বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩

ওদের ম্যান্ডেলা-বন্দনা প্রহসনের মতো মনে হয়


বাংলাদেশে এখন চলছে তারানকো-মিশন। এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন হয়তো তারানকো ফিরে যাবেন জাতিসংঘে। তাঁর মিশনের ফলাফলটি তখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজমান বিরোধ নিরসনে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর সফরের শেষ দিকে আমরা কিছুটা ইতিবাচক ফলাফলও লক্ষ্য করেছি। ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে সংলাপ হয়েছে। তারানকো নিজেও এ ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁর ঢাকা সফরের সময়সীমা একদিন বাড়িয়েছেন এমন চিত্রে দেশের জনগণও কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সংলাপের ইতিবাচক ঘটনার পর রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তাতে কি জনগণের আশা দুরাশার আবর্তে হারিয়ে যাবে? ওই বৈঠকের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে বিরোধী দলের সাথে আলোচনা শুরু হলেও সংবিধান ইস্যুতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একই সাথে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্যুতেও কোনো ছাড় দেবে না দলটি। এই যদি হয় সরকারি দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক কা-জ্ঞান, তা হলে তারানকো মিশন সফল হবে কেমন করে? যে কোনো সুস্থ মানুষ এ কথা স্বীকার করবেন যে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সরকার তথা সরকারি দলের ভূমিকাটাই প্রধান। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও সরকার্রে ওপরই বর্তায়। এ কারণে  সরকারের শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ ভুলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে গ্রহণ করতে হয় উদার ও ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বিরোধী দলকেও সময়ের দাবি মেনে নিয়ে তাতে সাড়া দিতে হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা তেমন কোনো চিত্র লক্ষ্য করছি না। বরং একরোখা  মনোভাব, ক্ষমতার দাপট ও চাতুর্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সরকার সঙ্কটের মাত্রা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে এবং বিরোধী দলকে বাধ্য করছে কঠোর কর্মসূচি দিতে। এতে গণতন্ত্রের বিপদ বাড়ছে, বাড়ছে জনদুর্ভোগের মাত্রাও। দেশের এমন বাতাবরণের মধ্যে বিশ্ব বাতাবরণে নেমে এলো এক শোকের ছায়া। এর কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু। এমন ঘটনায় আমাদের সরকারের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন আশা করেছিল দেশের জনগণ। এর যৌক্তিক কারণও ছিলএ প্রসঙ্গত এখানে আমরা ম্যান্ডেলার রাজনীতি ও মুক্তি সংগ্রাম প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
পাঁচ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকাা স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৫০ মিনিটে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামের এই নেতা আপন কর্মগুণে এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বনেতা। বর্তমান ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ বিশ্বে মানুষের মুক্তিসংগ্রামে ম্যান্ডেলা প্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবেন। প্রতিবাদ ও সংগ্রামের কঠিন পথে শুরু হয়ে ছিল তার যে জীবন, তা পূর্ণতা পেয়েছে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সোনালী পথে। কালো মানুষের মুক্তি সংগ্রামে ২৭ বছর কারাগারে থাকতে হয় তাঁকে। জুলুম-নির্যাতনে কখনো থমকে যাননি ম্যান্ডেলা ও তাঁর সংগ্রামী বন্ধুরা। সংগ্রাম ও শ্বেতাঙ্গ শাসকদের ওপর বিশ্ব জনমতের ক্রমবর্ধমান চাপে অবশেষে মুক্তিলাভ করেন ম্যান্ডেলা। প্রতিশোধের বদলে জাতশত্রু শ্বেতাঙ্গদের ক্ষমা করে দেন তিনি এবং ঐক্য ও সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন নতুন এক দক্ষিণ আফ্রিকা। এখানেই ম্যান্ডেলার বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য। এই সাফল্য তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন ক্ষমা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও উদারতার গুণে। আর এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার সীমানা পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বনেতা।
মানব সমাজে মত ও পথের পার্থক্য নতুন কোনো বিষয় নয়। মুক্তি সংগ্রাম কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনে দর্শন এবং রণকৌশলগত বিষয়েও ভিন্নমত লক্ষ্য করা যায়। এ নিয়ে বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র পৃথিবীর মানুষ কম দেখেনি। তবে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মীমাংসা তথা গণস্বার্থ ও গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে যৌক্তিক পরিণতির দিকে কম নেতাই যেতে পেরেছেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে নেলসন ম্যান্ডেলা এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এ কারণে সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছেনএ নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে বাংলাদেশও তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ আরো অনেকেই গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আসলে নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কেউই কার্পণ্য করছেন না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যেসব গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আমরা ম্যান্ডেলাকে সম্মান করছি, রাজনৈতিক অঙ্গনে ও ব্যক্তিগত আচরণে যদি আমরা ওইসব গুণাবলীর বিপরীত পথে চলি, তাহলে আমাদের সম্মান প্রদর্শন কতটা অর্থবহ হয়ে উঠবে? নেলসন ম্যান্ডেলার পথ ছিল ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ তথা সমঝোতার পথ। প্রতিশোধের বদলে ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ-এর চেতনায় জাতশত্রু শ্বেতাঙ্গদের ক্ষমা করতে পেরেছিলেন বলেই ঐক্য ও সমঝোতার মাধ্যমে নতুন এক দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা এখন লক্ষ্য করছি সমঝোতার বদলে হিংসা-বিদ্বেষ, বিভক্তি ও সংঘাতের অনাকাক্সিক্ষত চিত্র। এমন কর্মকা- শুধু যে দেশের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নয়, জনজীবনেও ডেকে আনছে হতাশা ও বিপর্যয়। বর্তমান সময়ে সমঝোতার অঐাবে আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না। ফলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দমন-অবদমন, জুলুম-নির্যাতন, হরতাল-অবরোধ, ককটেল-গুলী ও অগ্নিশিখায় বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের প্রিয় এই জনপদ। এখন যারা নেতৃত্বে তথা সরকারে আছেন, তারা তো নেলসন ম্যান্ডেলার মতো উদারতা ও সমঝোতার চেতনায় কাক্সিক্ষত সমাধানের পথ রচনা করতে পারছেন না। তাই আমাদের নেলসন ম্যান্ডেলা বন্দনা কতটা অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
নেলসন ম্যান্ডেলার ছায়া যে বাংলাদেশে আমরা লক্ষ্য করিনি তা কিন্তু নয়। জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান ম্যান্ডেলার মতো ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ তথা সমঝোতার চেতনায় জাতির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির চেষ্টা করে গেছেন। এ কারণেই স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যেই জাতিকে ঐক্য ও শৃঙ্খলার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন জাতির স্থপতি। আর জাতির সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করতে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এসে আমরা যেন মহান ওই দুই নেতার প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। এখন কথায় কথায় স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ও বিভক্তির আওয়াজ উচ্চারিত হচ্ছে নানা ভঙ্গিতে। অথচ যে কোনো সচেতন নাগরিকই একথা স্বীকার করবেন যে, হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভক্তির রাজনীতি দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হলেও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা কখনো পূরণ করা যাবে না। বিভক্তির রাজনীতির মাধ্যমে দেশকেও সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে এগিয়ে নেয়া যাবে না। নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর এ সময়টায় তাঁর জীবনী থেকে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ নেতারা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমাদের শীর্ষ নেতানেত্রীরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করবেন কিনা সে বিষয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে জনমনে আশাবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টির বড় সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা চলছেন ভুল পথে। তাদের আচরণে ভুলের তালিকাটি দীর্ঘ হচ্ছে। একটি মাত্র উদাহরণ দিলেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরেও নজিরবিহীনভাবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত শীর্ষ কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা ও পদমর্যাদা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা, দফতর, বিভাগ ও করপোরেশনের প্রধানের ৩৩ পদকে জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড ১ এবং ২০টি পদকে গ্রেড ২-এ উন্নীত করার প্রস্তাবে গত রোববার অনুমোদন দিয়েছে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও অনুবিভাগ শাখা এবং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক অনুমোদন আনা হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এ সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে  পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানানÑ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা না থাকলেও সরকার এখনো গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে; এমনকি নির্বাচনের দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নও হচ্ছে সমান তালে। এছাড়া কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রেও সই করা হচ্ছে তফসিল ঘোষণার আগের তারিখ দিয়ে।
এসব আচরণ সরকার তথা সরকারি দলের বেপরোয়া মনোভাবেরই প্রকাশ এবং নির্বাচনকালীন সরকারের বিশ্বব্যাপী ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী। আরও পরিতাপের বিষয় হলো, আচরণবিধি প্রণয়নের পরে তা লঙ্ঘনের অভিযোগে মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে নৈতিক কর্তৃত্ব খাটাতেও উদ্যোগী হচ্ছে না আমাদের নির্বাচন কমিশন। ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের প্রভাবের বিষয়টি প্রতীয়মান হয়। এখানে স্পষ্ট করে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ক্ষমতাসীন সরকার যদি এভাবে নির্বাচনী প্রশাসনকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং নির্বাচন কমিশন যদি তা প্রতিরোধে অক্ষমতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলে তা হলে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এতে বিরোধীদলের আন্দোলনের যৌক্তিকতাই প্রমাণিত হয়। ভাবতে অবাক লাগে, আবারো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা কতটা নীতিহীন হতে পারেন এবং জনগণের জান-মালের নিরাপত্তাকে কতটা অবজ্ঞা করতে পারেন! এরাই আবার ম্যান্ডেলার বন্দনা করেন, রাষ্ট্রীয় শোকও পালন করেনÑ বিষয়টি কি প্রহসনের মত মনে হয় না?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads