মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

এরশাদের উচিত ছিল জনগণের সাথে থাকা


জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং আমাদের সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যেন হঠাৎ মস্তবড় ভুল করে ফেলেছেন। বৃদ্ধ বয়সে অনেকেরই ভুল হয়, তবে তিনি যে ভুল করেছেন সেটা অতি শিগগির বুঝতে পারবেন। তিনি সরকারে যোগ দিলেন এবার পুরো দল নিয়ে। আগে পাঁচ বছর ধরে এই সরকারের একটি ছোট অংশীদার ছিলেন মাত্র। সেই অংশীদারিত্বের কারণে তার ভাবমর্যাদা অতটা খর্ব হয়নি। কিন্তু ভাবমর্র্যাদা সম্পূর্ণভাবে উবে গেছে জাতি যখন একটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন চাচ্ছে; প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য যখন অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং নির্বাচনকালীন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে শক্তভাবে জনমত গঠিত হয়েছে, তখন হঠাৎ করে এরশাদ সাহেব ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য একটা বড় খুঁটি হতে দৌড় দিলেন। তার এই দৌড় কি জনগণকে ত্যাগ করা নয়? জনগণের ভাবনা হলো এক দিকে, আর সাবেক জেনারেল এরশাদ গেলেন আর এক দিকে। এর থেকে বড় রাজনৈতিক ভুল আর কী হতে পারে? জনগণের বেশি সমর্থন, বা কম সমর্থন দিয়ে একজন রাজনীতিকের বিচার করা হয় না; বিচার করা হয় নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে ওই রাজনীতিবিদ কতটা দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছেন তার দ্বারা। 
বর্তমান যুগের স্বার্থপরতার রাজনীতির কাছে অনেক কথিত রাজনীতিবিদ শুধু কিছু পাওয়ার জন্য সদা ঘুর ঘুর করছেন। যারা ওই স্বার্থপরতার টান আর লোভ থেকে দূরে থেকে জনগণের ভাবনা আর আশার পক্ষে দাঁড়াতে পেরেছেন, তাদের জন্যই জনগণ দোয়া করে। অন্যদের জনতা নীরবে হলেও শুধুই অভিশাপ দেয়। মন্ত্রী হলে একটা বড় প্লাটফরম পাওয়া যায় নিজেকে জাহির করার জন্য। এর মাধ্যমে অনেকে জনগণের প্রশংসা নয়, নিন্দা অর্জন করেন। এরশাদ সাহেবের ব্যক্তিগত লাভালাভ বলতে কিছু ছিল না। দেশের মানুষ মনে করে, সরকারের পক্ষে দলে-বলে অবস্থান নিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও লাভবান হননি। তা হলে তার এই ১৮০ ডিগ্রির অবস্থানের পরিবর্তন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমার মতো অনেকেরই জানা নেই। এই পরিবর্তন তো এমন নয় যে, দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে এসেছে। তিনি সরকারে গেলে যদি গণতন্ত্র রক্ষা পায়, তা হলে আজ যারা বিরোধী দলে আছেন এবং যাদের পক্ষে অধিকাংশ মানুষ, তারা কি গণতন্ত্রকে বিপন্ন অবস্থানে ফেলে দিচ্ছেন? গণতন্ত্র রক্ষা ও মজবুত করার ক্ষেত্রে সরকারের কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই? 
গণতন্ত্র বিপন্নের জন্য শুধু বিরোধী দলকে দোষারোপ করা মানে জনগণের ভাবনার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া। জাতীয় পার্টির ছয়জন শীর্ষনেতা সরকারের মন্ত্রী হলেন। কিন্তু এ মন্ত্রিত্বের পক্ষে যুক্তিগুলো কী কী তা আজো জনগণ জানতে সক্ষম হলো না। নাকি আজকের গোলমেলে রাজনীতিতে এরশাদের দলের ওই ছয়জন নেতা নিজেদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধার কিছু অংশীদারিত্ব চাইলেন। অনেকে মনে করেন, এরশাদকে দলের কিছু লোক ভুল বুঝিয়েছেন। তাদের এ ধারণা থাকতে পারে যে, নির্বাচনটাই হয়তো অনেক পিছিয়ে যাবে। সুতরাং সরকারে এ দলের মন্ত্রীরা যাচ্ছেন শুধু তিন মাসের জন্যÑ এই ধারণা ঠিক না-ও হতে পারে। মন্ত্রী তো ছয়টা পেলেন। কিন্তু এখন তো সরকারের কলঙ্ক বা কাদারও অংশীদার হতে হবে। 
এখন তো এরশাদ জোর গলায় বলতে পারবেন না যে, সরকার এই খারাপটা করেছে, ওই খারাপটা করেছে। এমন ক্ষেত্রে, এমনকি পূর্বের সব ব্যর্থতা ও অন্যায়ের জন্য এরশাদের দলও আনুপাতিক হারে অংশীদার হবে। আমাদের বর্তমান জতীয় সঙ্কটের পেছনে কারণ কী? বিরোধী দলের অবস্থান হলো, সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে সংবিধানকে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। জনাব এরশাদ, আপনার এই ক্ষেত্রে মত কী? এ মতের প্রতি আপনার সমর্থন যদি না থাকে তাহলে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আর কী বিকল্প হতে পারে? আপনি কি মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশের মতো একটা দেশে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে? 
বিকল্প ব্যবস্থার পক্ষে সুশীলসমাজের অনেকেই প্রস্তাব দিচ্ছেন। ওই সব প্রস্তাব কি বর্তমান সরকারের কাছে কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে? আপনি গত এক বছর এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যেগুলো মানুষের মনের কথার মতো। কিন্তু এখন কি আর ওই ধরনের বক্তব্য দিতে পারবেন? পারলেও আপনার বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে থাকবে না। কিসের মোহে বা কী কারণে আপনার হঠাৎ পুরোপুরি অবস্থান পরিবর্তন তা মোটেও বোধগম্য নয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কিছু বৃদ্ধ নেতাÑ যার মধ্যে আছেন এম কে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সেই সাথে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, আবদুল আউয়াল মিন্টুকে জেলে নিয়ে গেল। এই ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান তো আপনি স্পষ্ট করলেন না জনগণের কাছে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশের ক্রান্তিকালে আর কখনো কি এত রাজনৈতিক নেতা এক সাথে জেলে ছিলেন? আপনি সরকারে যেতে পারতেন, তবে দুটো ক্ষেত্রে দরকষাকষি করে সরকারে গেলে জনগণ আপনাকে সমর্থন দিত। সেই দুটো বিষয় হলো, আপনার দল সরকারের অংশ হবে যদি সর্বপ্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সরকারে আসতে সম্মত করানো যায়। অন্য শর্ত দেয়া উচিত ছিল, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার মওদুদসহ নেতাদের মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু আপনি সরকারে চলে গেলেন, যেন রাতে স্বপ্ন দেখলেন, সকালে স্বপ্ন অনুযায়ী কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। 
এখন বাস্তব অবস্থা হলো আকাস্মিকভাবে আপনার ভোটারেরা দলে দলে বিএনপিতে নাম লেখাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। আগের সেই উৎসাহী জনসমর্থন আপনি পাবেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো কয়েক মাস আগে ঠিকই বলেছিলেন, বিএনপি ভোটে এলে আপনার দল জোটে থাকবে, আর না এলে আপনি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবেন। তবুও সৈয়দ আশরাফকে একহাত দেখে নিতে গেলেন কেন? এখন তো সব মানুষই সেই একই কথা বলছে। যা হোক, আপনার অনেক বয়স হয়েছে। আপনি হতে পারতেন হক কথার মানুষ। এতে কে কী মনে করল, তাতে আপনার কিছু আসত যেত না। আর এখন অবস্থা হলো এই যে, আপনি জনগণের সামনে কথা বলতে পারবেন না। বলতে চাইলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads