মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৩

মন্ত্রীদের একযোগে পদত্যাগ সরকারের সংকটকে আরো ঘনিভূত করল


কয়েকদিন ধরে চালানো প্রচারণাকে সত্য প্রমাণ করে সোমবার মহাজোট সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কোনোটিতেই তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। বিরোধী দলের ডাকে ৮৪ ঘণ্টার সর্বাত্মক হরতাল চলাকালে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষমতাসীনরা হরতালকে ব্যর্থ করতে এবং হরতালের দিক থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। কারণ, হরতাল সারাদেশেই সফলভাবে পালিত হয়েছে। ধরা পড়ে গেছে বরং তাদের অশুভ উদ্দেশ্য। হঠাৎ নেয়া পদক্ষেপটির কারণ জানাতে গিয়ে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী যাতে তার ঘোষিত নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে পারেন সেজন্যই নাকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হুকুম তামিল করেছেন। এবার তৎপর হওয়ার পালা প্রধানমন্ত্রীর। তার কর্তব্য পদত্যাগপত্রগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়া। জানা গেছে, যেহেতু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কয়েকজনকে পরিকল্পিত সর্বদলীয় সরকারে নিযুক্তি দেয়া হবে সেহেতু প্রধানমন্ত্রী সকলের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন না। যারা বাদ পড়বেন তাদেরগুলোই শুধু পাঠানো হবে। আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে তারা আর মন্ত্রী থাকবেন না। তার আগে পর্যন্ত তারা যার যার পদে বহাল থাকবেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এদিকে ক্ষমতাসীনদের এই ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংবিধান বর্তমানে বলবত আছে তার ৫৮ অনুচ্ছেদের ১-এর ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হবেÑ যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেহেতু সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অন্য কোনো অনুচ্ছেদের মাধ্যমে খর্ব বা রহিত করা হয়নি সেহেতু অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদত্যাগের ব্যাপারে ৫৮ অনুচ্ছেদের ১-এর ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদই প্রাধান্য পাবে এবং কার্যকর হবে। আর সে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে এবং তৎক্ষণাতই তাদের পদ শূন্য হয়ে গেছে। অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তাদের মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। সুতরাং আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদ ‘শূন্য’ হয়ে গেছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা নিজেদের পদে বহাল থাকতে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানোসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে এবং দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন না। যে কোনো ব্যাখ্যায় এভাবে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদে থেকে যাওয়া, দায়িত্ব পালন করা এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা বরং সংবিধানের স্পষ্ট লংঘন। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে এর মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধও করেছেন। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা একটি বিধানে বলা হয়েছে, সংবিধানের লংঘনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তাছাড়া ক্ষমতাসীনরা আজও দেখাতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পিত সর্বদলীয় সরকারের বিধান সংবিধানের ঠিক অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদে রয়েছে। অর্থাৎ সর্বদলীয় সরকারের ব্যাপারেও তারা সংবিধান লংঘন করতে চলেছেন।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত পোষণ করে আমরাও মনে করি, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১-এর ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদের নির্দেশনায় যেমন কোনো অস্পষ্টতা নেই, তেমনি নেই এর অপব্যাখ্যা দেয়ার কোনো সুযোগও। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী কবে, কখন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবেন সেটা বিবেচ্য হতে পারে না। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পরই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শপথের বাইরে চলে গেছেন এবং মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। গতকাল থেকে দেশ কার্যত সরকারহীন অবস্থায় চলছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এ ব্যাপারেও যথারীতি একগুঁয়েমী মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। সংবিধানের পরিপন্থী অবস্থানে গিয়ে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এমন সর্বদলীয় সরকার প্রসংগে বলা যায়, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে চাচ্ছেন, যার মাধ্যমে আয়োজিত লোক দেখানো নির্বাচন করে আবারও তারা ক্ষমতায় আসতে পারবেন। আমরা অবশ্য মনে করি না যে, ক্ষমতাসীনদের এই পরিকল্পনা সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। কারণ, জনগণকে এখন আর ধাপ্পা দেয়ার সুযোগ নেই। ওদিকে ১৮ দলীয় জোট তো রয়েছেই, পাশাপাশি জাতিসংঘের সঙ্গে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও গণচীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোও। এই তালিকায় একদিন আগে যুক্ত হয়েছে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতও। সবার পক্ষ থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা চায় বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। সুতরাং জনগণসহ এতগুলো শক্তিকে পাশ কাটিয়ে এবং সংবিধান লংঘন করে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে একতরফা নির্বাচন করা এবং সে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারবে না। আমরা তাই মনে করি, সময় একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের উচিত ১৮ দলীয় জোটের দাবি মেনে নেয়া এবং সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads