বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩

ডিসেম্বর ২০১৩ সালের রাজনীতি


১.
রাজনীতি ঝঞ্ঝার বেগে প্রবেশ করেছে স্মৃতিবাহী ডিসেম্বরে। ডিসেম্বর মাস গুরুত্বের সঙ্গে ১৯৭১ থেকে এই ২০১৩ পর্যন্ত ইতিহাসে বার বার এসেছে। নানা ঘটনা ও উত্তেজনায় ডিসেম্বর অন্য রকম। আলাদা। কখনও গৌরবের। কখনও বেদনার। চলতি ২০১৩ সালের এই ডিসেম্বরও নানা কারণে অন্য রকম। এই ডিসেম্বরে দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ স্পষ্ট। এরই মাঝে জাতিসংঘের দূত তারানকোর মিশন দৃশ্যত কোনও ফলোদয় করতে ব্যর্থ। অন্যদিকে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিষয়ে আইন-আদালত প্রাঙ্গণও সচকিত। বাংলাদেশের পুরো পরিস্থিতিকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে বেইজিং থেকে উড়ে এসে দেখা করেছেন চীনের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি দল। এই ডিসেম্বরে আরও স্পষ্ট হলো যে, বাংলাদেশ পরিস্থিতি দেশের মধ্যেও যেমন উত্তপ্ত; বাইরের বিশ্বেও গুরুত্বপূর্ণ। সবার সামনেই এখন একটি প্রশ্ন: কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ইতিহাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ডিসেম্বর হলো বিজয়ের স্মারকবাহী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পরের বছরের ডিসেম্বরও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সংবিধান প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে বিশেষ কিছু না ঘটলেও ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ধর্মঘট, লকআউট নিষিদ্ধ এবং মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়। দেশের গণতন্ত্র যে ক্রমেই আক্রান্ত হচ্ছে, তখন থেকেই সে আভাস পাওয়া যায়। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে (২৫ জানুয়ারি) দেশে একদলীয় শাসন বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক বছর পর ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাকশাল প্রতিষ্ঠাকারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চম সংশোধনী জারি করা হয়। ১৯৭৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮০ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশে রঙিন টেলিভিশন সম্প্রচারের সূচনা ঘটে। তারপর ১৯৮২ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের শাসনামলে শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে বহু বছর পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর সামরিক শাসক এরশাদ বিচারপতি আহসানউদ্দীন চৌধুরীকে পদত্যাগ করিয়ে নিজে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে ৮, ২২, ২৩ তারিখ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে হরতাল পালন করে। এই আন্দোলন চলতে চলতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে তুঙ্গে ওঠে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ। ১৯৯১ সালের পুরো ডিসেম্বর মাসই আওয়ামী লীগ নানা দাবিতে আন্দোলন করে। ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযম জামায়াতের আমির হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ভারতের অযোধ্যায় প্রাচীন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ায় বাংলাদেশে তুমুল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ঢাকায় ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সার্ক শীর্ষ সন্মেলন স্থগিত করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে। ১৯৯৪ সালের ১ ডিসেম্বর দেশব্যাপী আনসার বিদ্রোহ হয়। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২৯ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়। পুরো ১৯৯৫ সাল এ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এ বছর ডিসেম্বরে বিএনপি বেশ কিছু আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৭ ডিসেম্বর বিএনপি হরতাল পালন করে। ২৮ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধী দলের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে বছরে বছরে আসা ডিসেম্বর মাসের আন্দোলন-উত্তেজনা-উত্তপ্তের ইতিবৃত্তে। ডিসেম্বর যেন ইতিহাসে সংগ্রামশীলতা কিংবা সংঘাতের প্রতীক। এবং অবশ্যই জনতার বিজয়-চেতনার প্রবহমানতার সাক্ষী। বিজয়ের চেতনা, গণতান্ত্রিক দার্শনিকতাকেও ডিসেম্বর বিকশিত করেছে। একদলীয় শাসন, সামরিক স্বৈরশাসন ইত্যাদি থেকে জনতা গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের আশ্রয়েই শেষ পর্যন্ত চলে এসেছে। বাংলাদেশে স্বৈরতা ও গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-দ্বৈরথে ইতিহাস শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। ফলে একাত্তরের চেতনাবাহী ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় কেবল স্মৃতিতর্পণ ও অতীত গৌরবের বিষয় মাত্র নয়, নিত্য গণতান্ত্রিক প্রাণপ্রবাতে বিধৌতকরণের উপলক্ষও বটে।  
২.
এবারের ডিসেম্বরে বিরূপ পরিস্থিতির উত্তাপ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মানুষ। দেখা যাচ্ছে যে,  নভেম্বরের হরতাল-আন্দোলনের সংঘাতপূর্ণ আবহে এবারের অন্য রকম ডিসেম্বর তীব্র উদ্বেগ ও উত্তেজনায় টগবগ করছে। অতীতের যেসব ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনমুখর ছিলেন; এবারের ডিসেম্বরে একই দাবিতে সংগ্রামরত বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত তথা ১৮ দল। দাবি আর মাস ঠিকই আছে; কেবল বদলে গেছে নেতৃত্ব ও দলীয় অবস্থান। ফলে এই ডিসেম্বরে অপেক্ষা করছে বিরাট রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ: সবাইকে নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার তাড়া এবং সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার অগ্রাধিকার। এই ডিসেম্বরে নেতৃবৃন্দকে কেবল অতীতের গৌরবকথার পুনরুল্লেখ করে ভাষণ-বাণী প্রদানই যথেষ্ট হবে না; বর্তমান সমস্যার বাস্তবভিত্তিক সমাধান ও মীমাংসার লক্ষ্যে কার্যকরী প্রস্তাবও সামনে এনে দিতে হবে; ভবিষ্যতকে নিরাপদ রাখার প্রত্যয়টিকে আক্ষরিক অর্থে মান্য করার দৃশ্যমান উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এই উত্তাল ডিসেম্বরে সংঘাত-সংঘর্ষ-রক্তপাতের আখরে যেন শেষ কথা রচিত না হয়; শেষ কথা বা উপসংহার যেন লিপিবদ্ধ হয় শান্তি ও সমঝোতাপূর্ণ সমাধানের  গৌরবময় অক্ষরে। 
৩.
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে উপ্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন প্রকৃতই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। বহুমত ও বহুদলের সমন্বয়ে সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রায় ব্যর্থ। আইনানুগ নিয়মতান্ত্রিকতা চরম অবক্ষয়প্রাপ্ত। সরকার আর বিরোধী দলের যুদ্ধংদেহি-মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে চলছে হরতাল-অবরোধ। কেউই বলতে পারবেন না, সঙ্কটের আদৌ কোনও সমাধান গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সম্ভব হবে কি না! এমন্ ঘোরতর অনিশ্চয়তায় শাসনতান্ত্রিক আদর্শের যে গণতান্ত্রিক ভিত মানব মন ও সমাজের অনেক শক্ত জমিতে প্রোথিত থাকে, তা প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যায়; স্থবির হয়। অথচ যে গণতন্ত্রকে বিদ্যমান রাজনীতিতে ক্ষয়িষ্ণু ও স্থবির করে রাখা হয়েছে, তার জন্য জনগণের চাহিদা ও দাবি উঠে ইতিহাসের পর্বে পর্বে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই বিশ্বের শহরে-বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে ফুলকি থেকে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। কখনও কখনও প্রতিবাদে-বিক্ষোভে সামিল হয়েছে হাজার-হাজার মানুষ; কখনও পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে নীরবেÑÑইতিহাসে এমন দৃশ্য বিরল নয়। গণআন্দোলন পেয়ে গিয়েছে উডি গ্যাথ্রি বা পিট সিগারের মতো শিল্পীর সমর্থনপুষ্ট অবিস্মরণীয় বহু আন্তর্জাতিক সঙ্গীত। পিট সিগারের ‘টকিং ইউনিয়ন’ গানের কথাগুলো আজকেও ভাসছে বিশ্বায়নের গ্লোবাল বাতাসের ডিজিটাল স্রোতে: ‘বেটার ওয়ার্কিং কনডিশন্স/ভেকেশন্স উইথ পে/টেক ইওর কিডস টু দ্য সি-শোর...।’ যদিও সামরিক জান্তা কাছে পরে পরাজিত হয়, তথাপি এমন্ই শতকণ্ঠ মুখরিত হয়েছিল সাম্প্রতিক আরব জগতে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, গত শতাব্দীর পাঁচ কিংবা ছয়ের দশকে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। সত্তরে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলেছে। আশি ও নব্বই দশকে গণতন্ত্রের জোয়ার বয়ে গেছে। চীনের ‘তিয়েনমান স্কোয়ার’ বা কাঠমা-ুর ‘রিপাবলিকান স্কোয়ার’ ভেসে গেছে ছাত্র-জনতার বাঁধ-ভাঙা উচ্ছ্বাসে। আরব জগতে কিছু আগে এসেছিল মহামুক্তির ‘ইন্তিফাদা’-এর জেসমিন আন্দোলন, পশ্চিমারা যার নাম দেয় ‘ডোমিনো ইফেক্ট’। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মহানিনাদের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কি হচ্ছে? গণতন্ত্রকে লালন নাকি আঘাত করা হচ্ছে? ইতিহাসের শিক্ষা হলো, গণতন্ত্র আঘাত সহ্য করে না; দম্ভ মানে না; রক্তাক্ত হলে আহত বাঘের মতো বজ্র হুঙ্কারে সব কিছু তছনছ করে দেয়। নিকট-অতীতের একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জনতার আন্দোলনকে সাভাক-পুলিশের আক্রমণে রক্তাক্ত করে ১৯৭১ সালে রেজা শাহ পাহলভি পারসিপোলিশে সম্রাট সাইরাসের সমাধির পাশে জাঁকজমকের সঙ্গে ইরানি রাজতন্ত্রের ২৫০০ তম বার্ষিকী উদযাপন করেন। মাত্র আট বছর পর ১৯৭৯ সালে জনতা শাহের মসনদ টুকরো টুকরো করে দেয়। পারস্যের নদীগুলো দিয়ে শাহতন্ত্র আবর্জনার মতো ভেসে চলে যায় শাতিল আরবের স্রোতে। বস্তুত, জনতা ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর কোথাও কেউই কখনো টিকতে পারে নি। স্বৈরশাসকদের সামনে এই তথ্য ঐতিহাসিক সত্য ও বাস্তবতার চি‎‎হ্নস্বরূপ। তথাপি পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের কথা যতটুকু আছে, ঠিক ততোটুকুই আছে স্বৈরাচারের কথা। কিন্তু উপসংহার হিসাবে আছে গণতন্ত্রের বা জনগণের বিজয়ের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের চরম পরাজয় ও পতনের ঘটনাবলী।
৪.
গণতন্ত্র সব সময় স্বৈরতন্ত্রের হাতে পরাজিত হয়, এমন নয়। গণতন্ত্রী ও জনপ্রিয়রাও কখনো কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে ফেলে। জার্মানির চ্যান্সেলর হের হিটলার বিপুল জনসমর্থন ও ভোটের জোরে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক থাকতে পারেন নি; হয়ে গিয়েছিলেন চরম স্বৈরাচারী, একনায়ক। গণতান্ত্রিক পরিণতির বদলে তার হয়েছিল নাৎসি-স্বৈরতান্ত্রিক পতন। শুধু হিটলার কেন, আমাদের চেনা-জানা বহু জনপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক নেতা আখেরে একদলীয়-স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, তাদের পতন ও পরিসমাপ্তি অত্যন্ত দুঃখজনক ও রক্তাক্ত পথে গিয়ে তাদেরকেই চিরতরে  নিঃশেষ করে দিয়েছিল। শুধু নেতার স্খলন-পতন নয়, নেতার অধীনস্থদের অবক্ষয়ের জন্যও গণতন্ত্র কোনও কোনও সময় আক্রান্ত হয়েছে। শেক্সপিয়ারের নাটকের বিখ্যাত চরিত্র লেডি ম্যাকবেথ একটি স্মরণীয় উক্তি করেছিলেন: ‘ডযধঃ’ং ফড়হব পধহহড়ঃ নব ঁহফড়হব’. তাই বাংলাদেশের সঙ্কুল রাজনৈতিক রণাঙ্গনে যে ঘটনাগুলো ইতিমধ্যে ঘটে গেছে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত, অনাকাক্সিক্ষত হিসাবে ধরে নিয়ে এবং এসবের যথোপযুক্ত প্রতিবিধান করে আমাদেরকে চোখ রাখতে হবে গণতন্ত্রের অস্তিত্বের উপর। কারণ অগ্নিপরীক্ষায় নিপতিত গণতন্ত্রের অস্তিত্বই যদি বিপন্ন হয়ে যায়, তাহলে মানুষের রাজনৈতিক আশা-ভরসার শেষ অবলম্বন বলতে আর কি অবশিষ্ট থাকবে?
৫.
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও সংঘাতের দৃশ্যপটে এখন সবচেয়ে দামী প্রশ্ন: সমাধান কোথায়? ব্যক্তি না প্রতিষ্ঠানের হাতে? এইসব কোটি টাকা দামের প্রশ্নের উত্তরের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশ।
সমাধানের আগে জানা দরকার সমস্যার কারণ। সঙ্কটাপন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রধানত নিয়মতান্ত্রিকতার অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট। শাসন প্রক্রিয়ায় বার বার নিয়ম ভঙ্গ করায় যে সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে, এখন চলছে সেটারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এই সঙ্কট প্রাতিষ্ঠানিক কারণে সৃষ্টি হয়নি; হয়েছে মানবীয় কারণে। নেতৃত্বের একগুঁয়েমী মনোভাবে। ১/১১-এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, সে ব্যাপারে গো ধরার ফল ভালো হয় নি। এখন নির্বাহী প্রধান পদ নিয়ে একই ধরনের টানাপোড়েন চলছে। ঐ পদে ব্যক্তি-বিশেষের থাকা বা না-থাকার মধ্যেই আবর্তিত রাজনৈতিক পক্ষ ও প্রতিপক্ষের দাবি।  রাজনৈতিক সমস্যা ও সঙ্কট শেষ পর্যন্ত  কেন্দ্রীভূত বিশেষ-ব্যক্তিতে। অবরোধের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছে আন্দোলনরত ১৮ দলীয় জোট। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, সমাধানও কি তাহলে ব্যক্তি পর্যায়ে নির্ভর করছে? রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিশেষ কোনও একজন ব্যক্তি-মানুষের পক্ষে যাবতীয় ভালো বা মন্দের প্রবল ও প্রধান চরিত্র বা কারণ হয়ে উঠার মতো পরিস্থিতি নিয়মতান্ত্রিকতার অবক্ষয়ের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাই রাজনৈতিক সঙ্কটের আপাত সমাধান এখন লুকিয়ে আছে নিয়মতান্ত্রিকতা এবং ব্যক্তিতান্ত্রিকতার মাঝখানে। সংসদ, সংবিধান, বঙ্গভবন, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং পুরো জনগণ তাকিয়ে আছে ব্যক্তির দিকে। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, সুশাসনতান্ত্রিকতা ও আইনানুগ নিয়মতান্ত্রিকতার জন্য ব্যক্তি-বিশেষের দিকে তাকিয়ে থাকার এই তথ্যটি  কোনভাবেই সুখকর নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটিই এখন চরম বাস্তবতা এবং অতি নির্মম  ও কঠিন সত্য। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ব্যক্তি-প্রধান কিংবা ব্যক্তি-কেন্দ্রীক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নিয়মতান্ত্রিকতা নস্যাৎ হলে। কারণ, নিয়মতান্ত্রিকতা এমনই এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নির্দেশ করে, যার মাধ্যমে সরকার সীমিত ক্ষমতাচর্চা করতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা, ঐতিহ্য সুরক্ষিত ও বিকশিত হয়। আইন ও নিয়ম অবিকৃতভাবে পালিত হয়। জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সরকার কখনই স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী বা একনায়কতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না। নিয়মতান্ত্রিকতার জন্যই গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি, বিধি-বিধান অনুযায়ী সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকা- পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে বার বার নিয়মতান্ত্রিকতায় ব্যত্যয় ঘটেছে। এই বাধা কেবল ১৯৯৬, ২০০৬-২০০৮, কিংবা বর্তমানের প্রসঙ্গ নয়, অতীতের ধারাবাহিকতার প্রতিফল।
৬.
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান দ্বারা চলতে শুরু করলেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘ চল্লিশোর্ধ সময়কালে নিয়মতান্ত্রিকতাকে ব্যাহতকরণের পালা পর্যায়ক্রমে সকল শাসনামলেই দেখা গেছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শাসকগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রক্রিয়া সংরক্ষণে অনীহা, ব্যক্তিগত-দলীয়-পারিবারিক স্বার্থচিন্তা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিকতা বিকশিত হতে পারেনি। ফলে প্রতিটি শাসনই একক ব্যক্তির কর্তৃত্ববাদী শাসনে রূপ নেয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রীতি-নীতি ভূ-লুণ্ঠিত অথবা কাগুজে বিষয়ে পরিণত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মান্য করে প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ লাভে ব্যর্থ হয়। জনগণের মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। শাসনের কাঠামোতে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য এবং সমন্বয় ও সুশাসনের অভাব দেখা দেয়। নিয়মতান্ত্রিকতার তীব্র অবক্ষয়ের কারণে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সৃষ্টি হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনীহা ও অবজ্ঞা এবং ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন আর সরকার ও প্রশাসনকে ব্যবহার করার কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা। ফলে বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিকতার পথে প্রধান বাধা প্রাতিষ্ঠানিকের চেয়ে মানবীয়। শাসক ও রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্বমূলক মনোভাবই এজন্য দায়ী। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সংবিধানের প্রতি তাদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতির কারণে গণতান্ত্রিক-শাসনতান্ত্রিক রীতি-নীতি ভেঙে নিজস্ব ইচ্ছা ও স্বার্থ হাসিল করাই এখন রাজনীতির শেষ ও একমাত্র কথা। রাজনৈতিক সঙ্কটে নেতৃবর্গের সংকীর্ণ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থ ও উদাসীনতার ফলে সৃষ্ট সমস্যায় তাদের নিজেদের দায়িত্ব এড়ানো  কোনওভাবেই সম্ভব নয়।  সমাজ, রাজনীতি ও নাগরিক সমাজে সৃষ্ট ও চলমান সঙ্কটের মূল কার্য-কারণ যে নিয়মতান্ত্রিকতা ও ব্যক্তিতান্ত্রিকতার তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে নিহিতÑএই সৎ ও সত্য কথাটি স্বীকার করতেই হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার প্রশ্নে ব্যক্তির প্রাধান্যশীলতা আর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের দ্বন্দ্ব-সংঘাত না ঘুচিয়ে বৃহত্তর সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে যাওয়া রাজনৈতিক সমস্যা ও হানাহানির স্থায়ী ও পরিপূর্ণ সমাধান করা আদৌ সম্ভব হবে না। তবে, আপাতত সমাধান ও শান্তির প্রাণ ভোমরা যে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন কৌটায় আবদ্ধ, সে কথাটিও অস্বীকার করা চলবে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের এতো বছর পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সমাধানের জন্য সমগ্র জনতাকে কি ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে? ১৯৭১-এর ডিসেম্বর তো ব্যক্তির নয়, জনতা বিজয় এনেছিল। জনতার বিজয়ের পথই মুক্তিযুদ্ধের পথ; গণতন্ত্রের পথ। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পুনরায় এই সত্য নবরূপে উপলব্ধি করার ডাক দিয়ে যাচ্ছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads