সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৩

একতরফা নির্বাচনের জন্য সরকারের চেষ্টা


টেলিফোন সংলাপের মতো প্রশ্নসাপেক্ষ কিছু নাটকীয়তা করার আড়ালে শেখ হাসিনার সরকার আসলে নিজেদের ছক অনুযায়ী একতরফা নির্বাচনের পথেই এগোতে শুরু করেছে। এই উদ্দেশ্যে সরকার প্রথমে বিএনপির শীর্ষ পাঁচ নেতাকে গ্রেফতার এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করেছে। বিপুলসংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশ এবং সাদা পোশাকের সশস্ত্র লোকজন তার বাসভবনকে ঘিরে রেখেছে। সরকারিভাবে গ্রেফতার বা গৃহবন্দী করার কথা বলা না হলেও বাসভবনের বাইরে এমনভাবে প্রহরা দেয়া হচ্ছে যেন সেখানে ভয়ংকর কোনো শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছে তারা! ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুনিয়েছেন দুই ধরনের কথা। একবার তিনি বলেছেন, হরতালে বিক্ষুব্ধ জনতা তার ওপর হামলা চালাতে পারে মর্মে খবর পেয়েছেন বলেই তারা নাকি বিরোধী নেত্রীর নিরাপত্তার জন্য প্রহরা বসিয়েছেন! এরপর একই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে ঘোষণা করেছেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। অর্থাৎ প্রয়োজনে বিরোধী দলের নেত্রীকেও গ্রেফতার করা হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও কম শোনাচ্ছেন না। আজকাল প্রতিটি বক্তৃতাতেই বেগম খালেদা জিয়াকে তিনি ‘খুনি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে চলেছেন। অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও দলের নেতারাও বিরোধী নেত্রীকে গ্রেফতার করার এবং মানুষ হত্যার দায়ে হুকুমের আসামী বানানোর হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের একজন বলেছেন, হরতাল-আন্দোলন বন্ধ না করলে বিরোধী দলের সব নেতাকেই গ্রেফতার করা হবে। এভাবে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে, অভিযোগ এবং মামলার সবই আসলে বানোয়াট, নতি স্বীকার করানোর এবং ক্ষমতাসীনদের ছক অনুযায়ী অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করার জন্যই বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়েছে। একই কারণে বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নেতাদের ভীত-সন্ত্রস্তও করা হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, যে কোনোভাবে একতরফা নির্বাচন করতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা, যাতে আবারও তারাই ক্ষমতায় আসতে পারেন। ক্ষমতাসীনদের অন্য কিছু পদক্ষেপ থেকেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
একটি উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির কথা বলা যায়। এটা শুরু হয়েছে ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৮৪ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন ১০ নভেম্বর থেকে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার বিষয়টি এসেছে দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন যে সর্বদলীয় সরকারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন সে সরকার গঠনের জন্যই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। স্মরণ করা দরকার, প্রধানমন্ত্রী এক ঘোষণায় জানিয়ে রেখেছেন, আওয়ামী লীগের ১০ জনের সঙ্গে অন্য দলগুলোর ১০ জনকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হবে। ওই সরকারের প্রধান কে হবেন সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে এখনও কিছু বলেননি সত্য কিন্তু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শেখ হাসিনার নাম বলে চলেছেন। সংশয়ের সৃষ্টিও হয়েছে একই কারণে। কেননা, বেগম খালেদা জিয়াও সুনির্দিষ্টভাবেই জানিয়ে রেখেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত কোনো সরকারের অধীনেই তারা নির্বাচনে যাবেন না। এদিকে আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি দেশের বড় কোনো দলই কথিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নেবে না।
এ জন্যই বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা আসলে জেনে-বুঝেই একতরফা নির্বাচনের উদ্দেশে পা বাড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শুধু কথিত সর্বদলীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতেই শুরু করেননি, বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে আসতে এবং বাধাহীনভাবে তৎপরতা চালাতে না পারে সে ব্যাপারেও একের পর এক সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন। বিএনপির পাঁচ শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার ও বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করার এবং দেশজুড়ে দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের অভিযান চালানোর মতো কর্মকা-কে নিশ্চয়ই সমঝোতামুখী চেষ্টা বলা যায় না। নিশ্চিতভাবে বরং বলা যায়, সরকার আসলে দেশি-বিদেশি সব মহলের দাবি, আহ্বান ও পরামর্শের প্রতিই উপেক্ষা দেখিয়ে চলেছে। ক্ষমতাসীনদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, প্রচ- দমন-নির্যাতন চালানোর এবং গ্রেফতার করার ও মিথ্যা মামলা চাপানোর মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে যাওয়া। কিছু দূর পর্যন্ত এগিয়ে তারা যেতেও পারেন। আমরা কিন্তু মনেই করি না যে, তাদের চাওয়াটাই শেষ কথা হবে। কারণ, জনগণই শুধু সবকিছু দেখছে না, জাতিসংঘ তো পর্যবেক্ষণ করছেই, পাশাপাশি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও গণচীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোওÑ যারা চায়, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। দেশগুলো এরই মধ্যে বর্তমান সহিংস রাজনীতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিও দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট অংশ না নিলে কোনো নির্বাচনই যে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না সে কথাটাও অনেক উপলক্ষেই জানিয়ে রেখেছে তারা। সুতরাং সময় থাকতেই ক্ষমতাসীনদের উচিত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ থেকে ফিরে আসা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একই সঙ্গে দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের অভিযানও বন্ধ করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের তো মুক্তি দিতেই হবে। না হলে তার জন্য অপেক্ষা করবে  গণঅভ্যুত্থানের অশুভ পরিণতি, যা কারো কাম্য হতে পারে না। লক্ষ্য করা দরকার, জনগণ যে বিরোধী দলের আহ্বানে সাড়া দিতে এগিয়ে এসেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ধারাবাহিক হরতালের সাফল্যে। ৬০ ঘণ্টার দুটি হরতালের পরপর ৮৪ ঘণ্টার চলমান হরতাল পালন করার মধ্যদিয়েও জনগণ একদিকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে, অন্যদিকে প্রত্যাখ্যান করেছে সরকারের একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টাকে। জনগণের এই সমর্থন ও প্রতিক্রিয়ার কথাটা অনুধাবন করলে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে ক্ষমতাসীনরা তো বটেই, দেশ ও জাতিও উপকৃত হবে সর্বতোভাবে। বিশেষ করে বিপদ কেটে যাবে  গণতন্ত্রের।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads