শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৩

তারানকোর ব্যর্থ মিশন এবং আওয়ামী লীগের লক্ষ্য


উদ্দেশ্য অতি মহৎ হলেও বাংলাদেশে এসে খুবই তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছিল জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে। ছয়দিনের ঝটিকা মিশন শেষ করে ১১ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে ফিরে গেছেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থার মীমাংসা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে দূতিয়ালী করতে এসেছিলেন তারানকো। ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আসার পর থেকে খুবই ব্যস্ত সময় কেটেছে তার। সাফল্যের আশায় সফরের সময়ও বাড়িয়েছিলেন ২৪ ঘণ্টা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে পালাক্রমে বৈঠক করেছেন তিনি। ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি হলেও কোনো পক্ষই সহজে মুখ খোলেননি। শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল যেন বরফ গলতে শুরু করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে দল দুটির চারজন করে শীর্ষ নেতা তিনবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। ব্যাপক তৎপরতা চলেছে পর্দার আড়ালেও। প্রথমবারের মতো মুখ খুলতে গিয়ে মিস্টার তারানকো বলেছিলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতামুখী সদিচ্ছা এবং ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে সমস্যার জট খোলা সম্ভব হতে পারে। কথাটার মধ্যে সংশয়ের উপাদান থাকলেও একের পর এক বৈঠকের পাশাপাশি মহাসচিবের বিশেষ দূত তার সফরের সময় বাড়ানোর ফলে নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু পরিষ্কার হয়েছে ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিদায়পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে। সমঝোতামুখী চেষ্টা শুরু হয়েছে, প্রধান পক্ষগুলো আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন এবং এর মধ্যদিয়ে সমাধান বেরিয়ে আসবে ধরনের খবর জানানোর বাইরে সুনির্দিষ্টভাবে এমন কোনো তথ্যই মিস্টার তারানকো জানাতে পারেননি, যার ভিত্তিতে জনগণ আশান্বিত হতে পারে। এরই পাশাপাশি ছিল অন্য কিছু বিশেষ কারণও। আগেরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়ে যাওয়া ছিল এরকম প্রথম কারণ। এর  মধ্যদিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মতপার্থক্যের দিকটিই আসলে প্রাধান্যে এসেছিল। অন্তরালের কারণ জানাজানি হতেও দেরি হয়নি। বলা হয়েছে, মিস্টার তারানকো নাকি রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এবং সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করতে হলে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হতো। অমন কোনো প্রস্তাব মেনে নেয়ার চিন্তা পর্যন্ত করতে সম্মত হননি ক্ষমতাসীনরা। মূলত সে কারণেই মিস্টার তারানকোকে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিদায়ের আগে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেও রাজি হননি তিনি। এজন্যই কি না সেটা একটি গুরুতর প্রশ্ন বটে কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সেদিনই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তারা  ঠিক কি বলেছেন সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানা না গেলেও এই খবর বেরিয়ে এসেছে যে, বান কি মুন এবং জন কেরি দু’জনই সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন।
অমন তাগিদ অবশ্য নিজের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য জেদ ধরে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীর মোটেই ভালো লাগার কথা নয়। ভালো যে লাগেনি তার প্রমাণ পাওয়া গেছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ কয়েকজন নেতার বক্তব্যে। মিস্টার তারানকো যেদিন সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদের কথা শুনিয়ে বিদায় নিয়েছেন সেদিন সন্ধ্যায়ই মোহাম্মদ নাসিমরা ঘোষণা করেছেন, নির্বাচন নির্ধারিত তারিখে অর্থাৎ ৫ জানুয়ারিই অনুষ্ঠিত হবে এবং সেটা হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনেই। বুঝতে বাকি থাকেনি যে, প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। অন্য একটি বিষয়ও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মিস্টার তারানকোর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোতে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের কোনো সিনিয়র নেতাকেই সেদিন আর দৃশ্যপটে দেখা যায়নি। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তোফায়েল আহমদ ও আমির হোসেন আমুর পরিবর্তে ঘোষণার আকারে সিদ্ধান্ত শুনিয়েছেন মোহাম্মদ নাসিম এবং মাহবুব উল আলম হানিফরা। তারা এমনকি বিরোধী দলের অবরোধসহ আন্দোলন দমনের জন্য ‘কম্বিং অপারেশন’ চালানোর হুমকিও দিয়েছেন। এভাবে সব মিলিয়েই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যতো বৈঠকই করে থাকুন না কেন, সবই আসলে নিষ্ফল হয়েছে। তাছাড়া সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা এখনও প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে। বড়কথা, তিনি চান না, বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী কোনো নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হোক এবং সে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। প্রধানমন্ত্রী এমনকি তার নিজের দলের রাষ্ট্রপতিকেও নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিতে সম্মত নন । পদটিতে তাকেই থাকতে হবে!
বলার অপেক্ষা রাখে না, মূলত ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই কঠোর এবং অনমনীয় মনোভাবের কারণেই জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছেÑ যদিও শেষ পর্যন্তও ব্যর্থতার কথাটা তিনি স্বীকার করতে চাননি। অন্যদিকে বান কি মুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যেমন দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন, বিএনপিও তেমনি মিস্টার তারানকোর তথা মহাসচিব বান কি মুনের মান বাঁচানোর জন্য খোলামনে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সব চেষ্টাকেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী নেতাদেরও অসম্মানিত করে ছেড়েছেন। সেটা তিনি করতেই পারেন কিন্তু একটি কথা ভুলে যাওয়ার বা পাশ কাটানোর পরিণতি অশুভ হয়ে উঠতে পারে। সে কথাটা হলো, বান কি মুন এমন এক সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব যার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নানামুখী দায়বদ্ধতা রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সুযোগ পাওয়া-না পাওয়ার মতো অনেক বিষয়ই রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার বা পরিবর্তন ঘটার মতো অন্য কিছু বিষয়ও জড়িয়ে পড়তে পারে, যার পরিণতি ক্ষমতাসীনদের জন্য শুভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বলা দরকার, বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সরকারের নীতি-মনোভাব ও কর্মকা-ের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষেত্রগুলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জাতিসংঘ মহাসচিবকে প্রত্যাখ্যানের মূল কারণ নিহিত রয়েছে ক্ষমতাসীনদের সামগ্রিক ব্যর্থতা ও অশুভ উদ্দেশ্যের মধ্যে। কোনো একটি ক্ষেত্রেই সরকার জনগণের আশা-আকাংক্ষা পূরণ করার ধারে-কাছে যেতে পারেনি। আসলে যায়নি। এর কারণ, নির্বাচনের আগে নানাভাবে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তেমন ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না। ভেতরে ভেতরে তারা অন্য কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চিন্তা বা সদিচ্ছা অন্তত ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে। সে প্রমাণ এখনো পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের বেআইনী পদক্ষেপ এবং র‌্যাব-পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের হামলায় বিরোধী কোনো দল মিছিল-সমাবেশ পর্যন্ত করতে পারেনি, এখন তো আরো পারছে না। গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি বাড়ছে মিথ্যা মামলার সংখ্যা। ওদিকে গণতন্ত্রের প্রধান কেন্দ্র জাতীয় সংসদকে পঙ্গু করা হয়েছে প্রথম অধিবেশন থেকে। সুচিন্তিত কৌশলের ভিত্তিতে বিরোধী দলের এমপিদের বাইরে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করেছেন ক্ষমতাসীনরা। পরিষ্কার হয়েছে, জাতীয় সংসদের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ ছিল না ক্ষমতাসীনদের। রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রকেও একেবারে তছনছ করে ফেলেছে সরকার। জনপ্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রই দলীয়করণ নীতির অসহায় শিকার হয়েছে। বিচার বিভাগ তথা আইন-আদালতকে তো ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ারই বানিয়ে ফেলেছে সরকার। গণতন্ত্রকে তারা নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এভাবেই চূড়ান্ত স্বৈরশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা অবশ্য শেখ হাসিনার নিজের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকা-ে মোটেও বিস্মিত হননি। কারণ ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সংগ্রামী’ দল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এ ধরনের পন্থাই নিয়েছে। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। তখন সভাপতি ছিলেন মরহুম আবদুল মালেক উকিল। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৫ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, যেন চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকা- পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলটি আরো একবার চার দফা পূর্বশর্ত উপস্থাপন করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড়কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে দলটি গুরুতর দুটি প্রতারণা করেছিল। প্রথমটি ছিল পূর্বশর্ত পূরণ করার প্রশ্নে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণ না করা হলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। সে ঘোষণা এসেছিল ‘চরমপত্র’ আকারে। কিন্তু পূর্বশর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও ১৯ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলের প্রার্থী হয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। প্রতারণার দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দ-াদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের আত্মীয়-স্বজনরা সে সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগ অনশনরতদের আশ্বাস দিয়েছিল, দ-াদেশ বাতিল না করা হলে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই ঘোষণা সত্ত্বেও অনশন ভাঙানোর একদিন পরই শেখ হাসিনা নির্বাচনে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ওদিকে মৃত্যু দ-াদেশ কার্যকর করা হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৮১)।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। অবৈধ সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পাঁচ দফা এবং চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেবার সংসদে ৭৬টি আসনসহ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়েছিলেন।
প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। কারণগুলোর কোনো কোনোটি ‘বড়ো দল’ আওয়ামী লীগের জন্য অসম্মানজনকও বটে। পাশাপাশি রয়েছে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্যের বিশেষ দিক। সে বৈশিষ্ট্য দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা- কখনো একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া। ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্রের জন্য পরিচালিত সে আন্দোলনে ছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী। আন্দোলনের আড়ালে শেখ হাসিনা সে সময় আওয়ামী লীগের বহুবার ব্যবহৃত কৌশলই অবলম্বন করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাত দলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। কারণ প্রেসিডেন্ট এরশাদ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে সকলের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরো একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নবেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটতো। জামায়াতে ইসলামীর এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা দরকার। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সকল বিরোধী দলও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। পরিবর্তে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল এমন দু’জন মাত্র নেতাকে, যাদের সঙ্গে সামরিক শাসক এরশাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের যথারীতি শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নাম সর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। আসলেও কথাটা কঠিন সত্য। ২০০১ সালের নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোট সরকারকে ‘ফেলে’ দেয়ার বহু চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণ তার সমর্থনে এক পা-ও এগিয়ে অসেনি। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনো আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বারবার স্থাপন করেছিলেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে কখনো সাড়া দেয়নিÑ তারা শেখ হাসিনার মতো জোট সরকারের পদত্যাগ রোগে আক্রান্ত হয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নাম সর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। জোট গঠনের এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রকৃত পক্ষে আওয়ামী লীগের অক্ষমতা ও জনসমর্থনহীনতার কথাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই ‘সততা’ ও ‘সদিচ্ছা’ আওয়ামী লীগেরÑ বিশেষ করে নেত্রী শেখ হাসিনার!
এমন অতীত রয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যাপারে সামান্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকেও খালি হাতি ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুনতে চাচ্ছেন না  মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির পরামর্শও। দেশের সচেতন সকল মহলে উদ্বেগও ছড়িয়ে পড়ছে একই কারণে। বোঝাই যাচ্ছে, শেখ হাসিনার মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সদিচ্ছা মোটেও নেই। তিনি বরং সবদিক থেকে তার পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সেই সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বাকশাল আসলে কতটা ভয়ংকর ছিল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads