মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

সময় থাকতে ১৮ দলের দাবি মেনে নিন


দেশের মানুষ এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল (রাজনৈতিক) অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দিকে অনেক আশায় বুক বেঁধে তাকিয়ে রয়েছে। গতকাল তিনি সফরের মেয়াদ ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়েছেন। ব্যস্ততাও বেড়ে চলেছে তার। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী ছাড়াও বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠক করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গেও। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তো দফায় দফায় বসেছেনই। ঝানু এই কূটনীতিক অবশ্য কথা বলেছেন মাত্র একবার। গত সোমবার তিনি বলেছেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতামুখী সদিচ্ছা এবং ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে সমস্যার জট খোলা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত এসেই থেমে পড়েছেন তারানকো। আশাবাদী হয়ে ওঠা জনগণও তাই থমকে গেছে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, ১৮ দলীয় জোটের ডাকে চলমান অবরোধে গত মাসের ২৬ তারিখ থেকেই অচল হয়ে পড়েছে সারা দেশ। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর যথারীতি চলছে প্রচ- দমন-নির্যাতন। পুলিশ র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি আওয়ামী গু-া-সন্ত্রাসীদের হামলায় এ পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি আন্দোলনকারী এবং নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। দমন-নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি ভাংচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা তাই বলে সফল হচ্ছে না। জনগণ বরং সরকারের দিকেই আঙুল ওঠাচ্ছে। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রে উস্কানি ও হামলা আসছে সরকারের পক্ষ থেকে। এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে পেয়ে জনগণের আশান্বিত হয়ে ওঠার কারণ নিয়ে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার দরকার পড়ে না। বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটের মীমাংসা করার ঘোষণা দিয়েই তিনি ঢাকায় এসেছেন। তাছাড়া নিজে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হলেও এসেছেন তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘বিশেষ দূত’ হিসেবে। এই পরিচিতির অর্থ, তারানকোকে সামনে রেখে তৎপর হয়েছেন আসলে বান কি মুন নিজেই। স্মরণ করা দরকার, এবারই প্রথম নয়, এর আগেও রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সমঝোতা ও সংলাপের আহ্বান জানিয়ে দুই নেত্রীর কাছে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন তিনি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। সে সময়ও দুই নেত্রীর জন্য মহাসচিবের দুটি চিঠি নিয়ে বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকা সফরে এসেছিলেন মিস্টার তারানকো। তিনিও দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমির কারণে তারানকোর চেষ্টা সফল হতে পারেনি। এরপর ২৩ আগস্ট বান কি মুন দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় সমঝোতা আলোচনার জন্য তাদের দু’জন করে প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সম্মত হলেও প্রধানমন্ত্রী রাজি হননি বলে বান কি মুনের সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। মহাসচিব অবশ্য তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ঘনীভূত সংকটের মধ্যেই ক্ষমতাসীনরা একদলীয় নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বান কি মুন আবারও তার একই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন।
এদিকে মিস্টার তারানকোর সম্ভাব্য সাফল্যের সামনেও ক্ষমতাসীনরাই যথারীতি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন বলে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে। তারা নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রাখার জন্য জেদ ধরে বসে আছেন। এ যেন সেই ‘সালিশ মানি কিন্তু তাল গাছটা আমার’ ধরনের অবস্থা! অথচ কে না জানে যে, শেখ হাসিনাই রয়েছেন সব সমস্যার মূলে। আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য তার অনড় মনোভাবের কারণেই দেশী-বিদেশী সব মহলের সব চেষ্টাই এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে সংকটের সূচনা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ছাড় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের নাম যে কোনো কিছু হতে পারে কিন্তু ওই সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল থাকতে পারবেন না। তার অধীনে কোনো নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট অংশ নেবে না। বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া ছাড় এবং ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থনের বিষয়টি এরই মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অবরোধে সারা দেশই শুধু অচল হয়ে পড়েনি, বেশির ভাগ জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও সরকার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনমতের প্রতি সম্মান দেখানোর নাম করছেন না। নির্বাচন কমিশনও সরকারের সেবাদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে এসব কারণে। মিস্টার তারানকোর মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগও তাই সহজে সফলতার মুখ দেখতে পারছে না।
আমরা মনে করি, একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে যেতে চাওয়াটাই শেষ কথা হতে পারে না। কারণ, জনগণ তো সবকিছু দেখছেই, ওদিকে জাতিসংঘের পাশাপাশি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও গণচীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোও যারা চায়, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট অংশ না নিলে কোনো নির্বাচনই যে গ্রহণযোগ্য হবে না সেটাও বিভিন্ন উপলক্ষে জানিয়ে রেখেছে তারা। সুতরাং সময় একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের উচিত একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ থেকে ফিরে আসা। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, মিস্টার তারানকো এসেছেন সেই জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে যে সংস্থাটির সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নানামুখী দায়বদ্ধতা রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিমিশনে সুযোগ পাওয়া-না পাওয়ার মতো বিশেষ কোনো প্রসঙ্গের উল্লেখ না করেও বলা দরকার, বান কি মুনের উদ্যোগ ও পরামর্শকে প্রত্যাখ্যান করার পরিণতি শুভ হওয়ার সুযোগ নেই। বেগম খালেদা জিয়া আগেই ছাড় দিয়ে রেখেছেন বলে বর্তমান পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক সাড়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করতে চাই, একদলীয় নির্বাচনের চেষ্টা পরিত্যাগ করে সমঝোতার মাধ্যমে তিনি সংবিধানে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করতে উদ্যোগী হবেন। সব দল অংশ না নিলে কোনো নির্বাচনই যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না মিস্টার তারানকো আসলে সে কথাটাই বুঝিয়ে বলতে এসেছেন। তাকে তাই শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়া উচিত নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads