মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

তফসিল সংকটকে আরো জটিল করেছে


নির্বাচন কমিশন দশম জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করবে বলে বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। তারিখ হিসেবে গত ২৪ ও ২৫ নবেম্বরের কথা শুনিয়েছিলেন একজন নির্বাচন কমিশনার। শোনার পর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্তও হতে শুরু করেছিল। ১৮ দলীয় জোট আগেই জানিয়ে রেখেছিল, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তফসিল ঘোষণা করা হলে সেদিন থেকেই হরতাল অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশকে অচল করে ফেলা হবে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ৬০ ঘণ্টার দুটি এবং ৮৪ ঘণ্টার একটি সফল হরতালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জনমনেও এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে, সরকার যতো দমন-নির্যাতনই চালাক না কেন, বেগম খালেদা জিয়া আহবান জানালে এবার সাধারণ মানুষও দলে দলে রাজপথে নেমে আসবে। তেমন অবস্থায় সত্যিই অচল হয়ে পড়বে দেশ। অন্যদিকে গণতন্ত্রের জন্য তো বটেই, দেশ ও জাতির জন্যও যে এমন কোনো পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না, সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। কথাটা নির্বাচন কমিশনও বুঝেছিল বলেই মনে করা হচ্ছিল। কারণ, দুদিন আগে রোববারই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, কমিশনের দিক থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলেও তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা চান, সব দলের অংশগ্রহণের ফলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠুক। কোনো দলের নাম উলেখ না করলেও মূলকথায় সিইসি আসলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতিই ইঙ্গিত করেছিলেন। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং সে চেষ্টা সফল হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কেও ইশারায় জানিয়েছিলেন সিইসি। ফলে জনমনে এমন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল যে, কমিশন অন্তত সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার আগে তফসিল ঘোষণা করবে না।
অন্যদিকে মাত্র একদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত পাল্টে ইউটার্ন নিয়েছেন সিইসি। সোমবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক আকস্মিক ভাষণে তিনি ৫ জানুয়ারি ভোটগ্রহণসহ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার আগেই হঠাৎ করে তফসিল ঘোষিত হওয়ায় ১৮ দলীয় জোট তো বটেই, নাগরিক সমাজসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুুযায়ী ১৮ দলীয় জোট মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক, নৌপথ ও রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ভাংচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়েছে সিইসির ভাষণ শেষ হতে না হতেই। দেশের বহুস্থানে রেললাইন পর্যন্ত উপড়ে ফেলা হয়েছে। দেশকে অচল করে দেয়ার যে ঘোাষণা ১৮ দলীয় জোট দিয়েছিল বাস্তবে সেটাই সত্যে পরিণত হতে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে এবং তেমন পরিস্থিতিতে কমিশনের পক্ষে আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। বলা হচ্ছে, সিইসির এ ভাষণের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সে মন্তব্যই সত্য প্রমাণিত হয়েছেÑ যার মুলকথায় বিরোধী দলের নেত্রী বলেছিলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদ-হীন’। এবার দেখা গেলো, ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদ-হীন’ তো বটেই, কমিশন সরকারের অতি যোগ্য বশংবদের ভূমিকাও পালন করতে উঠেঁপড়ে নেমেছেÑ যেন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনার সব কর্তব্য কমিশনের ওপরই চেপে বসেছে! যেন জনগণের অধিকার ও আকাংক্ষা, রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি এবং গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানোর ব্যাপারে কোনো দায়িত্বই নেই কমিশনের! উল্লেখ্য, মূলত এ ধরনের নীতি ও কর্মকা-ের কারণে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজও অনেক আগে থেকে এই কমিশনের বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রকাশ ঘটিয়ে এসেছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের অধীনে এমনভাবে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন যাতে তিনি নিজে এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ তার দলীয় প্রার্থীরা পরিপূর্ণ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এ উদ্দেশ্যে প্রশাসনকে ষোলো আনা দলীয়করণ করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো বেশ কিছুদিন ধরে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়েই সরকারি খরচে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু ইসিকে কখনো প্রতিবাদ জানাতে বা আইনত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কথা শুধু এটুকুই নয়। কর্তব্য যেখানে ছিল নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, নির্বাচন কমিশনাররা সেখানে উল্টো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন। পদ ও ক্ষমতা না ছেড়েই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে ও প্রচারণাসহ তৎপরতা চালাতে পারেন তার বিধান রেখেও নির্বাচনী আচরণবিধিতে সংশোধনী এনেছে কমিশন। এর ফলে বহুল আলোচিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই শুধু নষ্ট হবে না, ক্ষমতাসীনদের জন্য কারচুপি এমনকি ভোট ডাকাতি পর্যন্ত করা আইনসিদ্ধ হয়ে উঠবে। এরই পাশাপাশি বিএনপির আদলে বিএনএফ নামের একটি ভূঁইফোড় দলকে নিবন্ধন দেয়ার ব্যাপারে মাতামাতির মাধ্যমেও কমিশন বর্তমান সরকারের পক্ষেই ভূমিকা পালন করেছে।
অর্থাৎ সব কর্মকা-ের মাধ্যমেই ইসি তার গ্রহণযোগ্যতা খুইয়ে ফেলেছে। এই ইসির অধীনে তাই কোনো সষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেই সকল মহলের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলে আসা হচ্ছিল। অবশেষে তফসিল ঘোষণার মধ্যদিয়ে সে অভিযোগকেই সত্য প্রমাণ করেছেন সিইসি। একই কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জনগণও শুধু নিরাশ হয়নি, ক্ষুব্ধও হয়ে উঠেছে। অথচ সদিচ্ছা থাকলে খুব সহজেই এমন পরিস্থিতি এড়ানো যেতো। সেটাই কমিশনের দায়িত্বও ছিল। সিইসি নিজেও যে রাজনৈতিক সংকটের কথা বলেছেন, সে সংকট কাটিয়ে ওঠা গেলেই সবার আশা পুরণ করে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হতো। সন্দেহ নেই, এজন্য প্রধান দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু কমিশনও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারতো। সরকারকে উপর্যুপরি অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি কমিশন বিএনপির সঙ্গেও বৈঠকে বসতে পারতো। অন্যদিকে মাত্র একদিনের ব্যবধানে সম্পূর্ণ ইউটার্ন নেয়ার মাধ্যমে সিইসি প্রমাণ করেছেন, তিনি তৎপরতা চালাচ্ছেন আসলে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পুরণের জন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে তফসিল ঘোষণার কারণে পরিস্থিতিই কেবল সংঘাতমুখী হয়ে উঠবে না, নির্বাচন অনুষ্ঠানও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। আর সবকিছুর জন্য দায়ী থাকবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন।
 বিষয়টি নিয়ে এখনো ভাবনার সময় রয়েছে এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার সুযোগ এখনও নাগালের বাইরে চলে যায়নি বলেই আমরা মনে করি। ক্ষমতাসীনদের বশংবদের ভূমিকা পালনের পরিবর্তে কমিশনের উচিত সম্ভাব্য সব পন্থায় সমঝোতার জন্য সচেষ্ট হওয়া। সেজন্য অবশ্যই ঘোষিত তফসিল বাতিল করতে হবে এবং বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের সম্মতি ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো চলবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads