মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

হরতাল-অবরোধ চলছে

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 
 আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি-নেতাদের মুখে আমরা বহুবার বলতে শুনেছি যে, ১৮ দলীয় জোট কোনো আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারবে না। সে মুরোদ তাদের নেই। আর ১৮ দলীয় জোট কি করলো না করলো এতে তাদের কিছুই আসে যায় না। এই নেতারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি যে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কী মনোভাব জারি আছে এই সরকার সম্পর্কে। সরকারের অপশাসন, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে কতোটা ক্ষুব্ধ, সেটা তারা অনুভব করতে পারেননি। আর সম্ভবত তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, জনগণ কোনো ফ্যাক্টর-ই না। তারা ভেবেছিলেন, শেখ হাসিনা যদি এখনই গোটা জাতিকে কান ধরে উঠবস করতে বলেন, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ কান ধরে উঠবস করতে শুরু করবেন।
কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকম নয় বা নেই। ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে স্লোগান এই সরকারের বিরুদ্ধে দিয়েছিলেন তা হলো ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’। আজ কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগ ঢাকা শহরে মাইক বাজানোর যে কর্মসূচি নিয়েছে তাতে কেবলই বলা হচ্ছে যে, ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’। আসলে দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে হলে এই দুঃসহ সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা নিজেকে সম্রাজ্ঞী ভেবে এর উল্টো পথ ধরেছেন। তিনি যে সম্রাজ্ঞী নন, এই বোধও তার বিলুপ্ত হয়েছে। এ দেশের মানুষ যে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলো তার লক্ষ্য ছিলো গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। শেখ মুজিবকে সম্রাট বানানোর জন্য নয়। অতএব, শেখ হাসিনাও পদাধিকার বলে কোনো সম্রাজ্ঞী নন।
শেখ মুজিবুর রহমানও নিজেকে সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আর সেই লক্ষ্যে তিনিও সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল গঠন করেছিলেন। আর নিজেকে অনন্তকালের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেটাও তিনি করেছিলেন জাতীয় সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। সেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি অর্জন করেছিলেন একেবারে গায়ের জোরে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন যাদের নির্বাচিত বলে ঘোষণা করেছিলো, তিনি তা বাতিল করে দেন। আর নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করেন ঘোষিত ফলাফল উল্টে দিতে। সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিলো। বর্তমান সরকারের মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এই কারচুপির জন্য তখন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অনেক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ইতিহাসের আশ্চর্য পাঠ তিনি এখন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার খুব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন। এখন যে লেনিন আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরা, তখন এই লেনিনও শেখ মুজিবকে নিয়ে নানা কটূক্তি করেছেন।
ক’দিন আগেও তোফায়েল আহমেদ গং আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, তাকে লেনিনদের অধীনে রাজনীতি করতে হবে? লেনিনরা ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নে। তোফায়েল আহমেদ গং ছাত্রলীগে। তাদের দ্বন্দ্ব চরমে ছিলো। সে দ্বন্দ্ব নিজ চোখে দেখেছি। এই যে, শিরিন আক্তার এখন আওয়ামী লীগের পতাকাতলে। তাকেও লাঞ্ছিত হতে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলা ভবন থেকে তিনি বেরিয়ে আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর দিকে। ছাত্রলীগাররা তাকে ঘেরাও করে এই মারি, এই ধরি-এ রকম হল্লা-চিল্লা করছিলো। তিনি ছিলেন জাসদের ছাত্রলীগে। তবে তখনও ছাত্রলীগাররা অতো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি। বোধকরি, তাদের কিছুটা শালীনতা ছিলো। যদিও প্রেসক্লাবের সামনে তারা মতিয়া চৌধুরীর পরনের শাড়ী খুলে নিয়েছিলো। প্রায় বিবস্ত্র মতিয়ার সে ছবি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিলো। এখন তারাই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে অপশাসনের সহযাত্রী।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের জোরজবরদস্তি ও কারচুবির নির্বাচনে অর্জিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শেখ হাসিনাও এখন তাই করার চেষ্টা করছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মিলে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতায় বসায়। ইকনোমিস্ট লিখেছিলো, ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ড. ইউনূস ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কীভাবে তারা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। সে টেলিফোন সংলাপ বিশ্ববাসী জেনে গেছে। আর ঐ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলিল পরে বলেছিলেন যে, ঐ নির্বাচন ছিলো আঁতাতের নির্বাচন। সেখানে কোনো কেন্দ্রে ১০০ ভাগেরও বেশি ভোট পড়েছিলো। ১২০ ভাগ, ১১২ ভাগ। এই প্রশ্ন যখন উত্থাপন করা হলো তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা ফরমান জারি করে বললেন যে, এই প্রশ্ন ও প্রমাণ যে উত্থাপন করবে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কী স্বচ্ছ নির্বাচন!
ঐ নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেনকে টেলিভিশনে অনেক জ্ঞান দান করতে দেখি। কিন্তু তখন তিনিও ছিলেন ঐ আঁতাতের নির্বাচনে একজন অনুষঙ্গী। অবাক হই কী না ঘটে এই বাংলাদেশে। যদি এখনকার মতো তেমন সৎ মানুষ-ই তিনি হতেন তাহলে ঐ কমিশন থেকে তখন তিনি পদত্যাগ করতেন। গাছেরটা খেয়েছেন এখন তলেরটা কুড়াচ্ছেন।
যাই হোক, ঐ নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়া হয়, তারই জোরে তিনি পুনরায় যেনো সেই বাকশাল-ই কায়েম করতে চাইছেন। তিনি বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকে হাস্যকর সব অভিযোগে আটক করে কারাবন্দী করেছেন। অত্যাচার নির্যাতনের তো কোনো সীমাই নেই। তারপর ভেবেছেন, তাদের কারাবন্দী রেখেই নামকাওয়াস্তে একটা নির্বাচন করে তিনি ক্ষমতায় আসীন থাকবেন। আর বিরোধী দল আন্দোলন করছে তেমন নির্বাচনের বিরুদ্ধে।
এক্ষেত্রে তিনি অনুধাবনই করতে পারেননি যে, সরকারি দল, বিরোধী দল এর বাইরেও আরো একটি ফ্যাক্টর আছে। আর তা হলো জনগণ। পার্লামেন্ট থেকে জো হুজুর সদস্য আর কিছু স্তাবক ছাড়া এটাই যে ফ্যাক্টর নয়, সেটি উপলব্ধি করার বোধশক্তি সরকারের নেই। শেখ হাসিনা মনে করেন, জনগণ আবার কী!  তিনি যা বলবেন, জনগণ তা মেনে নিতে বাধ্য। তার কথার বাইরে কথা নাই। যেনো ‘কানু বিনা গীত নাই।’ সম্ভবত সে কারণেই শেখ হাসিনা ও তার লোকেরা এমন লাফাচ্ছেন। কিন্তু জনগণের গীত ভিন্ন রকম। জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে কখন-ই ভুল করে না এবং জনগণ কারো পরোয়াও করে না।
বিরোধী দল যখন বললো, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে না আনলে তারা জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। তখন আওয়ামী নেতারা অনেক বিদ্রƒপ করলেন। এমনকি একথাও বললেন যে, বিরোধী দলের এই আন্দোলনের প্রতি জনগণের কোনো সমর্থন নেই। তারপর বিরোধী দল দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দিলো। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারাদেশের রাজপথ-রেলপথ-নৌপথ অচল করে দিলো। আজ প্রায় মাসখানেক ধরে সরকার ঢাকায় বন্দী। অগ্রজ এক সিনিয়র সাংবাদিক এই সত্য মাথায় রেখে যথার্থই বলেছেন যে, এখন আর বর্তমান সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নেই। হয়ে গেছে গণপ্রজাতন্ত্রী ঢাকা সরকার। এখন রাজধানী ঢাকার বাইরে কোথাও কোনো সরকার নেই। প্রশাসন নেই। সব কিছুই জনগণের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সরকারের ফটর ফটর করা মন্ত্রী, নেতারা ঢাকার বাইরে কোথায়ও যেতে পারছেন না। তাদের যেতে হচ্ছে হেলিকপ্টারে চড়ে। শেখ হাসিনার নিজেকেও।
কারণ জনগণকে মোকাবিলা করার শক্তি সরকারের নেই। সাহসও নেই। শেখ হাসিনা অনড় আছেন যে, ৫ জানুয়ারি তিনি নির্বাচন করেই ছাড়বেন। সঙ্গে থাকবে তার বহুদিনের মিত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি ছিলো। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখা গেলো, জাতীয় পার্টিকে যতোসংখ্যক আওয়ামী লীগের ছাড় দেবার কথা ছিলো ততোটা ছাড় তারা পাচ্ছে না। কথা সম্ভবত ছিলো এই যে, যেসব আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয়ার কথা, সেসব আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেবে না। কিন্তু দেখা গেলো, ২৯৭টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে। জাতীয় পার্টির হিসাব-নিকাসে ধাক্কা খেলো তখনই। এরশাদ সাহেব বুঝতে পারলেন যে, এরকম নির্বাচনে গেলে গণধিকৃত তো তিনি হবেন-ই, সেই সঙ্গে কার্যকর কোনো ভূমিকাও রাখতে পারবেন না। বরং এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে তার যতোটুকু অস্তিত্ব আছে সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যই হলো তারা কথা রাখে না। ফলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রণে ভঙ্গ দিলেন। তিনি সরে এলেন নির্বাচন থেকে।
এখন একদলীয় নির্বাচন। শেখ হাসিনা সে পথেই এগুচ্ছেন। এ নির্বাচন তিনি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও সংশয় আছে। সে ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যাকে খুশি তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করিয়ে নিতে পারবেন। কোনো প্রার্থী এলাকায় যেতে পারবেন না। একদলীয় নির্বাচনে তার দরকারও হবে না। সরকার অবরুদ্ধই থাকবে ঢাকা নগরীতে। তারপর জনগণ দড়ি ধরে দেবে টান, সরকার হবে খান খান।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads