সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩

সমঝোতার বিকল্প নেই


সম্প্রতি দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে চরম বিতর্ক ও সঙ্কট চলছে। জাতি আজ বিবদমান দুই ভাগে বিভক্ত। অবরোধ হরতাল চলছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। বাড়ছে বেকারত্ব, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, গোলাগুলি, নিরপরাধ মানুষের করুণ মৃত্যু ও মামলা-মোকদ্দমা। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে দেশী-বিদেশী অনেকে। কিন্তু আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। দেশবাসী চরম হতাশাগ্রস্ত। বর্তমান যুগে গণতান্ত্রিক সরকার পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই আছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ‘ÔGreatest good for the greatest numberÕ  | ধর্মনিরপেক্ষ বললেও সব দেশে অন্তঃসলিলা নদীর মতো রাজনীতিতে ধর্ম থাকে। এ জন্য সংখ্যাগুরু জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হওয়া কাম্য, যা নির্ধারিত হতে পারে একমাত্র অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে। এর সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়া দরকার। স্বৈরতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সরকারের দীর্ঘ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের হয়েছে। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্র নিয়ে করুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল এ অঞ্চলের জনগণ। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার অভাবে চরম অর্থনৈতিক আঞ্চলিক বৈষম্য দেখা দিয়েছিল। এক সময়ে বাঙালিদের জন্য তা অসহনীয় হয়ে পড়ে। ফলে ছয় দফা আসে এবং পরিশেষে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। জন্ম নেয় আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। এ কথা অনিস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, নর-নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাসহ জনগণের বৃহত্তর অংশ অপরিসীম শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার হয়েছে। যদিও দেশে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, তারা তার অংশীদার হতে পারেনি। যারা যখন সরকার গঠন করেছেন, তারা নিজ নিজ দলের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন।
প্রচলিত প্রবাদ আছে যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ফলে সাধারণ জনগণ হয়েছে শোষিত ও বঞ্চিত। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত লেখক আবুল মনসুর আহমদের ফুড কনফারেন্সবইটির কথা উল্লেখ্য। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য সমস্যা নিরসনের বিষয়ে লিখেছিলেন। সেখানে নির্বাচনের লড়াইয়ে অনেক দল ছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দল নির্বাচনে জনগণের খাদ্য সমস্যা সমাধান করার ওয়াদা দিয়ে ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু দেখা যায়, যে দল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, তাদের দলের লোকের খাদ্য সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু দেশের আপামর ভোটদাতা জনগণের খাদ্যসমস্যা যথা পূর্বং তথা পরং। চরম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ে। এ সুযোগে রাজনৈতিক দলগুলোর অবিমৃষ্যকারিতা ও বিদেশী শক্তির যোগসাজশে বারবার অগণতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সুযোগ আসে। তারা নির্যাতন করে রাজনীতিকদের। কিন্তু তবুও তাদের চৈতন্যোদয় হয় না।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও কি আমাদের গণতান্ত্রিক দলের চরিত্রের তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে? অ্যাব্রাহিম লিংকন বলেছেন গণতন্ত্র মানে গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল অ্যান্ড বাই দ্য পিপল। কিন্তু তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয় আমাদের এ দেশে। এখন জনগণের মঙ্গলের পরিবর্তে বেড়ে গেছে অশান্তি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দলাদলি, হানাহানি, হরতাল, খুন, গুম, মৃত্যু ও সঙ্ঘাতের মাত্রা। এ সুযোগে সুযোগসন্ধানীরা দুর্নীতি, ঘুষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, ব্যাংক জালিয়াতি প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত। প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে বিবর থেকে বের হয়ে আসে সব অপরাধী এবং নিরাপদে চালায় তাদের অমানবিক কর্মকাণ্ড।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত। বিশ্্্্্্¦ায়নের এ যুগে যখন প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন, তখন আমরা করছি এর বিপরীত কাজ। এ দিকে অপরিসীম আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব ও চরম দারিদ্র্যের কারণে দলে দলে মানুষ চলে আসছে রাজধানী শহরে। বেড়ে যায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, অস্বাস্থ্যকর ও অসামাজিক নোংরা বস্তি, মাদকের ব্যবহার ও চোরাচালান, নারী ও শিশুপাচার, খুন খারাবি ও সামাজিক অপরাধ। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে দেশের মানুষ শুধু দারিদ্র্যের কশাঘাতই সহ্য করে না, বিদ্যমান অবস্থায় তাদের মানসিক অস্থিরতা ও অশান্তির আগুন বেড়ে যাচ্ছে বহু গুণে। সামাজিক অবক্ষয়ের গতি হচ্ছে ত্বরান্বিত।
আমরা দেখছি বাংলাদেশ বর্তমানে বেসরকারি খাতের উদীয়মান উদ্যোক্তা শ্রেণী ও দেশের দক্ষ, আধা দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক শ্রেণী এবং কৃষক সমাজ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রাখছে। দেশ গড়ে প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছিল। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতিবাচক টানাপড়েনে অর্থনীতিতে পিছুটান না পড়লে, প্রবৃদ্ধির গতি আরো ত্বরান্বিত হতো এবং বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য দর্শনীয়ভাবে কমে যেত। কিন্তু তা না হয়ে অর্থনীতিতে নামছে ধস। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রবৃদ্ধি ৫.৫০ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইএমএফও তাই বলেছে। ষাটের দশকে আমাদের দেশ অর্থনীতি ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের প্রায় সমকক্ষ ছিল। আজ তারা কোথায় আর আমরা কোথায়। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানুষের মেধা তো কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক হানাহানির কারণে সরকার অর্থনৈতিক বিষয়ের পরিবর্তে অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থেকে বেশি সময়, অর্থ ও শক্তি ব্যয় করে। এরা দরিদ্র মানুষের দুর্গতির পরোয়া করছে না। পরিণামে দেশ পিছুর টানেই রয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতি দেখে মনে পরে একটি কবিতা :
কুড়াল কহিল, ভাই শাল ওরে শাল,/দয়া করে দাও মোরে ছোট একটি ডাল।/ডাল লয়ে হাতল লাগানো হলো যেই,/তারপরে কুড়ালের চাওয়া চিন্তা নেই।/একেবারে গোড়া ঘেঁষে লাগাইল কোপ,/শাল বেচারার হলো আদি অন্ত লোপ।আজ বাংলাদেশের জনগণের সেই দশা। কাকুতি মিনতি করে ভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক সরকার গঠন করে। পরে নিজেদের কোলের দিকে ঝোল টানা শুরু করে, আর জনগণের স্বার্থে কুড়ালের কোপ মারে। শুধু তা-ই নয়, জনগণের কথা ভুলে নিজ দলকে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লাগে আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়। এ দিকে বিরোধী দল লক্ষণ খারাপ দেখে তাদের গদি থেকে যেভাবেই হোক নামাতে সচেষ্ট হয়। শুরু হয় হরতাল, অবরোধ, খুনাখুনি আর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ধ্বংসসাধন। সরকার ও বিরোধী দলের হানাহানিতে জনগণের সুখ, শান্তি, উন্নতি, অগ্রগতির স্বপ্ন তছনছ হয়ে যায়; হয় জান ও মালের ক্ষতি। বিগত দুই দশকের গণতান্ত্রিক সরকারগুলো দেশের জনগণকে এর চেয়ে ভালো কিছু দিতে পারেনি। কিন্তু তারাই তো ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আসেন। তবে কেন দেশবাসীকে দেন এত নরকযন্ত্রণা।
উল্লেখ্য, ষাটের দশকের শেষে মালয়েশিয়ায় ভূমিপুত্র ৫৫ শতাংশ, চীনা ৩০ শতাংশ, ভারতীয় ১০ শতাংশ ও অন্যান্য ৫ শতাংশের মধ্যে চরম হানাহানি অবস্থা বিরাজমান ছিল। তারা দূরদৃষ্টির সাথে সব স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে, কতকগুলো জাতীয় নীতিমালা স্থির করে এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ না করার অঙ্গীকার করে। যথা : ১. মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম; ২. চীনা ও ভারতীয়দের শিল্পকারখানা, ব্যবসাবাণিজ্য জাতীয়করণ করা হবে না; ৩. যার যে ভাষা সে ভাষায় নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা চালাতে পারবে; (৪) আলী-বাবা পার্টনারর্শিপের মাধ্যমে সম্পদের সুসম বণ্টন হবে; ৫. ভূমির মালিকানা থাকবে ভূমিপুত্রের ইত্যাদি। এসব নীতিমালা সব দল ও গোষ্ঠী নিষ্ঠার সাথে পালন করে। তাই মালয়েশিয়া আজ শান্তির ও সমৃদ্ধির মুখ দেখেছে। এখন লাখ লাখ বাঙালি সেখানে শ্রমিকের কাজ করছে। আর আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলার কী দশা করছি, যদিও তাদের চেয়ে আমাদের মধ্যে ভাষা, ধর্ম ও জাতিগত বিভেদ নেই বললেই চলে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলকেই আরো উদার ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। দলের চেয়ে দেশ বড় এ নীতি মানতে হবে। গঠনমূলক আলোচনায় উভয় পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। তাদের মধ্যে যেসব স্পর্শকাতর নেতিবাচক বিষয় আছে, সেগুলোর অতিচর্চা বন্ধ করতে হবে। এক দল আর এক দলের বিরুদ্ধে কুকথা প্রয়োগ না করে ইতিবাচক সমঝোতার পথে এগিয়ে যেতে হবে। যারা সরকারে আছেন বা বিরোধী দলে আছেন কারো দায়িত্ব কম নয়। তবে সরকারের হাতে যেহেতু ক্ষমতা রয়েছে, তাই তাদেরই বেশি উদারতা দেখাতে হবে। দেশের ও জনগণের স্বার্থে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে ঐকমত্যের অভিমুখে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি উইন-উইন অবস্থায় পৌঁছানো যায়। এরূপ একটি অবস্থানের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এ সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। কারণ গণতন্ত্রের এখন মুমূর্ষু অবস্থা। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য অবিলম্বে ফলপ্রসূ আলোচনা প্রয়োজন। এ জন্য উভয় পক্ষকে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি তারানকোর আলোচনার আলোকে সর্বাত্মক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নেয়া একান্ত কাম্য। মনে রাখতে হবে, সরকারের চ-নীতির পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। মধ্যপন্থাই সোনালি।
অতএব উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের অনুরোধ ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির মাধ্যমে পরস্পরকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তির জন্য সমঝোতার বিকল্প নেই। কিন্তু সমঝোতার জন্য আমাদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে, নাকি তৃতীয় শক্তির উত্থান হবে! এটিই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনা! 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads