বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩

সর্বদলীয় সরকার, এরশাদ ও অনিশ্চিত রাজনীতি


বর্তমান মন্ত্রিসভাকে কোনোভাবেই সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা বলা যাবে না।  দেশের ভোটারদের মধ্যে শতকরা ৫৭ ভাগ বিএনপির সমর্থক, শতকরা ২৮ ভাগ আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং জাতীয় পার্টির সমর্থক ৭ শতাংশ। বিএনপি ছাড়া মূলত সর্বদলীয় সরকারের নামে নতুনভাবে মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভাই গঠিত হয়েছে। এটা করে সরকারপ্রধান দেশে বিরাজমান সঙ্কটকে তীব্রতর করেছেন। এই মন্ত্রিসভার অধীনে নির্বাচন হলে অবশ্যই তা প্রশ্নবিদ্ধ ও ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনটি নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করায় এবার দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এই বক্তব্য থেকেই সঙ্কটের সূত্রপাত। এ কাজটি করে সরকার আরেক দফা সংবিধানের চেতনা লঙ্ঘন করল। একতরফা নির্বাচনের জন্যই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। তা ছাড়া সর্বদলীয় সরকার সংবিধানবিরোধী।
বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে ১৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়াল বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষ মানবে কি নাÑ এ প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ২৩ নভেম্বর একটি পত্রিকায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যখন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করছেন, সেখানে  ১০ জন অনির্বাচিত উপদেষ্টা নিয়োগ দিলেন। কাজটি সম্পূর্ণ অনৈতিক।
মূল কারণ একটিইÑ এরশাদ ১৮ নভেম্বর সকালে মহাজোট থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিকেলে মন্ত্রিসভায় যোগদান করায়  এরশাদের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে। জাপা কিছু দিনের মধ্যেই আবার বিভক্ত হচ্ছে কাজী জাফরের নেতৃত্বে। এর আগেও  দ্বিধাবিভক্ত হয়। এরশাদ এখন মানুষের মধ্যে ওয়াদাভঙ্গকারী হিসেবে পরিগণিত। ডা: বি. চৌধুরী (সাবেক রাষ্ট্রপতি) ১৯ নভেম্বর  বলেছেন, এরশাদকে খুশি করতেই ব্যস্ত সরকার। সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার নবগঠিত মন্ত্রিসভাকে সর্বদলীয় সরকার বলছেন, যা অসত্য। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলের সদস্যরা এ সরকারে সম্পৃক্ত হতে রাজি না হন, ততক্ষণ এই সরকার একটি মহাজোট সরকার মাত্র। আজ্ঞাবহ শক্তিকে আবার ক্ষমতায় আনার কৌশল হিসেবে গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে পতিত  এরশাদকে। তাকে দিয়ে অন্যান্য দলকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার।  উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতনের পরে এই প্রথম জাতীয় পার্টির এত বেশিসংখ্যক মন্ত্রী একসাথে শপথ নিলেন। মন্ত্রীদের মধ্যে  সাবেক ফার্স্ট লেডিও ছিলেন, যিনি সংসদ সদস্য হয়ে গত পাঁচ বছরে তার এলাকায় একটিবারের জন্যও যাননি। পত্রিকায় সর্বদলীয় সরকারনামের এসব ন্যক্কারজনক ভূমিকাকে পত্রিকায় লজ্জাকর কাণ্ডকীর্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীই একক ক্ষমতার অধিকারী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল রাষ্ট্রপতির অধীনে। বর্তমান সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে রয়ে গেছে। এক কথায় প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্র, সংসদ, সরকারসহ সব কিছু চালাচ্ছেন। তার কথার বাইরে এক কদম যাওয়ার কারো ক্ষমতা নেই।  ’৭২ থেকেই তো এই ধারা চলে এসেছে।  পদত্যাগকারী মন্ত্রীদের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়েছেন যা বিশ্বে নজিরবিহীন। সাবেক তিনজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে মন্ত্রিসভায় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে তাদের জানা নেই। পত্রিকায় দেখলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, সংবিধানের দিক থেকে অবস্থার চরম অবনতি ঘটেছে। কারণ প্রধান উপদেষ্টার চেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরো বেড়েছে। আকবর আলি খান ও আলী ইমাম মজুমদার (সাবেক দুজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব) একমত যে, ৭০ জন মন্ত্রী এক দিকে থাকলেও তা কখনো মন্ত্রিসভার বৈধ সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হওয়ার নয়। কারণ, প্রধানমন্ত্রী একা যা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত। তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের অর্থÑ ক্ষমতার ভাগাভাগিও নয়। শাসকেরা বাংলাদেশকে যেন আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন।  সর্বদলীয় সরকার সংবিধানবহির্ভূত; কিন্তু সংবিধানের দোহাই যারা প্রতিনিয়ত দেন, তারা কি বিষয়টি ভেবে দেখেছেন?
বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট নেতার প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের প্রত্যাশা বাস্তবে গুরুত্ব পায়নি। প্রধানমন্ত্রী  ২০ নভেম্বর সংসদে বলেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত তাকেই সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতি। এ অবস্থায় ১৮ দলীয় জোটের সামনে রাজপথে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প থাকল না। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, সমঝোতার সুযোগ আর রইল না। ২০ নভেম্বর শেখ হাসিনার ভাষণের পর  রাজনৈতিক পরিস্থিতি পয়েন্ট অব নো রিটার্নেচলে গেছে।  বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ খোলা। প্রথম পথটি হলোÑ সব মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া। দ্বিতীয় পথ, আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন স্থগিত করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে সরকারকে বাধ্য করা।
কিছু দিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পতিত স্বৈরাচার এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের সাথে জোট করে। এখন সব চোর এক হয়েছে। সেই এরশাদকে সসম্মানে বরণ করে নিলেন ছয়জন মন্ত্রী এবং একজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিয়ে। ময়েজউদ্দিন, নূর হোসেন, ডা: মিলন ও দেলোয়ারদের আত্মত্যাগের অবমাননাই এটা। অবশ্য শেষাবধি, গণ-আন্দোলনের চাপে এরশাদ সরকার থেকে জাপাকে সরিয়ে এনেছেন। জানা যায়, স্বাধীনতার পর পাকিস্তান থেকে ফিরে এরশাদ তার সম্পর্কিত মামা আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম রিয়াজউদ্দিন ভোলা মিয়াকে সাথে নিয়ে ৩২ নম্বর বাড়িতে যান। মহৎ মনের মানুষ বঙ্গবন্ধু তাকে ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান। মাত্র ৯ মাসের প্রশিক্ষণে সেখানে অবস্থানকালেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও মেজর জেনারেল পদে ভূষিত হন। ৯ মাসেই দুটি উচ্চ পদে পদোন্নতি বিশ্বের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা (তথ্য সূত্র লিবারেল পার্টির চেয়ারমান সাবেক মন্ত্রী ড. অলি আহমদ সাক্ষাৎকার এসএ টিভি, ১৯-১১-১৩)।
স্বার্থের খেলা গোটা রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। এ দিকে নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছেই থাকল।
ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লিখেছেÑ (২০-১১-১৩) কোনো পক্ষে ভারতের যাওয়া ঠিক হবে না, বরং বাংলাদেশের প্রধান দুই দলকে আলোচনায় উৎসাহিত করতে আহ্বান জানানো উচিত। পত্রিকাটি মনে করে, বিএনপির নির্বাচন বর্জন কোনো সমাধান নয়; একইভাবে প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের ফল হবে অন্তঃসারশূন্য ও মূল্যহীন। এটা দেশটিকে নতুন করে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে আসন্ন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার উপায় খুঁজে বের করতে বিরোধী দলের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়। আরো বলা হয়, বিরোধী দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালত যথার্থ আইনি প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ত্রুটিপূর্ণ রায় এবং মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। মূলত বিরোধী রাজনীতিকদের দমন করতে ট্রাইব্যুনালকে আরেকটি হাতিয়ার বানানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে বাংলাদেশ সম্ভাব্য অবরোধসহ নানা চাপের মুখে পড়তে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা, মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি বন্ধ করা এবং নির্বাচন সামনে রেখে গ্রহণযোগ্য পথে সরকার বদলের উপায় খুঁজে বের করতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে কাজ করা।  হরতাল ও অবরোধমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬-এর ওপরে ধরে রাখার জন্য এ ছাড়া  শান্তিপূর্ণ বিকল্প পথ খোলা নেই বলে উল্লেখ করা হয়। মার্কিন প্রশাসনের চিন্তাভাবনা তারা এভাবেই প্রকাশ করেছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেটা ৮৬-এর নির্বাচনের চেয়েও খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে। এ জন্য দায়ী থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads