সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

একতরফা নির্বাচনের রেলগাড়িটি থামতেই হবে


দেশ আজ চরম রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনা চাচ্ছেন সংবিধানের ১৫তম সংশোধন মোতাবেক তার প্রধান মন্ত্রীত্বের অধীনে নির্বাচন হতেই হবে। কিন্তু বিগত ৫ বছর যাবত সংসদের ভিতরে ও বাইরে বিরোধী দলের সাথে যেসব অসাংবিধানিক আচরণ তিনি করে এসেছেন, তাতে বিরোধী দল তাকে মোটেই আস্থায় আনতে পারছে না। তাদের ও দেশের অধিকাংশ জনগণ মনে করেন শেখ হাসিনা বাকশালী কায়দার নির্বাচন করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নেবেন। নির্বাচনটি হবে প্রহসনমূলক। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক যে অবক্ষয় শেখ হাসিনার সরকার করেছে তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনে তার ক্ষমতায় আসা একেবারে অসম্ভব। সরকারের অনুগত একটি জনবহুল দৈনিক পত্রিকার হালে এক জরিপে দেখা যায় শেখ হাসিনার মহাজোট পেতে পারে শতকরা ২৭ ভোট, আর বিএনপি ও তার সহযোগীরা পেতে পারে শতকরা ৬৩ ভাগ ভোট। তাই তার মেজাজে অগ্নিশর্মা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে নির্বাচন দিতে পারলে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। তাই তিনি বার বার হুঙ্কার ছেড়ে বলে যাচ্ছেন, নির্বাচনে সংবিধানের একচুল নড়চড় হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের চেহারা আজও জনগণ ভুলতে পারছে না।
তার গোয়ার্তুমিতে বাংলাদেশের রাজনীতি বিগত ৬ মাস যাবত অত্যন্ত উত্তপ্ত। হরতাল, অবরোধে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কয়েকশ লোক নিহত, হাজার হাজার আহত ও লাখের ওপর লোক জেলহাজতে পুরছে। বলতে গেলে প্রতিদিন যেমন জনবলের ক্ষয় হচ্ছে তেমনি জ্বালাও-পোড়াওতে জাতীয় সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে  পড়ার উপক্রম। সাধারণ জনগণ আজ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। এখন শুধু বিরোধী দলের কর্মীরাই মার খাচ্ছে নাÑ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জনগণের হাতে মার খাচ্ছে। সরকারের অবৈধ আদেশ-নিষেধ মানতে গিয়ে আজকে তারাও নাজেহাল। মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচার করে কি শেখ হাসিনা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন?
এটা ১৯৭৩ সাল নাÑ এটা ২০১৪ সালের নির্বাচন। দেশের জনগণ যথেষ্ট সচেতন। গায়ের জোর খাটিয়ে, অবৈধ ভোট প্রদান ও ভোটবাক্স দখল করে বেশিদূর এগোতে পারবে না। এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীর মাথায় রাখা উচিত। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা বৃটেন নয়। সে দেশে সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে তারা শত শত বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে বলে। নির্বাচনের সময় তাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দলের এমন চুলাচুলি ও রক্তারক্তি নেই। এখানে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা তার দলীয় স্বার্থের কারণে তা বিচার বিভাগের নির্দেশনার দোহাই দিয়ে বিরোধী দলকে বাদ রেখে সংসদে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। অথচ বিচার বিভাগের রায়ে এও উল্লেখ ছিল যে, পরবর্তী ২টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তা তিনি মোটেই আমলে নিলেন না। অথচ বিশ্বের কয়েকটি রাষ্ট্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। হালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। থাইল্যান্ডে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে সেখানেও বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাস করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইংলাককে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। আর শেখ হাসিনা একটি গড়ে ওঠা সংস্থা ও ভাল কাজ করা সত্ত্বেও তার দলীয় স্বার্থে একতরফাভাবে ব্রুট মেজরিটি পার্লামেন্টে সদস্যদের দ্বারা বাতিল করে দিলেন। জনগণ ও বিরোধী দল এটা মেনে নিতে পারেনি বলেই তো এত আন্দোলন। শেখ হাসিনার দলের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পক্ষপাতি ছিলেন না। একজনের এক কথা তার কাছে তারা শেষে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন।
দেশের মধ্যে এত অরাজকতা ও নৈরাজ্যের মধ্যে কিভাবে সাধারণ নির্বাচন হবে? বাংলাদেশের মানুষসহ বিদেশী রাষ্ট্রসমূহও শঙ্কিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হাসিনা সরকারকে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সাপেক্ষে নির্বাচন দেয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকায়ও হাসিনা সরকারের একতরফা নির্বাচনের কঠোর সমালোচনা করে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের ভরসাস্থল হলো জাতিসংঘ পরিষদ। তার সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে ফোনালাপ করেছেন, পত্র দিয়েছেন। সাথে সাথে তার সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকা পাঠিয়েছেন তিনবার।
সর্বশেষ বারে তার সাফল্য এতটুকু যে দুই দলকে আলোচনার টেবিলে বসাতে সক্ষম হয়েছেন। দুই দলের ইতোমধ্যে ৩টি বৈঠক হয়েছে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনের মারাত্মক জটিলতার ক্ষেত্রে দূরতম আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে হলেও নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তার সুরাহা হলে জাতি এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হয়তো শেখ হাসিনাও নমনীয় হতো। কিন্তু বাইরের একটি বড় শক্তি হাসিনাকে নানা কূটবুদ্ধি দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করছে বলে অভিজ্ঞজনের অভিমত। ভারত মূলত শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ নিয়ে তাকে কিভাবে নির্বাচনে জয়ী করা যায় তার কূটকৌশল চালাচ্ছে। সর্বশেষ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফর করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এরশাদ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্র হাসিনা সরকার না করলে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। এ নিয়ে বিগত দুই সপ্তাহ যাবত যে কূটচাল চলছে তাতে সাধারণ মানুষ ভীষণ চিন্তার মধ্যে আছে। কারণ মানুষ জানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ডিগবাজি খেতে সময় লাগে না। হাসিনা তাকে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দেখতে চায় এবং বিশ্বকে জানাতে পারবে যে, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দেশের রাজনৈতিক চরম নৈরাজ্য পরিবেশের মধ্যে হাসিনা সরকার বিতর্কিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে সারা দেশে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ ধরনের অর্বাচীন সিদ্ধান্ত হাসিনার নির্বাচনে লাভ না হয়ে ক্ষতিই হয়েছে। তার প্রতি জনগণের যৎকিঞ্চিত সমর্থন ছিলো তাও কর্পূরের মতো উবে গেলো বলে ঝানু রাজনীতিবিদদের মত। দেশ যেখানে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, পুলিশ-র‌্যাব পাখির মতো গুলী করে মানুষ মারছে, ধ্বংসাত্মক জ্বালাও-পোড়াও চলছে, গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে, আগুন দেয়া হচ্ছে; সে সময় এই ফাঁসি কার্যকর করা আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সারা দেশে তার আলামত ছড়িয়ে পড়েছে। এ আগুন কবে থামবে তা বলা যায় না। জামায়াত-শিবির এমন কোন নিয়মে চলছে না। তারা ঘোষণা না দিয়েই হরতাল, অবরোধের মতো কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যে ঝটিকা আক্রমণ চালানো শুরু করেছে, তা গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব আলামত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে হাসিনা আর গৃহপালিত পশুর ন্যায় ব্যবহার করতে পারবেন কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
 দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসিনার উচিত একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়া। অন্যথায় একতরফা নির্বাচন দিয়ে সংসদে যেতে পারলেও দেশ চালাতে পারবেন না। যে অরাজকতা শুরু হয়েছে তা যে অসুর শক্তি দ্বারা দমন করা যাবে না তার আলামত সমাজে দেখা যাচ্ছে। রাজনীতির খেলায় আর কত মায়ের বুক খালি করা হবে? কোন দমনই জনতাকে থামানো যাবে না। এহেন অবস্থায় একগুঁয়েমি ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন করুনÑ কিছুসংখ্যক সংসদ সদস্যের পদ পেলেও পেতে পারেন। আর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন না যে ‘আমও যাবে ছালাও যাবে’। দেয়ালে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করুন আপনার পদতল থেকে মাটি কিভাবে সরে যাচ্ছে। এবারের ইলেকশনে হেরে গেলেও আগামীতে ক্ষমতায় আসার সুযোগ আছে।
আর বিরোধী দলের নেতৃত্বে বেগম খালেদা জিয়াকে বলবো, আর কত অনমনীয় ভাব দেখাবেন। রাজনীতির খেলায় দেশটির আইন-শৃঙ্খলা, সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক চরম দুরবস্থাÑ ক্ষমতা পেলেও কি তা সামলাতে পারবেন? কাজেই দেশকে আর নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে দেবেন না। শেখ হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রীর গদির দাবি না ছাড়েন তাহলে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও দেশরক্ষা মন্ত্রণালয় বিএনপির হাতে সম্পূর্ণরূপে দিতে হাসিনা রাজি হলে আমার মতে তা মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া সমীচীন হবে। যতই হম্বিতম্বি শেখ হাসিনা করুক না কেন, সাধারণ মানুষ তা আমলে নেবে না। এখন আর ১৯৭৩ সালের অবস্থা নেই। সাধারণ ভোটার এখন যথেষ্ট সচেতন। ভোট দেয়ার সময় হাসিনার ঠ্যাংগারে বাহিনীর রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করবে না। তারা হিসাব-নিকাশ করেই ভোট দেবেন। তাতে বিএনপির নির্বাচনে লাভই হবে। যে কোন সমস্যার কিছু ছাড় দিয়েই সমাধানে আসতে হয়। খালেদার দাবি হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হবে। এ দাবি থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন পন্থায় সমাধান আসলে ক্ষতি কি? জাতি একটা মহা-সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। একতরফা নির্বাচনের রেল গাড়িটিকে হয়তো এভাবেই থামানো যাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads