শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৩

বাংলাদেশ নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র


বাংলাদেশ এক ভয়াবহ সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গোটা জাতি আজ রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শুধু দেশের মানুষই নয় বিদেশীরাও চরম উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত। সর্বমহল থেকে সমঝোতার যে তাগিদ দেয়া হয়েছে তা চরমভাবে উপেক্ষিত। সরকারের একগুঁয়েমি ও স্বৈরাচারী ভূমিকার কারণে দেশে সংঘাত, সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংবিধানকে পদদলিত করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মনোবৃত্তি দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সরকার জনগণের গড়ে ওঠা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য জুলুম, নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের গোটা শাসনামলে হত্যা, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা, গুম ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে জনগণের আন্দোলন স্তব্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। সরকারের জুলুম, নির্যাতন উপেক্ষা করে জনগণ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবীতে ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে। এ আন্দোলন দমনের জন্য সরকার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেফতার চালাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদান করছে।
৮ নভেম্বর বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা ও দেশব্যাপী অব্যাহত গণগ্রেফতারের ফলে রাজনৈতিক সংকট ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ কেন্দ্রীয়, মহানগরী ও জেলা পর্যায়ের শত শত নেতা-কর্মী দীর্ঘদিন যাবৎ কারাভ্যন্তরে আটক জীবন-যাপন করছেন। আওয়ামী শাসনামলে শুধুমাত্র জামায়াতের নেতা-কর্মী গ্রেফতারের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। শিবিরের শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে। অনেকের চোখ তুলে নেয়া হয়েছে। অনেকের গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে। পুলিশি বর্বরতায় চোখ, হাত, পা হারিয়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। মহিলারাও সরকারের জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি। পর্দানশীন ছাত্রীদের ধরে নিয়ে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ৪২ বছর পূর্বের মীমাংসিত ইস্যুটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা, বায়বীয় ও কাল্পনিক অভিযোগে রাজনৈতিক মামলা দায়ের করে। তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমীর বিশ্ব বরেণ্য মুফাস্সিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী জনাব আলী-আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ-ে দন্ডিত করেছে। সাবেক আমীর, ভাষা সৈনিক, ডাকসুর সাবেক জিএস অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেছে। জামায়াতের আরো ৫ জন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সরকারের দায়ের করা যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা মামলার শুনানী চলছে। জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা মামলার রায় ঘোষিত হবে যে কোন দিন।
জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার সব ধরণের অপকৌশল গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রায় ২৬ মাস যাবৎ জামায়াতের কেন্দ্রীয়, মহানগরী ও জেলা কার্যালয়সমূহ বন্ধ করে দিয়েছে এ সরকার। জামায়াত ও ছাত্রশিবির মিছিল, সমাবেশের আয়োজন করলেই পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস এমনকি গুলী চালিয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশ, মিছিল ও সংগঠন করা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সরকার সে অধিকারকে পদদলিত করেছে।
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়ে জামায়াতকে নিবন্ধন প্রদান করে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন প্রদান ও বাতিলের মূল কর্তৃপক্ষ। সরকার তা উপেক্ষা করে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের জন্য ২০০৯ সালে তরিকত ফেডারেশন কর্তৃক দায়েরকৃত একটি রীট মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। মহামান্য হাইকোর্টে মামলার শুনানীকালে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবী জামায়াতের নিবন্ধন প্রদান বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে কোর্টে উপস্থাপন করেন। তিনি নির্বাচন কমিশনে আবেদন না করে আদালতে আসাটাকে সংবিধান সম্মত নয় বলে উল্লেখ করেন। নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী রীট পিটিশনটিকে অপরিপক্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু সেসব বিবেচনায় না নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ বিভক্তি রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করে। সেই সাথে হাইকোর্ট সার্টিফিকেট প্রদান করে। অতএব রীট মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে নিষ্পত্তি হবে। সুপ্রীম কোর্টে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পূর্বেই মাননীয় নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য ‘জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা’ মর্মে ঘোষণা দিয়ে জামায়াতকে নির্বাচনের বাইরে রাখার সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। সরকারের উদ্দেশ্যই হলো একতরফা নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় আসা। এ উদ্দেশ্যে কৌশলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ রূদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করেছে। একই কায়দায় এখন বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
আওয়ামী সরকারের চলমান কার্যক্রমে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে বিরোধী দল নির্বাচনে আসুক তা তারা চায় না। তারা চায় একদলীয় নির্বাচন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলছেন তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। তার বক্তব্য ও আচরণে ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহি:প্রকাশ ঘটছে। কোন ফ্যাসিবাদী নেতা বা দল জনগণের উপর জুলুম, নির্যাতন চালিয়ে কখনো ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগ অতি পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাই জনগণের মনের ভাষা বেশী বুঝার কথা আওয়ামী লীগের। বর্তমান আওয়ামী সরকারের ভূমিকায় প্রমাণিত হয়েছে আওয়ামী লীগ জনগণের মনের ভাষা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে অথবা জনগণের মতামতকে অবজ্ঞা করছে।
রাষ্ট্রক্ষমতার নিকট জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে শান্তি, নিরাপত্তা, স্বস্তি। জনগণ ক্ষমতার নিয়ামক। কিন্তু তারা ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করতে চায় না। নিজ সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনায় প্রতিটি নাগরিক প্রত্যাশী। যখন জন নিরাপত্তা বিঘিœত হয়, শান্তি বিনষ্ট হয়, জনগণের প্রত্যাশার বিপরীত কোন ভূমিকায় কোন সরকার অবতীর্ণ হয় তখন জনগণ সে সরকার থেকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আওয়ামী লীগের মত একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দলের নিকট জনগণ চেয়েছিল সামান্য স্বস্তি। কিন্তু ক্ষমতার মোহ আওয়ামী লীগ ও জনগণের মাঝে এক স্থির দেয়াল তৈরী করে ফেলেছে। ফলে আওয়ামী লীগ জনপ্রত্যাখ্যাত দলে পরিণত হয়েছে।
দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী একটি দল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে এখন জনগণের সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সরকার তার পৌনে ৫ বছরের শাসনকালে জনগণের কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। জনদুর্ভোগ লাঘব তো দূরের কথা বরং জনগণের দুর্দশা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি হয়েছে। মন্ত্রী-এমপি, দলীয় নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি জনগণকে হতাশ করেছে। বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে আওয়ামী দুঃশাসনের প্রভাব পড়ে নি। কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শিক্ষক এক কথায় সর্বস্তরের মানুষ নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র চালাতে হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বর্তমান মহাজোট সরকারের ঋণের পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ঋণ নিয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন গত প্রায় ৫ বছরে সরকার বিভিন্ন তফসিল ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ২ লাখ ৩২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারের ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৮৭ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নতি-অগ্রগতি-সমৃদ্ধি মুখ ধুবড়ে পড়েছে। সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বন্ধ প্রায়। শেয়ার বাজার-ডেসটিনি-হলমার্ক-পদ্মাসেতু কেলেঙ্কারি, মন্ত্রী-এমপিদের সীমাহীন দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত।
॥ দুই ॥
বাংলাদেশের মানুষ আবহমান কাল থেকে ধর্মপ্রাণ। ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে অভ্যস্ত না হলেও তারা ধর্মের অবমাননা বরদাশত করতে রাজী নয়। আল্লাহ, নবী-রাসুল (সাঃ), কোরআন, নামাজ, রোজা সম্পর্কে কটাক্ষকারী কোন ব্যক্তিকেই জনগণ ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। এ মহাসত্য উপলব্ধি করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য বিচারের নামে ইসলামী নেতৃত্বকে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখা, মিথ্যা কল্পকাহিনী রচনা করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির রায় ঘোষণা ও তাদের চরিত্র হননের বায়বীয় অভিযোগ জনগণ ঠিকই বুঝতে পেরেছে। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে কখনো ঢেকে রাখা যায় না। সত্যের প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী। জুলুম, অত্যাচার করে কোন জালেম কখনো পার পায়নি। আওয়ামী লীগ এ সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। পথের কাঁটা দূর করতে গিয়ে যেভাবে আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার অভিযান চালিয়েছে তা তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে।
দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ মানুষগণ শাহবাগী নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নেমেছিল। ৫ মে শাপলা চত্বরে তারা সমাবেশে মিলিত হয়েছিল। তারা কোন রাজনৈতিক এ্যাজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামেনি। তারা বারবার বলেছে কোন দলকে তারা ক্ষমতায় বসানোর জন্য বা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য মাঠে নামেনি। তাদের আন্দোলন ইসলাম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে। মুষ্টিমেয় কিছু ধর্মদ্রোহী নাস্তিক, মুরতাদদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে সরকার চিহ্নিত হয়েছে ইসলাম বিরোধী হিসেবে। এটা আওয়ামী রাজনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তারা ভেবেছিল শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে আলেম ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের উঠিয়ে দিলেই আওয়ামী লীগের গদি নিরাপদ হবে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আলেমদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরাগভাজনে পরিণত হন।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনাও জনগণ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। জামায়াতের রাজনীতি, ৭১ সালে জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে কিছু লোকের আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু জোর করে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করার আওয়ামী অপকৌশল জনগণ গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ এ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলে। কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য নয় সাঈদীর ফাঁসির আদেশের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের উপর পুলিশ, র‌্যাব ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা যেভাবে সশস্ত্র হামলা করে গণহত্যা চালিয়েছে তাতে দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। রক্তের বন্যায় রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। যেসব লোক জীবন দিয়েছে তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, আপনজন এলাকাবাসী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এসবের ফল আওয়ামী লীগ পেতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, মন্ত্রী, এমপিগণ যেসব মিথ্যাচার করে নিজের সাফাই গাচ্ছেন তা জনগণ বিশ্বাস করে না। মিডিয়ায় অপপ্রচার ও সরকার বিরোধী মিডিয়া বন্ধ করে আওয়ামী লীগ জনগণের আরও রোষানলে পড়েছে। অনেক মানুষ টেলিভিশন দেখা বন্ধ করে দিয়েছে। একতরফা খবর শুনতে শুনতে জনগণ আজ বিরক্ত। যারা ভেবেছিলেন রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করে তাদের অপকর্ম ঢেকে রাখবেন জনগণের বিবেকের কাছে তাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। ১৬ কোটি মানুষের সামষ্টিক মতের প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনে। কিছুদিন পূর্বে ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। নির্বাচনে তারা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অনিয়ম, জালভোট, ব্যালট বক্স ছিনতাই, ফল প্রকাশের গোজামিল সত্ত্বেও ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীগণ বিজয়ী হয়েছেন। হেরে গিয়ে সরকার সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য গৌরব বোধ করেছেন। এটাই আওয়ামী রাজনীতি।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে জনমতের এ প্রতিফলন ঘটবে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেসব জনমত জরিপের ফলাফল পাওয়া গেছে তাতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ধস পরিলক্ষিত হয়েছে। ২ নভেম্বর ডেইলি স্টার ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, যদি এই মুহূর্তে নির্বাচন হয় তবে আওয়ামী লীগ পাবে ২৮ শতাংশ ভোট ও বিএনপি পাবে ৫৫ শতাংশ ভোট। এ জনমত জরিপ অনুযায়ী একথা স্পষ্ট যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ১৮ দলীয় জোট কমপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয় লাভ করবে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী দেখা গেছে, শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ জনগণের আকাঙ্খা পূরণ করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনআকাঙ্খা পুরণের পরিবর্তে নিবর্তনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অপরিণামদর্শী ও স্বার্থবাদী রাজনীতির কারণে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ হুমকীর সম্মুখীন। আওয়ামী লীগ কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক পথে যাত্রা শুরু করেছে তা জনগণের মাঝে এখন সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক মোড়লদের পদচারণা আজ দৃশ্যমান। বিভিন্ন দেশ তাদের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। কোন খবরই এখন আর গোপন নেই। সম্প্রতি আসামের একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে দিল্লি খরচ করবে এক হাজার কোটি ভারতীয় রুপী। এই অর্থ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পেছনে খরচ করা হবে। খবর অনুযায়ী এ ব্যয়ের প্রস্তাব পাস করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর দিয়েছে আসাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ। গত নির্বাচনে ভারত সরকার খরচ করে ৮০০ কোটি রুপী। এ রিপোর্টে আরো বলা হয় বাংলাদেশের পুরো পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইন্দিরা গান্ধী সৃষ্ট ‘র’ এর মাধ্যমে প্রতিটি নির্বাচনে দিল্লি সমর্থিত দলের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। এখনো তা অব্যাহত আছে।
১ নভেম্বর হিন্দুস্থান টাইমস্-এ প্রকাশিত সুবীর ভৌমিকের লেখায় ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় যে, ভারত সরকার যেন বাংলাদেশের উপর সামরিক হস্তক্ষেপ করে, যাতে শেখ হাসিনার সরকারকে আগামীতে ক্ষমতায় রাখা যায় এবং বিএনপি ও এর মৌলবাদী জোট ক্ষমতায় না আসতে পারে। হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকাটি নয়াদিল্লির মতামত তৈরীর অনুঘটক। এ ধরনের লেখা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের আকাঙ্খার প্রতি নির্মম আঘাত। বাংলাদেশকে নিয়ে স্বাধীনতার ৪২ বছর পর নতুন করে যে খেলা শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায়? কোন গণতন্ত্রকামী ও দেশপ্রেমিক জনগণ দেশ নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র মেনে নিতে পারে না।
আওয়ামী লীগ দেশপ্রেমিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে প্রথমে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বিচারের নামে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। তাদের এ পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার সর্বশেষ শিকার বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাসভবনে ও কার্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন, পানির লাইন বন্ধ করে দেয়া, তার বাসভবনে কাউকে প্রবেশে বাধাদান, যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে কার্যত তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনে রাখা উচিৎ বেগম খালেদা জিয়া এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। দেশের ভাগ্যাহত, বঞ্চিত মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার উপর কোন আঘাত বা ষড়যন্ত্র জনগণ বরদাশত করবে না। আওয়ামী লীগ বেপরোয়াভাবে বিরোধী দলের উপর মরণ আঘাত হানছে। তারা ভাবছে রাষ্ট্রের পুলিশকে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করে তারা পার পেয়ে যাবে। এটা তাদের ভুল ধারণা। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। দেশের প্রতিটি মানুষ আওয়ামী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ। জনতার বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে সকল ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাবে।
 নির্বাচনের প্রাক্কালে গণগ্রেফতার, গণনির্যাতন ও অব্যাহত নিপীড়ন সমঝোতার পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এসবের জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ একদলীয় নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একদলীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণ কিছুতেই হতে দেবে না। ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে বসে থাকবে না। তারা নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। ১৮ দলীয় জোটের সকল কর্মী, হেফাজতে ইসলাম, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ মাঠে নামলে কোনভাবেই নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় ভোট গ্রহণ করতে গেলে জনরোষের শিকার হতে হবে। সুতরাং একদলীয় নির্বাচন মানেই দেশকে চূড়ান্ত সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া। কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে না।
নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই সমঝোতায় আসতে হবে। কেবল সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে। শান্তির পথ পরিহার করে আওয়ামী লীগ দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
দেশের বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনবিদ, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ চায় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন। অতীতে একাধিকবার একদলীয় নির্বাচন হয়েছে কিন্তু এর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। চলমান প্রেক্ষাপটে একদলীয় নির্বাচন দেশকে দীর্ঘমেয়াদী নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে লাভবান হবার স্বপ্নে বিভোর হলেও এ পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
দেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগের দেশবিরোধী ভূমিকা জনগণের নিকট স্পষ্ট। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নি¤œ আদালত সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন পেশাদারিত্বের পরিবর্তে দলীয় ক্যাডার বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রশাসনকে আওয়ামীকরণ করা হয়েছে অনেক পূর্বেই। আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই সংবিধান লংঘন করে আসছে। এখনো সংবিধান অবজ্ঞা করে চলছে। ১১ নভেম্বর মন্ত্রীসভার সদস্যগণ পদত্যাগ করার মাধ্যমে সংবিধানের ৫৮(১)(ক) ধারা অনুযায়ী তারা আর মন্ত্রী নন। কিন্তু এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ সংবিধান মানছে না। পদত্যাগ করার পর মন্ত্রীগণ আর কোন দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু তারা সচিবালয়ে গিয়ে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন, যা বে-আইনী ও অসাংবিধানিক। সরকার সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।  মানুষের আশ্রয় নেয়ার স্থান বলতে আজ আর কিছু নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে অবস্থা হয় জনগণের সে অবস্থা হয়েছে।
স্বাধীন দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে না, সভা-সমাবেশ করতে পারে না, নিজের মতামত তুলে ধরতে পারে না এমন পরিস্থিতি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সরকার মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়ে কার্যত: দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য জনগণের মাঝে ঐক্য প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন জাতিকে গড়ে তুলতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই। তিনি ৭১ এ ভিন্ন মতাবলম্বনকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তার কন্যা শেখ হাসিনা সেই ইস্যুতে বিচারের নামে পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক ইস্যু রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করে আদালতে টেনে নিয়ে আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচার দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত। এ বিচার সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। মূলত আওয়ামী লীগ দেশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করে তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার যে ষড়যন্ত্র করছে এ বিচার সে প্রক্রিয়ারই অংশ।
আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বাংলাদেশের জনগণ কোন ধরণের ষড়যন্ত্র বরদাশত করবে না। দেশের ১৬ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোন ধরণের চক্রান্ত প্রতিহত করবে। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠনমূলক রাজনীতিতে অবতীর্ণ হলেই তাদের ও দেশের জন্য মঙ্গল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads