছে, ওপরের নির্দেশে তা করা হচ্ছে। এতে করে সারা দেশে মানুষের চলাচলে সৃষ্টি হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্যোগ। সর্বোপরি ২৯ তারিখের মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসিআয়োজন ঠেকানো পরস্পরবিরোধী কঠোরতার মুখে ২৯ তারিখ ও পরবর্তী কদিনে কী ঘটবে এই মুহূর্তে আন্দাজ-অনুমান করা মুশকিল। এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে চলমান সঙ্কটের ফলে আমাদের জানমাল ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে, তা পূরণ হবার নয়। এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে দেশের রাজনৈতিক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে দেশবাসী শঙ্কিত।
বিদ্যমান এ প্রেক্ষাপটে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সম্মিলিত পরামর্শ এসেছে গত শনিবার রাজধানীতে আয়োজিত একটি সংলাপ থেকে। চারটি শীর্ষ সংগঠন এ সংলাপ আয়োজন করে। এগুলো হচ্ছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, সুশাসনের জন্য নাগরিক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। দিনব্যাপী এ সংলাপে ৫৫ জন আলোচনায় অংশ নেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আসন্ন নির্বাচন স্থগিত করে গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দেন। এদের মধ্যে রয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীরা। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চলনায় অনুষ্ঠিত এ সংলাপে অংশ নেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বিএনপি নেতা লে. জে. (অব:) মাহবুবুর রহমান, শমসের মবিন চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ড. মঞ্জুর এলাহী, সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রমুখ।
রেহমান সোবহান বলেন, আসন্ন নির্বাচন চলমান সমস্যার গঠনমূলক সমাধান করবে না। সংবিধানের আওতায় এ সমস্যা সমাধানের সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, আগামী ২৬ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদের আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান করা যেতে পারে। এ জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য হতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধাক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, আজকের এ আলোচনায় একটা বিষয় বুঝলাম, বেশির ভাগ বক্তাই নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ সঙ্কট উত্তরণে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে গুচ্ছ সমঝোতা করতে হবে।
আরেক উপদেষ্টা রোকেয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন হলে এর আগে-পরে কোনো শান্তি আসবে না। ব্যবসায়-বাণিজ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই, গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাই।
প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক বলেন, ‘বাইরের লোক ডেকে এনে নয়, দুই নেত্রীকেই সঙ্কট নিরসনে আলোচনায় বসতে হবে। দুই নেত্রীকে বলব, দেশের স্বার্থে সমঝোতায় আসুন। সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন পেছানো যাবে। সময় আরো ৯০ দিন বাড়ানো যাবে। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রের মতো চলতে দিন।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, সে নির্বাচন হচ্ছে না। এটি সংবিধানের মূল চেতনায় হচ্ছে না। সংবিধানে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে আদালতের মতামত নেয়া যায় কি না, কিংবা আইনগতভাবে আসন্ন নির্বাচন বাদ দেয়া যায় কি না দেখতে হবে। তিনি মত দেন, আসন্ন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ একটি কলঙ্কময় দল হিসেবে চিহ্নিত হবে। তিনি মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হলে আরো প্রাণহানি হবে। প্রাণ বাঁচানোও সবার দায়িত্ব। যেখানে ১৫৪ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হলে তা সংবিধানবহির্ভূত হয়। গণতান্ত্রিক সংবিধানে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নয়। সংসদ এখনো আছে। সংসদ ডেকে সংবিধান সংশোধন করে বর্তমান সঙ্কট সমাধান সম্ভব।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, আজকে যা হচ্ছে তা ১৯৭৫ সালের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হওয়ার কোনো ইতিহাস নেই। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী থাকলে সরকারি দল ছাড়া কেউ নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না। আমাদের ১৬তম সংশোধনীতে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দলীয় দাসে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর বাসভবনের সামনে সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন করতে হবে। সৈয়দা রিজওয়ানা চৌধুরী বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন চাই নাÑ এ আওয়াজ তুলতে হবে। ড. পিয়াস করিম বলেন, নাগরিকেরা সাহস দেখাতে পারলে কাজ হবে। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে যাওয়া যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, এখান থেকে প্রস্তাব করা হোক ৫ জানুয়ারির ৯০ দিন পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ এত গভীর সঙ্কটে পড়েনি। এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বের কোথাও নেই। মঞ্জুরুল আহসান খান বলেন, আমাদের গণতন্ত্রকে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। জামায়াতকে জঙ্গি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে পশ্চিমা দেশের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, প্রকৃত গণতন্ত্র আসেনি, এসেছে স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র। সে জন্যই দুর্নীতি ও দলবাজি বাড়ছে। এর আগে ঢাকায় আয়োজিত এক নাগরিক আলোচনায় তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর বলেছিলেন, দেশ এখন গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়েছে। এটি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে আরো বেশি খারাপ। সত্যিকার অর্থে দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। আমরা এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে খারাপ গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে আছি, গত কদিনে আমরা টের পেয়েছি।
 
মোট কথা সঙ্কটে বাংলাদেশ : নাগরিক ভাবনাশীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া ৫৫ জনের বক্তব্যে মোটামুটি সবাই এক সুরে বলছিলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে। এ নির্বাচন দেশকে আরো অশান্ত করে তুলবে, রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে, দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ধ্বংস করে দেবে, অর্থনীতির চাকা অচল করে দেবে, দেশে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত-বিভাজন বাড়িয়ে তুলবে। অতএব ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বন্ধ করে অবিলম্বে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। এর বিপরীতে এ আলোচনায় রাশেদ খান মেনন একটু ভিন্ন সুরে কথা বলতে চাইলে অনুষ্ঠানে নো নোবলে অনেকে প্রতিবাদ করেন। পরে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে উত্তেজনা কমে আসে। রাশেদ খান মেনন তার বক্তব্যে বলেন, এই নির্বাচনই সঙ্কট নয়। দেশটা জঙ্গিবাদী তালেবানি রাষ্ট্র হবে কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। এখানে নির্বাচন স্থগিতের কথা বলা হচ্ছে। কেউ হরতাল ও অবরোধের বিরুদ্ধে বলেননি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই আলোচনায় যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে কেউ কথা বলেননি।
বুঝতে অসুবিধা হয় না বর্তমান সরকারের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন আসলে ুব্ধ এ কারণে যে, এ সংলাপে অংশ নেয়া সবাই এক বাক্যে বলেছেন ৫ জানুয়ারির প্রহসনের ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন, বিরোধী দলবিহীন একতরফা নির্বাচন অবিলম্বে বন্ধু করতে হবে। সরকার-বিরোধী দলের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সবার কাছে অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে যেতে হবে সরকারকে। এর মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। আসলে গোটা জাতিও তাই মনে করে, শুধু বর্তমান সরকারি দল ও তাদের শরিক দলগুলো ছাড়া। তাদের বিশ্বাস র‌্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনী দিয়ে জোর-জবরদস্তি করে একটা নির্বাচন করতে পারলেই কেল্লাফতে। এরপর দমন-পীড়নের স্টিম রোলার চালিয়ে ২০২১ সাল নয়, ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা যাবে সংবিধানের দোহাই দিয়ে। সমালোচকেরা বলছেন, সে বিশ্বাসে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপকল্প ২০২১কে সম্প্রসারিত করে রূপকল্প ২০৪১। আসলে জনমতের বাইরে গিয়ে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার দিবাস্বপ্ন দেখা যায়, বাস্তবে তা ঘটে না। বরং ব্যর্থতার বোঝা শুধু বাড়ে। কারণ জনগণের চাওয়া-পাওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে নেতির সড়ক ধরে চলা। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকেই অবলম্বন করে চলা। আমাদের সরকার সেই নেতির সড়ক ছেড়ে ইতির সড়কে না আসার জন্য যেন ধনুকভাঙা পণ করে বসে আছে। ফলে জাতি আজ ধ্বংসের চূড়ান্তপর্যায়ে এসে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে। এর পরও যদি সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনে ভুল করে, তবে আমাদের দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আন্দাজ-অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আবারো মনে করিয়ে দিই, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার নামই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads