বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৩

বল এখন বঙ্গভবনে


ভুল করে ভুল করলে ক্ষমা পাওয়া যায়। ঠাণ্ডা মাথায় ভুল করলে ক্ষমা মেলে না। উল্টো খেসারত গুনতে হয়। মহাজোট সরকার ঠাণ্ডা মাথায় ভুল করছে। এরশাদকে সেই ভুলের পথে নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। এরশাদের মতো পতিত, খল ও ন্যাড়া বারবার বেলতলায় যেতে বাধ্য। এরশাদের রাজনৈতিক উত্থানের বিষয়টি যেন জন্মই আজন্ম পাপ। তাই এরশাদ ও আওয়ামী লীগ মিলেমিশে প্রতিবেশী চাণক্য রাজনীতির কৌটিল্য ধারায় অবগাহন করে ভাবছেÑ কেউ দেখছে না। এমন কর্মকাণ্ডকে ওয়াক থু বলার মতো লোকও বুঝি আর নেই। পটুয়া কামরুল হাসান মরে গেছেন বলে আর কেউ বিশ্ববেহায়া বলার নেই, এমনটি বোধ করি বেয়াক্কেলের ধারণা। বাংলাদেশের সব মানুষ জাত গোলাম নয়, বেহায়াও নয়। জাতিকে আহাম্মক ও বোকার হদ্দ ভেবেই মহাজোট সরকার একটা আগুন খেলা শুরু করেছে। শেখ হাসিনা নাকি আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসতে পারেন। শোকের পাথরে বসেও প্রতিপক্ষ ঠ্যাঙ্গাতে পারেন। কোলাহলেও ঘুমোতে পারেন। আবার নৈঃশব্দের মাঝেও শব্দ সৃষ্টি করতে পারেন। নতুন করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর শপথ তারই প্রতিফলন। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এটি সর্বদলীয় সরকার। বাহ! বাহ! খোশ মেজাজে আরো বলা হচ্ছে, এ সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। রাজনৈতিক সঙ্কট যখন ঘনীভূত অবস্থায় রয়েছে, বিরোধী দল ও জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রশ্নে অনড়, দেশের নিরঙ্কুশ জনগণ যখন একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অভিযোগমুক্ত নির্বাচনের জন্য অপেক্ষমাণ; তখন সরকার এ ধরনের বিষের বাঁশি বাজিয়ে দেয়ার মাধ্যমে জাতিকে শুধু ভুল বার্তা দেয়নি, ক্ষমতার পাটাতন সরে যাওয়ার আভাসও দিয়েছে। জনগণ কোনোভাবেই এ ধরনের প্রহসন দেখতে চায়নি। আশা করেনি শেষ গোধূলিতে শেখ হাসিনা সরকার প্রহসন ও তামাশার রঙ ছড়াবে। জনগণ ধরে নিয়েছে সরকার জনগণের সাথে বিদ্রƒপ করেছে। এ বিদ্রƒপ বিগত পাঁচ বছর ধরে সহ্য করে আসা বিষকাঁটা বৈ তো নয়। কারণ, তিন দলের প্রতিনিধিত্ব¡কে সর্বদলীয় বলা এক ধরনের নির্জলা অসত্য তথ্য দেয়া, যা রীতিমতো মিথ্যাচার। এটাকে মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন ছাড়া আর কিছু বলা হবে কেন! এরা মহাজোটের শরিক দল। এ কটি দল বিগত পাঁচ বছর দেশের মানুষকে শাসন করেছে, ভদ্র ভাষায় ক্ষমতাচর্চা করেছে। সর্বোপরি এ ধরনের সরকারের ধারণা সংবিধানের সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক। সরকার সংবিধান থেকে এক চুলও না নড়ার ব্যাপারে বারবার বক্তব্য দিয়ে শরীরের সব রক্ত মুখে ও মাথায় তুলেছে। এখানে তারা থেমে যায়নি, বিরোধী দল ও জোটের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ধারণা সংবিধানসম্মত নয় বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা জানবাজ আন্দোলন করেছে। এখন যমের অরুচি। বস্তুত সঙ্কটের প্রসব হওয়ার মৌল কারণ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণা উপড়ে ফেলার জন্যই। মজার ব্যাপার হলো, মন্ত্রীর সাথে একজন উপদেষ্টারও নাম ঘোষণা করা হয়েছে। উপদেষ্টা কী উপদেশ দেবেন, কাকে দেবেন তাও স্পষ্ট নয়। কারা উপদেশ দেবেন, কারা দেবেন মন্ত্রণা তা যেন তালগোল পাকিয়ে দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণেই বিরোধী দল সরকারের এ ধরনের উদ্যোগকে তামাশা ও প্রহসন বলে মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে। সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ কেউ সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে পারলেন না। এটা যদি গাধার সামনে মুলাও হয় তা হলেও সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথে কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করবে না। যারা ঠেকে শিখেছে, দেখে শিখছে তাদের সামনে এ ধরনের ছেলে-ভুলানো গল্প কিংবা ললিপপ বড্ড বেমানান। বিরোধী দলের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের ধারণার প্রতি সরকারের এই অশ্রদ্ধা ও অরুচি প্রদর্শনের পর সঙ্কট নিরসনে সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার যে সমঝোতা চায় না সে ধারণাই জনগণ পেয়েছে। জনগণ গভীর পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে চাচ্ছে সংবিধান মানার দোহাই দিয়ে সরকার সংবিধানবহির্ভূত সর্বদলীয় ধারণা আমদানি করল কেন। অনেকের খোলামেলা মত, এর মাধ্যমে মহাজোট দলভুক্ত দল কটির মন্ত্রী হওয়ার জন্য এত দিন মুখিয়ে থাকা সব নেতাকে ক্ষমতা উপভোগ করার সুযোগ দেয়া হলো। একইভাবে সান্ত্বনা পুরস্কার দেয়া হলো সরকারি দলের বঞ্চিত ও অভিমানী নেতাদের। তাদের বাগে আনার একটা কৌশলী উদ্যোগও এর নেপথ্যে কাজ করতে পারে। জাতীয় পার্টিকে পোষ মানানোর এটি একটি কূটবুদ্ধিজাত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ফাঁদও বটে। তা ছাড়া ১৮ দলীয় জোটকে নির্বাচনের বাইরে রেখে এ-টিম, বি-টিম বানিয়ে একটি প্রহসনের নির্বাচনী খেলা জমিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার একটি বিকল্প ভাবনা সক্রিয় থাকাও সম্ভব। কারণ অতি চালাকেরা কাকের মতো লুকিয়ে নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে অভ্যস্ত। সরকার নিশ্চিতভাবে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। সঙ্কটের গভীরতা ও জনরোষের উত্তাপ ক্ষমতার দেয়ালে আঁচড় খাচ্ছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বেষ্টনীর কারণে গায় লাগছে না। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। মন্ত্রীদের পদত্যাগ করিয়ে সরকার বৈধতার সঙ্কটে পড়ে সহজ পথে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে। এই কৌশল অভিনব, মোক্ষম নয়। এতে সঙ্কট আরো ঘনীভূত ও দীর্ঘমেয়াদি হবে। বিরোধী দল আগবাড়িয়ে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ চেয়ে দূরদর্শিতা ও সঙ্কট উত্তরণে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। এখন দেশ ও জাতির স্বার্থে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। শেষ সুযোগটুকু হাতছাড়া হয়ে গেলে আম-ছালা দুটোই হারাতে হবে। প্রেসিডেন্ট যদি অভিভাবক হতে না পারেন, তা হলে অন্য কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। নিজেই কদর্য ক্ষমতার খেলায় জড়িয়ে গেলে ভারী জুতার আওয়াজ অবশ্যম্ভাবী। এটা মানতেই হবে, খালেদা জিয়া আবার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন। সরকার, সংবিধান ও রাষ্ট্রের অভিভাবকের ওপর সমঝোতা উদ্যোগের দায় তুলে দিলেন। এখন প্রেসিডেন্ট ব্যর্থ হওয়া মানে সরকার ব্যর্থ হওয়া। সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে প্রেসিডেন্ট বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগটাও হাতছাড়া করা। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন ছিলেন শিক্ষাবিদ। রাজনীতির ধূম্রজালে অন্ধকার দেখে ভুলবাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বদনাম কুড়িয়েছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাবেক স্পিকার। কম করে পাঁচবার সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সংবিধান জানেন। আইনের ফাঁকফোকর তার জানা। তিনি নিজেও জানেন তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা শেখ হাসিনা একক উদ্যোগে কিভাবে বাতিল করেছেন। মন্ত্রীরা গণপদত্যাগের মাধ্যমে কী জটিলতারইনা জন্ম দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর একাধিপত্য দল, দেশ, রাজনীতি ও সরকারকে কতইনা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি ভালো করেই জানেন, বিএনএফ কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নিবন্ধন পায়নি। দুদক আইন সংশোধন সঠিক হচ্ছে না তা-ও তার জানা। নির্বাচন কমিশন কতটা অনুগত ও মেরুদণ্ডহীন তারচেয়ে বেশি কেউ জানেন না। পতিত স্বৈরাচার এরশাদকে কোলে তোলার মাজেজাও তার অজানা নয়। সর্বদলীয় সরকারের সদস্যদের শপথ পড়ালেও এর সাংবিধানিক বৈধতা কী তা তিনি বোঝেননিÑ এ কথা মানা কষ্টকর। বিরোধী দল ঠেকানোর জন্য দৃশ্য-অদৃশ্য দেয়ালগুলো কেন তোলা হচ্ছে, তা জনগণের চেয়েও প্রেসিডেন্ট বেশি বোঝেন। ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ নির্বাচনকালীন কিছু করণীয় কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় প্রেসিডেন্ট চোখ বুলানোর সুযোগ পেয়েছেন। এই প্রধানমন্ত্রীকে পোষ মানিয়ে কারো পক্ষে এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন কি সম্ভব? না, মোটেই না। তা হলে? হ্যাঁ, পথ একটাই খোলা। প্রেসিডেন্ট গণপ্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে বাধ্য করবেন। সাংবিধানিক জটিলতা মুক্ত হতে উদ্যোগী হবেন। বিরোধীদলের একটি মাত্র দাবি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনকালীন সরকার, যা এখন দলমত নির্বিশেষে গণদাবি। বল এখন বঙ্গবভনে। তা আর গণভবনে যাবে না। গেলেও প্রেসিডেন্টকে চাইতে হবে। বিরোধীদলীয় নেত্রী ১৮ দলীয় জোট নেতাদের নিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে নালিশ করতে যাননি। হামলা-মামলার প্রতিকার চাননি। অঘোষিত জরুরি অবস্থার অবসানের দাবি তোলেননি। নেতাদের মুক্তি দাবি করেননি। বন্ধ মিডিয়া খুলে দিতে বলেননি। এখন প্রেসিডেন্ট নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেনÑ তিনি অভিভাবকত্ব করবেন, না আম্পায়ার হবেন। নাকি নিজেই দলীয় রাজনীতির নোংরা খেলায় জড়িয়ে যাবেন। বিরোধী দল তাকে আম্পায়ার হতে বলেনি। তিনি খেলায় জড়াক তাও চায়নি। শুধুই রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধানের অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে দৃঢ় অবস্থান নিতে অনুরোধ করেছেনমাত্র। এখন সমাধান তিন পথে, বিরোধী দলের দাবি মানার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে হাঁটা। যেভাবে চলছে তা চলতে দিয়ে সঙ্কট অনিবার্য করে তোলা এবং এর জের ধরে সেনাবাহিনীর সাহায্য কামনা করে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের রাস্তায় চলার শেষ আশা করা। তবে ভুলে গেলে চলবে নাÑ গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে চলতে না দিলে শুধু গণতন্ত্রের আর্তনাদই শোনা যাবে না, হাসিমুখে কুইনিন গিললে কুইনিন আপাতত জ্বর সারাবে, কুইনিন সারানোর মহৌষধ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads