শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

বাংলাদেশে ভোটের হাওয়


এবনে গোলাম সামাদ


একটি দেশ, যদি সে দেশে গণতন্ত্র থাকে, তবে সব দলেরই থাকা উচিত নির্বাচনে দাঁড়াবার অধিকার। তা সে দলের নীতি সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক। কারণ সংবিধান পরিবর্তনসাপেক্ষ। একটি দল চাইতে পারে সংবিধান পরিবর্তন। আর তার সেই দাবির ভিত্তিতে সে চাইতে পারে নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন। আমাদের সংবিধানে এমন অনেক কিছু আছে, যার পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করতে পারে একটি রাজনৈতিক দল। আমাদের সংবিধানে রাজনৈতিক দল বলতে বোঝানো হয়েছেÑ ‘রাজনৈতিক দলবলিতে এমন একটি অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোন নামে কার্য করেন এবং কোন রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোন রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসঙ্ঘ হইতে পৃথক কোন অধিসঙ্ঘ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল, যা উপরের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। কারণ, দলটির একটি আদর্শ আছে এবং সে নিজেকে এমন ব্যক্তিসমষ্টি হিসেবে ভাবে, যা অন্য রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিসমষ্টি থেকে ভিন্ন। আমাদের সংবিধানে এমন কোনো কথা বলা হয়নি যে, কোনো দলকে হতে হবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত। কারণ, এ রকম কিছু বলার অর্থ দাঁড়ায় রাজনৈতিক দল গড়ার স্বাধীনতা হরণ। কিন্তু গণতন্ত্রে দল গড়ার অধিকার হরণ বিধেয় নয়। 
ব্রিটেনে গণতন্ত্র আছে। কিন্তু সেখানে মোজলে নামক কোনো এক হিটলার ভক্ত করেছিলেন একটি বিশেষ দল গঠন। দলটি গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী হলেও দলটি গঠনে বাধা দেওয়া হয়নি। পরে অবশ্য জার্মানির সাথে যুদ্ধ বাধলে দলটিকে বেআইনি করা হয়। কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করেন, সর্বহারা একনায়কত্বে। গণতন্ত্রে নেই তাদের আস্থা। কিন্তু তা বলে ব্রিটেনে কমিউনিস্ট পার্টি গড়তে বাধা দেয়া হয়নি। ব্রিটেনে কমিউনিস্ট আন্দোলন কোনো দিনই জনসমর্থন পেতে পারেনি। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর ব্রিটেনে কমিউনিস্ট পার্টি হয়েছে বিলুপ্ত। কারণ তার আর নেই কোনো মতবাদিক ভিত্তি। অথবা মতবাদিক আকর্ষণ। জানি না, আমাদের দেশে কেন বলা হচ্ছে একটা দলকে হতে হবে সাংবিধানে আস্থাশীল। আমাদের সংবিধানে অনেক আত্ম-অসঙ্গতি আছে। যেমন প্রজাতন্ত্র বলতেই বোঝায় প্রজাদের শাসন এবং রাজতন্ত্র না থাকা। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের শাসনতন্ত্রকে বলছি গণপ্রজাতন্ত্রী। যত দূর জানি গণপ্রজাতন্ত্রী ধারণাটির উদ্ভব হয়েছিল চীনে। এর উদ্ভাবক হলেন পরলোকগত বিখ্যাত চীনা নেতা মাও জে ডং। কেন আমরা এই ধারণাটি গ্রহণ করলাম তা আমাদের বোধগম্য নয়। মাও বহুদলীয় গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্য কমিউনিস্টদের মতোই একদলের রাজত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু আমরা তা নই। তাই মনে হয়, আমাদের সংবিধান থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী কথাটা এখন বাদ দেয়াই প্রয়োজন। আমাদের সংবিধানে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে সমাজতন্ত্রকে। কিন্তু আদর্শ হিসেবে বেশির ভাগ দলই এখন আর সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। আমাদের সংবিধান থেকে তাই মনে হয় সমাজতন্ত্র কথাটাও বাদ দেয়া উচিত। কারণ আমরা এখন গুরুত্ব দিচ্ছি মিশ্র অর্থনীতির ওপর। স্বীকার করছি, ব্যক্তিমালিকানায় ব্যবসায় বাণিজ্যকে। 
আমাদের সংবিধান যারা রচনা করেছিলেন, তাদের ধারণা আর আমাদের আজকের ধারণা মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সমাজতন্ত্র এখন আর আগের মতো কোনো দেশেই আদ্রিত রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে বিবেচ্য নয়। কারণ, সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক উৎপাদন না বেড়ে কমতে চায় এবং সৃষ্টি হয় এক জটিল আমলাতন্ত্রের। আমলারা হয়ে উঠতে চান দুর্নীতিপরায়ণ। আর মানুষ হারাতে চায় তার আত্মনির্ভরশীলতা। যেটা প্রমাণিত হতে পারছে বিগত সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে। কিন্তু আশ্চার্যজনকভাবে অনেক পুরনো সোভিয়েত আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা এখন ঢুকে পড়েছেন আওয়ামী লীগে। অনেকে ঠাট্টা করে তাই বলছেন, আওয়ামী লীগ আসলে হয়ে উঠেছে কমিউনিস্ট লীগ। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে বলছে না গণতন্ত্রবিরোধী দল হিসেবে। গণতন্ত্রবিরোধী দল হিসেবে সে কেবলই চিহ্নিত করতে চাচ্ছে জামায়াতকে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তাই অনেকের মনে সৃষ্টি হতে পারছে সংশয়।। জামায়াত কতটা শক্তিশালী দল, সে সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কোনো ধারণা নেই। কিন্তু ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসার আগে ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশে নাকি ঘটছে মুসলিম মৌলবাদের শক্তি বৃদ্ধি। তার মতে, বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ নাকি হয়ে উঠেছেন জামায়াত সমর্থক। তার এই দাবি কতটা সত্য আমি তা বিচার করতে পারি না। কিন্তু সত্যিই যদি সেরকম জামায়াত সমর্থক বেড়ে গিয়ে থাকে, তবে ভাবা উচিত, এটা সম্ভব হতে পারছে কেন। ১৯৭১ সালে জামায়াত পাকিস্তানে কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল না। জামায়াত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাব থেকে জিতেছিল মাত্র একটি আসনে। সিন্ধু প্রদেশ থেকে দুটি আসনে আর তদানীন্তন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পেয়েছিল একটি আসন। অর্থাৎ সে সময়ের পাকিস্তানে সে পেয়েছিল মাত্র চারটি আসন। তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান থেকে সে একটি আসনও পায়নি। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সে নির্বাচনে পেতে পেরেছে আসন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ’-এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়েছেন যে, বাংলাদেশে শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ হয়ে উঠেছেন জামায়াতের সমর্থক। মনে হচ্ছে ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশে জামায়াতকে ধ্বংস করতে। আর শেখ হাসিনা এ কাজে করতে চাচ্ছেন, ভারতের একান্ত সহযোগিতা। তাই বলা হচ্ছে, জামায়াত একটি গণতন্ত্রিক দল নয়। আর তাই তাকে করা উচিত নিষিদ্ধ। কিন্তু শতকরা ২৫ ভাগ মানুষকে নিষিদ্ধ করা যথেষ্ট সহজ হবে বলে মনে করার কোনো হেতু নেই। আমার মনে পড়ছে, মনমোহন সিংয়ের পর ব্রিটেন থেকে এসেছিলেন সায়্যেদা ওয়ার্সি। তিনি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হলেও একজন ব্রিটিশ নাগরিক ও পার্লামেন্টের সদস্য এবং ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের কেবিনেট মন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল। তাকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা হবে সঙ্গত। কিন্তু আমরা চাইনি এবং চাচ্ছি না তার পরামর্শের কোনো গুরুত্বারোপ করতে। ব্রিটেন এমন একটি দেশ, যারা আমাদের সম্পর্কে যথেষ্ট খবর রাখে। তাই ব্রিটেন থেকে এসেছিলেন একজন মন্ত্রী। আর উচ্চারণ করেছিলেন উদ্বেগ। বলেছিলেন কোনো দলকে নিষিদ্ধ না করতে। কারণ তাতে বাড়বে রাজনৈতিক জটিলতা ও অস্থিরতা। ভারতের চেয়ে মনে হয় ব্রিটেনের রাজনৈতিক বুদ্ধিতে এখনো আছে যথেষ্ট বাস্তবতার ছোঁয়া। ব্রিটেনের রাজনীতি এগিয়েছে এমপেরিক (Empiric) ধারায়। বিলাতের বিখ্যাত দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪) ছিলেন এমপিরিসিজমের (Empiricism) প্রবক্তা। তিনি তার দেশবাসীকে বোঝাতে চান, অভিজ্ঞতা হলো জ্ঞানের ভিত্তি। সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে নির্ভর করেই করতে হবে রাজনীতি। ব্রিটেন চায়নি কোনো গোঁড়া রাজনৈতিক মতাদর্শকে গ্রহণ করে রাজনীতি করতে। গ্রহণ করেনি কোনো আদর্শ সমাজ গঠনের কর্মসূচি। সে চেয়েছে জাতীয় জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে সমস্যাগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে। আর চেয়েছে সমস্যা সমাধান করে জাতির সমস্যাকে লাঘব করতে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট দেখা দেয়ার একটি কারণ হলো, আমরা চাচ্ছি আদর্শ সমাজ গড়তে আর সমাজজীবনের সব সমস্যাকে রাতারাতি সমাধান করতে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। সমস্যা সব দেশেই আছে। আর আপাতত থাকবেও। সব সমস্যা একত্রে সমাধান করতে গেলে কোনো সমস্যারই সমাধান হতে চায় না। এটা থাকতে হবে আমাদের উপলব্ধিতে। গণতন্ত্রী হতে গেলে হতে হয় এমপেরিক্যাল। 
আমরা আলোচনা করছিলাম জামায়াতকে নিয়ে। জামায়াত কেন জনপ্রিয় হচ্ছে? জামায়াত জনপ্রিয় হওয়ার একটি কারণ হলো, জামায়ত গ্রহণ করেছে ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। তার ভারতবিরোধী মনোভাব তাকে করে তুলেছে জনপ্রিয়। আগামী নির্বাচনে (যদি হয়) ভোটের হাওয়া উঠবে তাদেরই পক্ষে; যারা আওয়ামী লীগের মতো ভারতপ্রেমী নয়। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads