মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

বিকল লাল ফোন, অচল জনজীবন


চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে প্রধান দুই দলের পাল্টাপাল্টি প্রস্তাব-পরবর্তী চিঠি চালাচালি ও ফোনালাপ ইত্যাদি সম্পর্কে সবাই অন্তর্গত। অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টিতে বা নির্বাচনী ঐকমত্যে কিংবা কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে উভয় দলের শীর্ষনেত্রীর প্রস্তাবে ন্যূনতম হলেও ছাড়ের মানসিকতার ওপর জোর দিতে হয়। ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৬০ ঘণ্টার হরতাল। হরতালকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। হরতালের আগে কোথাও কোথাও রাজপথে গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। ভিআইপি মন্ত্রী-এমপিদের ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বাসভবনের সামনে ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একই ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিক ও আইনজীবীদের বাসভবনেও হামলা হয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বাড়িতে গুলি ছোড়া হয়েছে। বিভিন্ন দলের কার্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানি ঘটেছে। বিপর্যস্ত হয়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নাশকতা। সর্বত্র বিরাজ করছে আতঙ্ক। সহিংস ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে কয়েক হাজারেরও বেশি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী। দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীন সরকার। দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নাটকীয়তা শুরু হয় ঈদের পর ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায়। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সে সরকারের প্রধান এবং নির্বাচনের সময় জাতীয় সংসদ বহাল থাকা সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না তার প্রস্তাবে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠনের পাল্টা প্রস্তাব রাখেন বিরোধীদলীয় নেত্রী। প্রধান দুই দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত নাগরিককে নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে খুঁজে বের করার সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল প্রস্তাবে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে পাল্টাপাল্টি প্রস্তাবে সর্বত্র শুরু হয় নানামুখী আলোচনা। প-েবিপে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। উভয় দলকে গঠনমূলক আলোচনায় বসার আহ্বান জানায় জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া। পর্দার আড়ালে দৃশ্যপট চূড়ান্ত করতে দিল্লিতে ছুটে যান ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। আলোচিত ২৫ অক্টোবরের জনসভায় টানা হরতালের আলটিমেটাম দেয়া হয়। পরদিন দুপুর থেকে শুরু হয় মূল পর্বের নাটক। সরকারদলীয় টেলিভিশন চ্যানেলের সৌজন্যে প্রচারিত হয় নাটক ‘বিকল লাল ফোন’। বহু নাটকীয়তার পর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মুঠোফোনে কথা বলেন বিরোধীদলীয় নেতার সাথে। ফোনালাপে তিক্ত কথার কাঁটা ফোটানো হয়। লাল ফোনটি বিকল ছিল নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে বিকল করে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে কটা করা হয়। দোষারোপ করে প্রতিপকে ঘায়েলের চেষ্টা করা হয়। নরম সুরে গরম অসংযত ও অনাকাক্সিত বাক্য বিনিময় হলো। ফোনেই চলে একে অপরের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ। ‘আমি নিজে আপনাকে ফোন করেছি। অনেকণ রিং হয়েছে। শব্দ শুনেছি। আপনি ইচ্ছা করেই ফোন ধরেননি। আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনার কানে হয়তো সমস্যা আছে’ ইত্যাদি। ফোনালাপে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়। গণভবনে এক সাথে ডালভাত খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাৎণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করা হয়নি। হরতাল প্রত্যাহারে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। সংলাপ ও আন্দোলন এক সাথে চালানোর কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর তিন দিন নিজেদের ডাকা হরতাল থাকায় এরপর যেকোনো দিন সংলাপে বসার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য নতুন দিনণ ঠিক করে গণভবনে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হলো। কেউ কেউ আশা করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ রা না করায় যেন সংলাপের সম্ভাবনা শেষ হয়ে না যায়, সে জন্য প্রয়োজনে বিরোধীদলীয় নেতা দিনণ ঠিক করে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দেবেন। এ দিকে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিরোধীদলীয় নেতার নৈশভোজের মেনু জানতে চাওয়া হয়েছে। কী নিয়ে আলোচনা হবে তা নয় বরং কী খাওয়ানো হবে তা নিয়ে ব্যস্ত। অর্থবহ সংলাপে উভয় দলের শীর্ষনেত্রীদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে চিঠি চালাচালি, নৈশভোজ ও টেলিভিশন চ্যানেল ঠিক করে ফোনালাপের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দুই নেত্রী ভালো করেই জানেন, সঙ্কট নিরসনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উভয় প্রস্তাবে ন্যূনতম ছাড়ের মনোভাব এবং সঙ্কট নিরসনে আন্তরিকতার। অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টিতে উভয়পকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। আলোচনার পরিবেশ কিছুতেই নষ্ট করা চলবে না। সঙ্ঘাত এড়াতে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। সহিংসতায় দুই দলের পারস্পরিক অনাস্থা ও মতপার্থক্যের অবসান ঘটবে না। বরং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটবে। স্বৈরাচারী কায়দায় সরকারি নির্দেশে নির্বিচারে মিছিলে গুলি চালানো হলো। থামবে না মৃত্যুর মিছিল। রক্তে রঞ্জিত হবে রাজপথ। তখন নিশ্চয়তা থাকবে না সাধারণ মানুষের জানমালের। ফলে রাষ্ট্র হবে ব্যর্থ। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন দেশ ও বন্ধুপ্রতিম সংস্থা অনেক আগে থেকেই সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অঙ্গীকারবদ্ধ। বারবার তারা একই কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। ভারতের অবস্থান অবশ্য একটু ভিন্ন। বাংলাদেশে জঙ্গি কার্ড নিয়ে রীতিমতো দাবা খেলছে ভারত। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ভারতীয় হাইকমিশনারের মধ্যে ঘন ঘন বৈঠক চলছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বোঝানো হয়েছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল মতায় এলে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটবে। নতুন করে জন্ম হবে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের মতো শীর্ষ জঙ্গির। এতে দণি এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। আলামত হিসেবে নির্বাচনকে সামনে রেখে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ইতোমধ্যে অপপ্রচার চালিয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে পাকিস্তানের আইএসআই। ভারতের সাথে এই অপপ্রচারে যোগ দিয়েছেন বিলাতপ্রবাসী বয়োবৃদ্ধ কলাম লেখক। বসে নেই মার্কিন নাগরিক ও প্রযুক্তিবিদ উপদেষ্টা। ফেসবুকে ও টুইটারে নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত একটি সন্ত্রাসী জোট। এরা মতায় এলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ফিরে আসবে। দেশে নৈরাজ্য কায়েম হবে। নির্বিচারে বোমা হামলা চালাবে। তাতে বহু প্রাণহানি ঘটবে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মকে রাজনীতিতে জড়াতে চায় না। এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করা যায় ততই মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads