বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৩

গণতান্ত্রিক রাজনীতির জয়-পরাজয়


বাংলাদেশে এখন মনে হচ্ছে রাজনীতি-নাটকের শেষ দৃশ্য মঞ্চায়িত হচ্ছে। অচিরেই নির্ধারিত হবে জয়-পরাজয়। এ রকম মনে করার কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার চলতি ক্ষমতার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে। মন্ত্রীবর্গ পদত্যাগের মহড়ায় অংশ নিয়েছেন। কেউ বলছেন পদত্যাগ করা সম্পন্ন হয়েছে। কেউ বলছেন, এখনও ‘চূড়ান্ত’ পদত্যাগ হয়নি। বিরোধী দল বলছে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়া সঙ্কট সমাধানের পথ পাবে না। এমন অবস্থায় সাংবিধানিক ধারা এবং গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সংলাপ-সমঝোতা এবং আন্দোলন, এর মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার সময়ও সম্ভবত এসে গেছে। তাই শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, রাজনীতি নাটকের শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ হচ্ছে।
এই নাটকে রাজনীতিবিদগণের কোন দল জয়ী হবেন, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রের অবস্থা কেমন হবে, একদলীয় নির্বাচনে পর্যবসিত হবে কিনা, সেটাও স্পষ্ট নয়। আলোচনা এখন রাজনীতিবিদ আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির জয়-পরাজয়কে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।  
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাধারণভাবে সেরা রাজনীতিবিদ আমরা সাধারণত কাকে বলি বা কাদের বলি এবং সেটা কেন বলি? যার উদ্ভাবিত কৌশলের সামনে এসে বিপক্ষ দলের কৌশল নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। যার কৌশল যত বেশি, যিনি যত বেশি নির্বাচনী বা রাজনৈতিক বাজি জিততে পারেন, তিনি তত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন । এটাই এখনকার দস্তুরÑরেস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানত, কৌশলের বিপক্ষে আর একটি তুখোড় কৌশলÑ এইভাবেই রাজনীতিবিদদের ক্রিয়াকলাপকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। মূলত কৌশল-প্রতিকৌশলের প্যাঁচ-মারামারি দেখতেই আমাদের কৌতূহল আজ রাজনীতির মল্লভূমির দিকে এগিয়ে যায়। রাজনীতির মানবকল্যাণমুখী স্রোতটি চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আসলেই তো! আজকের বিশ্বায়নের খেলায় কূটকৌশল-চাতুর্য ছাড়া কি রাজনীতি হয়! [সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নাটকগুলো লক্ষ্যণীয়] যিনি যত কূট, চতুর, কৌশলী ও প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন, বাক্যবাগিসÑতিনি তত বড় রাজনীতিবিদ। কৌশলের পর কৌশলÑইস্যুর পর ইস্যুÑওয়াদার পর ওয়াদাÑপুনশ্চ ফের কৌশল! এই কৌশল প্রয়োগের অদ্ভুত চমৎকারিত্ব একদিন কখন আচ্ছন্ন করে দেয় জনগণের দৃষ্টি, মানুষ সেটা বুঝতে পারে না কিংবা বোঝে অনেক দেরিতে। তখন মানুষ ভেবে দেখে, এত সব ইস্যু আর কৌশল উদ্ভাবনের পেছনের আসল কারণ কি? সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হলো কি এতে? বিপক্ষ দলকে বেকায়দায় ফেলে নিজেকে বাঁচানো ছাড়া এ সবের অন্য কোনো জনস্বার্থমুখী উদ্দেশ্য আছে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর জনগণ অবশ্যই পেয়ে থাকেনÑতবে বেশ পরে। কৌশলের চক্কর থেকে বের হওয়ার পর। ততদিনে দিন বদল হয়ে যায়। এটাই সম্ভবত দিন বদলের ডিজিটাল রাজনীতি!
রাজনীতির ময়দানে কৌশলের উদ্বাহু নৃত্যের মধ্যে মূল্যবোধ এমনই একটি শব্দÑযা রাজনীতিবিদগণের মুখে কখনো কখনো উল্লিখিত/উচ্চারিত  হয় বটেÑকিন্তু এর ব্যবহারিক প্রয়োজন কখনোই হয় না। ফলে আদপে এর কোনোই প্রয়োগ ঘটে না। অতএব ক্ষমতায় আসীনগণ এহেন মৌখিক ‘মূল্যবোধ’-এর তোয়াক্কাও করে না বললেই চলে।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক আইন এবং আইন সম্পর্কিত মূল্যবোধের কথা। এটা সকলেরই জানা যে, প্রায়-কোনো আইনই শতভাগ নিñিদ্র নয়। এ কারণেই হয়ত কথায় বলে ‘আইনের ফাঁক’। যদি কোনো আইন, কোনো বিশেষ বিষয়ের সংজ্ঞা ভালোভাবে দিতে না পারে, তবে সেক্ষেত্রে, সে আইন ঝাপসা ও অস্পষ্ট। তাকে স্বচ্ছ বা স্পষ্ট নিশ্চয়ই করা যায় যথাযথ উপায়ে। অর্থাৎ বিধিবদ্ধভাবেই সংশোধন করা যায়। তাছাড়া, হয়ত যাদের হাতে আইনটি প্রণীত হয়েছিল, তা থেকে বর্তমানে এর প্রয়োগক্ষেত্রের জটিলতাও বৃদ্ধি পেয়ে অস্বচ্ছতা ও ঝাপসা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং সময় এবং পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক পরিবর্তনের চাহিদা আইনের মধ্যে জন্মাতেই পারে। তার জন্য রীতি-পদ্ধতিও রয়েছে। কিন্তু, এই যদি হয় যে, আমি যেই বিপদে পড়লাম বা সুবিধা মনে করলাম, অমনি ভাবলাম আইন বদলে দেবÑএটা তো নীতির কথা নয়Ñমূল্যবোধের তো নয়ই। এটাকে বলা যায় অনৈতিকতা। যখন আইন আমার সুবিধা মত ব্যবহার করা যাচ্ছে নাÑতখনই তাকে বদলাবার কথা ভাবছি আর নিজের মতো করে আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করছিÑএটা হলো মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করার উদাহরণ। আইন যতক্ষণ বলবৎ রয়েছে, সে আইন মেনে চলা কর্তব্য। গণতন্ত্র, সংবিধান, মানবাধিকার, আইনের শাসন সকলের জন্য সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য। এক্ষেত্রে বেশি দূরে না-গিয়ে কাছে একটি উক্তি তুলে ধরতে পারি। মানবাধিকার নেত্রী আইরিন খানের ভাষ্য হলো: “মানবাধিকার ক্ষুণœ করার কোনো অজুহাত থাকতে পারে না, তা সে নিরাপত্তা বা স্বাধিকার, যে নামেই হোক না কেন।” (চ্ঞযবৎব রং হড় বীপঁংব ভড়ৎ যঁসধহ ৎরমযঃং ধনঁংব, যিবঃযবৎ রহ ঃযব হধসব ড়ভ ংবপঁৎরঃু ড়ৎ রহ ঃযব হধসব ড়ভ ষরনবৎধঃরড়হ.”)
ফলে সেটা শুধু তত্ত্বকথায় নয়Ñব্যবহারিক কার্যক্ষেত্রেও প্রতিপালিত হওয়া জরুরি। আইন ও নিয়মকে নিজেদের জন্য একভাবে আর প্রতিপক্ষের জন্য আরেকভাবে চালানোর চেষ্টাও গর্হিত কাজ। নিজের স্বার্থে আইন ও নিয়মকে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, প্রয়োগ বা অদল-বদল করার প্রবণতা অরাজকতার সৃষ্টি করবে। এতে কোনো আইন বা নিয়মই দৃঢ় ভিত্তি বা সার্বজনীন অবয়ব পাবে না। এক ধরনের অরাজকতা বা শৈথিল্য এসে যাবে আইনের বা নিয়মের ক্ষেত্রে। অতএব, আইন মান্য করার মানসিকতা, সে আইন আমার বিপক্ষে বা প্রতিপক্ষের পক্ষে গেলেও এবং তা থেকে কৌশল করে পালাবার উপায় বা বদলানোর সামর্থ্য আমার থাকলেও, সেই সুযোগ নেয়াটা মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খায় না। আত্মসম্মানবোধের সঙ্গেও খাপ খায় না।
আত্মসম্মানÑএই আর একটি শব্দ, যার প্রয়োজন রাজনীতিতে সাধারণত হয়ই না। ক্ষমতায় পৌঁছানোÑতারপর ক্ষমতার প্রয়োগ ও প্রদর্শনÑএতেই কি আমার আত্মসম্মান বজায় রইল? অনেকের কাছেই বিষয়টি এভাবেই আছেÑঅনেকেই এভাবেই তৃপ্ত। কিন্তু সত্যিকারের আত্মসম্মানবোধ অন্য বস্তু। অপরকে যথাযথ সম্মান দেয়ার মাধ্যমেই যে আত্মসম্মানের পরিচয় পাওয়া যায়Ñসেটা অনেকেরই অজানা। নিজের বড়াই করে বেড়ানোর নাম আত্মসম্মান নয়।
ছোট আয়তন হলেও কিন্তু বিরাট জনসংখ্যার বিশাল এই দেশ বাংলাদেশ। ন্যায় ও মুক্তির সংগ্রাম-সঞ্জাত সুমহান ও সুউচ্চ এদেশের চিরায়ত ঐতিহ্য। সকল মত-পথ-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-অঞ্চলের মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে চায় যে-দেশ, সে-দেশের উত্তরাধিকারের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ত্যাগ, মহানুভবতা, শিষ্টতা, পরহিত ও আত্মনিবেদনের আদর্শিক পরাকাষ্ঠা। শতাব্দীর পর শতাব্দী সে কথাগুলোই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন এদেশের বরেণ্য পুরুষেরাÑস্বাধীনতার সৈনিকেরাÑজনমুখী রাজনীতিবিদেরা। এমন একটি কথাই আমরা শুনতে পাই উইলিয়াম এফ. বাকলে-এর কণ্ঠে: “সংখ্যাগরিষ্ঠের তোষামোদ করতে আমরা এতই ব্যস্ত থাকি যে, আমাদের আর খেয়ালই থাকে না, একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা দূরে থাকুক, সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও মাঝেমাঝেই সংখ্যাগরিষ্ঠকে নমিত করা প্রয়োজন।” সেইসব আদর্শ আজকের রাজনীতিবিদদের অনেকের কাছেই প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে এসেছে। মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ক্ষমতার মোহ। কূট, কৌশল, ইস্যু, চতুরতার মোহ। মূল্যবোধ, আত্মসম্মান আর মানবিকতাকে বিতাড়িত করেছে রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে। রাজনীতি এখন কেবলই ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, বৈভব, দাপট ও দখলদারিত্বের এক হিংসা ও রক্ত-প্লাবিত রণাঙ্গন ছাড়া আর কিছু নয়।  
তত্ত্বকথায় আছেÑহিংসা, হিংসার জন্ম দেয়। সন্ত্রাস, সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। বলপ্রয়োগ, আরো বলপ্রয়োগকে ডেকে আনে। অনাচার-অনিয়ম, বিপদ তৈরি করে। কথাগুলো তত্ত্বগত হলেও বাস্তব-বিবর্জিত নয়। বাস্তবের মাঠ থেকেই এগুলো উঠে এসেছে তত্ত্বের পাতায়। ২০১৩ সালের শেষ সময়ে রাজনীতির সালতামামী করার সময় তত্ত্ব আর বাস্তবের বিষয়গুলো নতুন করে তুলনা করা দরকার। খানিকটা মূল্যায়নও হওয়া দরকার রাজনীতির। কেবল কূট, কৌশল আর চতুরতাই যে রাজনীতির শেষ কথা নয়Ñমূল্যবোধ, আত্মসম্মান, ত্যাগ, পরহিত, পরমতসহিষ্ণুতা আর সহনশীলতারও যে গুরুত্ব আছে বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রেÑএ কথাগুলোও পুনরুচ্চারিত হওয়া দরকার। কেননা, শাশ্বত-অর্থে রাজনীতি হলো রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কিত বিজ্ঞান। হিংসা, কূটচাল, কৌশল, চতুরতা দিয়ে আপাত বিজয় লভ্য হলেও রাষ্ট্র ও নাগরিকগণের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়গুলো সুস্থ ও কাম্য স্তরে নেয়া যাবে না। উন্নয়ন প্রচেষ্টাতেও জনঐক্য নিশ্চিত হবে না। ক্ষমতার প্রতিযোগিতাই প্রলম্বিত হবে মাত্র।
রাষ্ট্র বা রাজনীতি কেবল ক্ষমতা আর শক্তির  প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয়। আত্মস্বার্থের ময়দানও নয় রাজনীতি। রাজনীতি হলো জ্ঞানালোকিত-উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর হিংসামুক্ত-সমৃদ্ধ-নিরাপদ-সুখী নাগরিক সমাজ গঠনের চলমান প্রক্রিয়া। রাজনীতিতে সবচেয়ে সামনে ও গুরুত্বের জায়গাটিতে জনগণের অবস্থানÑব্যক্তি বা দলের নয়। ২০১৪ সালকে সামনে রেখে, অনাগত দিনের শত-সঙ্কুল সমস্যাকে ভুলে গিয়ে আমরা যখন আশাবাদী প্রত্যয়ে জেগে উঠতে চাই, তখন হেনরি ডেভিড থরো-এর এই কথাগুলোকে সামনে রাখতে পারি: “রাষ্ট্র যে পর্যন্ত ব্যক্তিকে উচ্চতর ও স্বাধীন ক্ষমতা হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়, যা তার নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস, এবং যে পর্যন্ত ব্যক্তির সঙ্গে সে অনুসারে আচরণ না করেÑততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকারের কোনো মুক্ত ও জ্ঞানালোকিত রাষ্ট্র হবে না।”
হিংসাদগ্ধ-অন্ধকূপের কুটিল স্রোত ডিঙিয়ে, জিঘাংসার শ্বাপদ তা-ব মাড়িয়ে, ঘৃণার পিচ্ছিল নর্দমা ছেড়ে আমাদের রাজনীতি একটি কল্যাণমুখী দিক-নিদের্শনার পথ ধরে এগিয়ে যাবে সামগ্রিক কল্যাণের পথে।  আমাদের জন্য বিভক্তিহীন, সংঘাতমুক্ত, সমাজ বিনির্মাণের পথে জন-চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাবেÑ২০১৪ সালে এমন প্রত্যাশাই সকলের। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এমন সাধু প্রত্যাশার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। যাদের দিকে তাকিয়ে আমরা আশা করবো, সেইসব ক্ষমতাধরগণ দেশের সাংবিধানিক শাসন ও গণতন্ত্রের কি অবস্থা করেছে, সেটা ভেবে উদ্বিগ্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাস্তবিক অর্থেই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন প্রকৃত-অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। বহুমত ও বহুদলের সমন্বয়ে সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রায়-ব্যর্থ। আইনানুগ-নিয়মতান্ত্রিকতা চরম অবক্ষয়প্রাপ্ত। সরকার আর বিরোধী দলের যুদ্ধংদেহি-মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে চলছে হরতাল। কেউই বলতে পারবেন না, সঙ্কটের আদৌ কোনও সমাধান গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সম্ভব হবে কি না!
এমনই ঘোরতর অনিশ্চয়তায় শাসনতান্ত্রিক আদর্শের যে গণতান্ত্রিক ভিত মানব মন ও সমাজের অনেক শক্ত জমিতে প্রোথিত থাকে, তা প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যায়; স্থবির হয়। অথচ যে গণতন্ত্রকে বিদ্যমান রাজনীতিতে ক্ষয়িষ্ণু ও স্থবির করে রাখা হয়েছে, তার জন্য জনগণের চাহিদা ও দাবি উঠে ইতিহাসের পর্বে পর্বে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন মানবসভ্যতার সূচনা থেকেই বিশ্বের শহরে-বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে ফুলকি থেকে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। কখনও কখনও প্রতিবাদে-বিক্ষোভে সামিল হয়েছে হাজার-হাজার মানুষ; কখনও পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে নীরবেÑÑইতিহাসে এমন দৃশ্য বিরল নয়। গণআন্দোলন পেয়ে গিয়েছে উডি গ্যাথ্রি বা পিট সিগারের মতো শিল্পীর সমর্থনপুষ্ট অবিস্মরণীয় বহু আন্তর্জাতিক সঙ্গীত। পিট সিগারের ‘টকিং ইউনিয়ন’ গানের কথাগুলো আজকেও ভাসছে বিশ্বায়নের গ্লোবাল বাতাসের ডিজিটাল স্রোতে: ‘বেটার ওয়ার্কিং কনডিশন্স/ভেকেশন্স উইথ পে/টেক ইওর কিডস টু দ্য সি-শোর...।’ যদিও সামরিক জান্তা কাছে পরে পরাজিত হয়, তথাপি এমন্ই শতকণ্ঠ মুখরিত হয়েছিল সাম্প্রতিক আরব জগতে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, গত শতাব্দীর পাঁচ কিংবা ছয়ের দশকে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। সত্তরে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলেছে। আশি ও নব্বই দশকে গণতন্ত্রের জোয়ার বয়ে গেছে। চীনের ‘তিয়েনমান স্কোয়ার’ বা কাঠমা-ুর ‘রিপাবলিকান স্কোয়ার’ ভেসে গেছে ছাত্র-জনতার বাধ-ভাঙা উচ্ছ্বাসে। আরব জগতে কিছু আগে এসেছিল মহামুক্তির ‘ইন্তিফাদা’-এর জেসমিন আন্দোলন, পশ্চিমারা যার নাম দেয় ‘ডোমিনো ইফেক্ট’। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মহানিনাদের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কি হচ্ছে? গণতন্ত্রকে লালন নাকি আঘাত করা হচ্ছে? ইতিহাসের শিক্ষা হলো, গণতন্ত্র আঘাত সহ্য করে না; দম্ভ মানে না; রক্তাক্ত হলে আহত বাঘের মতো বজ্র হুঙ্কারে সব কিছু তছনছ করে দেয়। নিকট-অতীতের একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জনতার আন্দোলনকে সাভাক-পুলিশের আক্রমণে রক্তাক্ত করে ১৯৭১ সালে রেজা শাহ পাহলভি পারসিপোলিশে সম্রাট সাইরাসের সমাধির পাশে জাঁকজমকের সঙ্গে ইরানি রাজতন্ত্রের ২৫০০ তম বার্ষিকী উদযাপন করেন। মাত্র আট বছর পর ১৯৭৯ সালে জনতা শাহের মসনদ টুকরো টুকরো করে দেয়। পারস্যের নদীগুলো দিয়ে শাহতন্ত্র আবর্জনার মতো ভেসে চলে যায় শাতিল আরবের স্রোতে। বস্তুত, জনতা ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর কোথাও কেউই কখনো টিকতে পারেনি। স্বৈরশাসকদের সামনে এই তথ্য ঐতিহাসিক সত্য ও বাস্তবতার চি‎‎হ্নস্বরূপ। তথাপি পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের কথা যতটুকু আছে, ঠিক ততোটুকুই আছে স্বৈরাচারের কথা। কিন্তু উপসংহার হিসাবে আছে গণতন্ত্রের বা জনগণের বিজয়ের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের চরম পরাজয় ও পতনের ঘটনাবলী। প্রসঙ্গত, গণতন্ত্র সব সময় স্বৈরতন্ত্রের হাতে পরাজিত হয়, এমন নয়। গণতন্ত্রী ও জনপ্রিয়রাও কখনো কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে ফেলে। জার্মানির চ্যান্সেলর হের হিটলার বিপুল জনসমর্থন ও ভোটের জোরে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক থাকতে পারেননি; হয়ে গিয়েছিলেন চরম স্বৈরাচারী, একনায়ক। গণতান্ত্রিক পরিণতির বদলে তার হয়েছিল নাৎসি-স্বৈরতান্ত্রিক পতন। শুধু হিটলার কেন, আমাদের চেনা-জানা বহু জনপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক নেতা আখেরে একদলীয়-স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, তাদের পতন ও পরিসমাপ্তি অত্যন্ত দুঃখজনক ও রক্তাক্ত পথে গিয়ে তাদেরকেই চিরতরে  নিঃশেষ করে দিয়েছিল। শুধু নেতার স্খলন-পতন নয়, নেতার অধীনস্থদের অবক্ষয়ের জন্যও গণতন্ত্র কোনও কোনও সময় আক্রান্ত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে নেতা  সৎ থাকলেই চলে না, অধীনস্থদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সেটা করা না গেলে বেপরোয়া ভক্তরা এমন কা- করে বসে, যার দায়-দায়িত্ব নেতার কাঁধেই বর্তায়। ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’ হয়ে গেলে যা হয়, অবস্থা তেমনই রূপ নেয়। অতএব, গণতন্ত্রের জন্যে বিপদ বাইরে এবং ভেতর থেকে অপেক্ষা করে। উভয়বিদ বিপদকে অতিক্রম করেই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হয়। গণতন্ত্রের এগিয়ে চলার পথে একনায়কতন্ত্রের বিন্দুমাত্র জায়গা নেই; আছে বহুত্ববাদ। সবাইকে নিয়ে চলার আরেক নামই গণতন্ত্র। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল, সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ, বিভিন্ন মতবাদ ইত্যাদি গণতন্ত্রে স্ব স্ব মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীন ও সাবলীলভাবে চলবে। এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গণতন্ত্রের প্রাণ। একের উপর অপরের দাপট, হুঙ্কার ও আক্রমণ গণতন্ত্রের জন্য প্রাণঘাতী  রক্তক্ষরণের সামিল। শেক্সাপিয়ারের নাটকের বিখ্যাত চরিত্র লেডি ম্যাকবেথ একটি স্মরণীয় উক্তি করেছিলেন: “ডযধঃ’ং ফড়হব পধহহড়ঃ নব ঁহফড়হব”. তাই বাংলাদেশের সঙ্কুল রাজনৈতিক রণাঙ্গনে যে ঘটনাগুলো ইতোমধ্যে ঘটে গেছে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত, অনাকাক্সিক্ষত হিসাবে ধরে নিয়ে এবং এসবের যথোপযুক্ত প্রতিবিধান করে আমাদেরকে চোখ রাখতে হবে গণতন্ত্রের অস্তিত্বের উপর। কারণ অগ্নিপরীক্ষায় নিপতিত গণতন্ত্রের অস্তিত্বই যদি বিপন্ন হয়, তাহলে মানুষের রাজনৈতিক আশা-ভরসার শেষ অবলম্বন বলতে আর কি বাকি থাকবে?
কেউ কেউ হতাশ হতে পারেন, কিন্তু মানব সমাজ হতাশ নয়; মানব সমাজ পরাজিতও হয় না। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির নাট্যমঞ্চে কৌশল আর বাহাদুরির আলখাল্লা চাপিয়ে যারা আগাম বিজয় ঢঙ্কা বাজাচ্ছেন, তাদেরও মনে রাখা দরকার, ব্যক্তি বা দলের নয়, জনগণের বিজয়ই আসল বিজয়। আগে বা পরে সেই গৌরবময় জয়বিজয় আসবেই। সঙ্গে আসবে গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকারের বিজয়। আইনের শাসনের ও ন্যায়বিচারের বিজয়। গণতন্ত্র ও মানুষের অনাগত বিজয়ের জন্য সংগ্রাম আর অপেক্ষা করার মহৎ দায়িত্বই এখন সবাই পালন করছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads