বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৩

সময়ের দাবি সকল অভিযোগ থেকে তারেক রহমানের মুক্তি


গতকালের পর- ৪ দফায় ১১ দিন রিমান্ড শেষে আবারো রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানিয়ে পুলিশ তারেক রহমানকে ৯ জানুয়ারি ২০০৮ ঢাকার ১নং অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম এহসানুল হকের আদালতে হাজির করে। মেসার্স রেজা কনস্ট্রাকশন লিঃ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান আফতাবউদ্দিন আহমদ ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনসহ ৭ জনকে আসামী করে ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার এজাহারে তারেকের নাম নেই। পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে প্রধান আসামী মামুন জিজ্ঞাসাবাদে চাঁদাবাজির টাকার কিছু অংশ তারেকের এপিএস অপুকে দিয়েছে বলে আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন। অপু টাকা নিয়ে তারেককে দিয়েছেন কিনা তা জানার জন্য তারেককে রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
এ মামলায় রিমান্ডে নেয়ার আগে তারেক সরকারের হেফাজতে থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর আগ পর্যন্ত আদালতে তিনি কোনো কথা বলেননি। ওইদিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের অনুমতি নিয়ে তিনি তার ওপর অমানবিক নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরে বক্তব্য দেন। তিনি আদালতের কাছে তার জীবন ভিক্ষা চেয়ে বলেন, ‘আবার রিমান্ডে নিলে আমি আর বাঁচব না। আমি রিমান্ডে শারীরিকভাবে এতটাই নির্যাতনের শিকার হয়েছি যে, এখন মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না।’ আদালতে তারেক বলেন, ২৪ ঘণ্টা মোটা কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। সরকারের নিষ্ঠুর নির্যাতনের হাত থেকে একমাত্র আদালতই আমার জীবন বাঁচাতে পারে। কেননা আদালতই হচ্ছে মানুষের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। একটি মানুষ বেঁচে থাকলেই শুধু তার বিচার সম্ভব। তিনি আদালতের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, নির্যাতন করে তিলে তিলে আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলে আদালত কার বিচার করবেন? সেদিনের বক্তব্যে শুধু আইনজীবীরাই নন, গোটা আদালতে উপস্থিত সকলে বিচলিত হয়ে পড়েন। তারেকের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তারেকের ওপর অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। তার মেরুদ- ভেঙে দেয়া হয়েছে। চোখ বেঁধে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছে। শুনানির পর আদালত পুলিশের আবেদন গ্রহণ করে ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তবে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়।
বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির হত্যা মামলা ধামাচাপা দিতে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এনে রমনা থানায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় তারেককে সহযোগী আসামী করা হয়।
১৮ জানুয়ারি ২০০৮ তারেক রহমানের নানী তৈয়বা মজুমদার ইন্তকাল করেন। নানীকে শেষবারের মতো দেখার জন্য তারেককে পরদিন দুপুর ১২টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। শাহবাগ থানায় নিয়ে ৪ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে বিকাল ৪টায় ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসায় নানীর মৃতদেহের কাছে তাকে নেয়া হয়। নিজের ভগ্ন শরীর নিয়ে প্রিয় নানীকে দেখে সেদিন তারেক রহমান অনেক কাঁদলেন। কাঁদালেন উপস্থিত সবাইকে। ওইদিন জিয়া পরিবারের কারাবন্দি অপর দুই সদস্য খালেদা জিয়া ও কোকোকেও প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু সরকার তাদের কাউকেই পরস্পরের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি।
সরকারের হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন এবং সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় তারেকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ৩১ জানুয়ারি তাকে পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে এম্বুলেন্সে করে বিশেষ আদালতে তাকে নেয়া হয়। আদালতে হুইল চেয়ারে তিন মিনিট বসিয়ে রাখার পর তার মেরুদ-ের ব্যথা শুরু হয়। তার সঙ্গে থাকা পিজি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সুপারিশে তাকে আবারো এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনা হয়। আদালতে চিকিৎসকের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তারেকের স্পেশালাইজড অর্থোপেডিক ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। তার মেরুদ-ের কয়েকটি হাড় ভেঙে গেছে। কয়েকটি হাড় বেঁকে গেছে। ফলে তাকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। পরবর্তীতে তারেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে পর্যায়ক্রমে তিনটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। প্রতিটি বোর্ডই দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে অর্থোপেডিক, ফিজিওথেরাপি, কার্ডিওলজি ও রেডিওগ্রাফির সুবিধা সম্বলিত যে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেয়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিএসএমএমইউ হাসপাতাল তারেক রহমানকে ৩১ জানুয়ারি ২০০৮ ভর্তি করা হয়।
গ্রেফতারের পর দিনকাল প্রকাশনা লিমিটেডের নিয়মিত বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল না করায় রেজিস্ট্রার ও জয়েন্ট স্টক কোম্পানির পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এতে তারেক ছাড়াও খালেদা জিয়া, বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুস সালাম তালুকদার, সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীসহ কোম্পানির ১৩ পরিচালককে আসামী করা হয়। এই মামলাটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। ২২ মার্চ ২০০৮ হাইকোর্ট বিভাগ মামলাটি খারিজ করে দিনকাল প্রকাশনা লিমিটেডের পক্ষ থেকে ৬ লাখ টাকা অনুদানের নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে ৫ লাখ টাকা প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে এবং বাকি ১ লাখ টাকা সুপ্রিম কোর্ট কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে দিতে বলা হয়।
সংসদ ভবনের বিশেষ আদালত-৩ এর বিচারক শাহেদ নুরুদ্দিনের আদালতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির হত্যা ধামাচাপা দেয়া মামলার শুনানিকালে তারেক কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেরুদ-ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় তাকে হুইল চেয়ারেও বসিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। এ মামলায় তারেকের ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতির প্রার্থনা জানিয়ে ২৫ জুন ২০০৮ আইনজীবীরা আদালতে আবেদন করেন। আবেদনে তারা বলেন, অত্র আদালত ইতঃপূর্বে শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার জন্য চলমান মামলায় ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। মোট ৫টি মামলায় শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। তারেক এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মেডিকেল বোর্ড তাঁকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০/এ ধারায় আদালতের এ এখতিয়ার রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এ আবেদনের ব্যাপারে বিরোধিতা করায় শেষ পর্যন্ত ৬ জুলাই ২০০৮ এ বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেন। আদালত তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ব্যক্তিগত হাজির থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। শেখ হাসিনাকে বিদেশে পাঠাতে রাতের আঁধারে আদালত বসিয়ে টেলিফোনে বিচারককে বাসা থেকে ডেকে সরকারি আইনজীবীরা তার অব্যাহতির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তারেক রহমানের বিষয়ে সরকারি আইনজীবীদের ভূমিকায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তার আইনজীবীরা। ৬ জুলাই ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে তাকে অব্যাহতি দিলেও তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়নি। শেষ পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভের মাধ্যমে মুক্ত হন তারেক।
কারাবন্দী তারেক তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো ঘুষ গ্রহণ মামলা থেকে নিজেকে অব্যাহতি এবং জামিন চেয়ে ২ জুন ২০০৮ হাইকোর্টে রিট আবেদনটি দায়ের করেন। ৭ আগস্ট ২০০৮ বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি মোঃ ইমদাদুল হক আজাদ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ একই বিষয়ে একাধিক মামলা চলতে পারে কি-না তা হাইকোর্ট স্পষ্ট নয় বলে আদালত তারেকের ৫৬১ ধারায় দায়ের করা অব্যাহতি আবেদন সরাসরি আপিল করার সুযোগ দিতে সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সার্টিফিকেট দেয়ার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে আদালত অভিমত প্রকাশ করেন, ‘সাধারণত, হাইকোর্ট সার্টিফিকেট ইস্যু করলে আবেদনকারী এর প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ চাইতে পারেন। আদালত একই সঙ্গে নি¤œ আদালতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম ১২ আগস্ট ২০০৮ পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করেন। এর আগে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর আদালত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলিকে তারেকের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি উপস্থাপন করতে বলেন। ৪ আগস্ট আদালত এ নথি তলব করেছিলেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার পক্ষ তারেকের মেডিকেল রিপোর্ট উপস্থাপন না করায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরে তারেকের আইনজীবীরা তার মেডিকেল রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করেন। এ পর্যায়ে আদালত শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল, মোহাম্মদ নাসিম ও মানবাধিকার নেত্রী সিগমা হুদার জামিন লাভের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী কাউকে চিকিৎসার জন্য সাময়িক মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। কেউ জামিন পাচ্ছেন। মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী তারেক গুরুতর অসুস্থ। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকেও বিদেশে পাঠাবার সুপারিশ করা হয়েছে। কাজেই জীবন রক্ষার্থেই তারেককে অন্যদের মতো সাময়িক মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হলো। এ সময় আদালত বলেন, ‘সরকার এ পরামর্শ মানবে কিনা জানি না। তবে সভ্য সমাজে হাইকোর্টের পরামর্শকে আদেশ হিসেবে গণ্য করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’
২৭ আগস্ট ২০০৮ সাব্বির হত্যা মামলা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আপিল বিভাগ তারেককে জামিন মঞ্জুর করেন। এ জামিনের পর তারেকের মুক্তি পাওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে ২৮ আগস্ট তারেককে হাইকোর্ট বিভাগের মঞ্জুর করা ৬টি জামিনের বিরুদ্ধে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন আপিল করে। তাদের আপিলে হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া জামিন আদেশ স্থগিত করার আবেদন জানানো হয়। ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের অবকাশকালীন চেম্বার জজের আদালতে সরকার ও দুদকের আপিল একসঙ্গে শুনানি করা হয়। শুনানি শেষে আপিল বিভাগের চেম্বার জজের আদালত সরকার ও দুদকের আবেদন খারিজ করে দেন। এই খারিজ আদেশের পর তারেকের জামিনে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সকাল সাড়ে ১১টায় এ আদেশের পর মুক্তি পেতে প্রতীক্ষা করতে হয় ৩ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত।
বন্দি থাকা অবস্থায়ও তারেক সরকারের বিমাতাসুলভ আচারণের শিকারে পরিণত হন। ৫টি মেডিকেল বোর্ড উন্নত চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা, আব্দুল জলিল ও মোহাম্মদ নাসিমের মতো তারেকেও বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দেশবাসীর দাবি উপেক্ষা করে সরকার তারেককের চিকিৎসার বিষয়ে নীরব থাকে। তারেকের ওপর সরকারের নিষ্ঠুর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। চারদলীয় জোট তারেকের জীবন রক্ষার্থে তাকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিদেশ পাঠানোর দাবি করে আসতে থাকে। একই সঙ্গে আইনজীবীরা তারেকের মুক্তি নিশ্চিত করতে আদালতে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। অবশেষে আইনি লড়াইয়ে জয়লাভের মাধ্যমেই মুক্তি পান তারেক।
দীর্ঘ আইনী লড়াই শেষেও দু’দিন প্রতীক্ষার পর অবশেষে মুক্তি পান তারেক। নানা অনিশ্চয়তা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ বিকাল ৪টা ৩৫ মিনিটে তিনি মুক্তি পান। বেলা সোয়া ৩টা পর্যন্ত দৈনিক দিনকাল সংক্রান্ত মামলার বিষয়টি নিয়ে মুক্তি পাওয়া অনিশ্চয়তার ধূম্রজালে আটকে ছিল। এ নিয়ে তারেকের আইনজীবী ও কারা কর্তৃপক্ষের মধ্যে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা আইনগত ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা হয়। কারা অধিদফতরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারেকের পক্ষে তার আইনজীবী এডভোকেট শিমুল বিশ্বাস, ব্যারিস্টার নওশাদ জামির, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে ডিআইজি প্রিজন, জেল সুপার, সিনিয়র জেল সুপার ও কারা কর্তৃপক্ষের একজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে দিনকাল প্রকাশনা লিমিটেডের মামলায় তারেকের জেল ওয়ারেন্ট দেখানো হয়েছিল। অপরদিকে দিনকাল প্রকাশনা লিমিটেড বিলুপ্ত ঘোষণা করে হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া রায়ের ফলে মামলাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ মামলায় জামিনের বিষয়ে কোনো আদেশ না থাকায় বিভ্রান্তিতে পড়েছিল কারা কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন উত্থাপন করলে তারেকের মুক্তি পাওয়া নিয়ে সাময়িক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ সময় চার আইনজীবী ছুটে যান কারা অধিদফতরে। সেখানে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত একটানা বৈঠক হয়। বৈঠকে আইনগত ব্যাখ্যা পেশ করেন তারেকের আইনজীবীরা। তারা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হাইকোর্ট বিভাগের মামলাটি নিষ্পত্তির আদেশ পেশ করেন এবং ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। এ সময় হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী দিনকাল প্রকাশনার পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে এবং ১ লাখ টাকা সুপ্রিম কোর্ট কর্মচারী কল্যাণ ট্রাষ্টে জমা দেয়ার কাগজপত্র পেশ করা হয়।
 দীর্ঘদিনেও বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন হয়নি। এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে ছিলেন কারা কর্মকর্তারা। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর তারেকের মুক্তি দেয়া হয়। ডিআইজি প্রিজন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী ও সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম হাসপাতালে এসে তার মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। প্রত্যাহার করে নেয়া হয় জেল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা কর্মীদের। ডিআইজি প্রিজন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বিকালে তারেকের মুক্তি নিশ্চিত করে পিজি হাসপাতালের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, দিনকাল প্রকাশনা লিঃ মামলা নিয়ে সন্দেহ দূর করার পর তারেকের মুক্তি দেয়া হয়েছে।
তারেক রহমান মুক্ত-এ ঘোষণা দেয়ার পর ডিআইজি প্রিজন মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকীকে আবেগে মাল্যভূষিত করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ডি ব্লকের ইউনিভার্সিটি কার্ডিয়াক সেন্টারের চারতলায় অবস্থানরত তারেকের কক্ষ থেকে কারাবন্দী প্রত্যাহার করে নিচে আসার পর এ ঘটনা ঘটে। এ সময় তিনি তারেক রহমানকে উদ্ধৃত করে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি আপনাদের তার জন্য দোয়া করতে বলেছেন। মিছিল-মিটিং না করার জন্য বলেছেন।
মুক্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে তারেকের আইনজীবীদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। চিকিৎসাধীন তারেক মুক্তি পর্যন্ত পিজি হাসপাতালের ডি ব্লকের একটি কেবিনে ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পরও তারেক হাসপাতালেই ছিলেন।
তারেক মুুক্তি পাবেন-এ খবরে সকাল থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পিজি হাসপাতালের সামনে এসে ভিড় করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পিজি হাসপাতাল চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। তারা তারেক ও খালেদা জিয়ার পক্ষে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। বিকালে তারেকের মুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পর নেতাকর্মীরাও মোনাজাত করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। মুক্তির পর বিকালে বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হান্নান শাহ ও যুগ্ম মহাসচিব গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপির দফতর সম্পাদক রিজভী আহমদসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা তারেকের সঙ্গে হাসপাতালে কেবিনে দেখা করেন। তারা তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। বাইরে এসে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তারেক রহমান অসুস্থ। দেখা করেছি। তিনি আমাদের সালাম দিয়েছেন। দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ও দোয়া করতে বলেছেন। দেশবাসীকে তিনি তার মা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
 তারেকের মুক্তির পর তার আইনজীবীরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে বলেন, আইনের শাসনের বিজয় হয়েছে। আইন নিজস্ব গতিতে চললে খালেদা জিয়াও আল্লাহর রহমতে আইনি লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে বের হয়ে আসবেন। মুক্তি নিশ্চিত হওয়ার পর তারেক হাসপাতালের বিছানায় শোয়া অবস্থায়ই আল্লাহর দরবারে শোকরানা আদায় করেন। শোকরানা নামায শেষ করে মোবাইলে কথা বলেন স্ত্রী ডাঃ জুবাইদা রহমানের সঙ্গে। সোয়া ৫টায় ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে তারেকের স্ত্রী ডাঃ সৈয়দা জুবাইদা রহমান, তার বড় বোন সৈয়দা শাহিনা খানম ও তার স্বামী হাসপাতালে তারেকের কক্ষে প্রবেশ করেন। তারাও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং শান্তির প্রতীক একজোড়া কবুতর হাসপাতাল কেবিনের জানালা দিয়ে উড়িয়ে দেন। এ সময় ডাঃ জুবাইদা ও তারেককে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। তারেক তাদের সহযোগিতা নিয়ে বিছানায় শোয়া অবস্থা থেকে একটু উঠে হাসপাতাল কেবিনের জানালা দিয়ে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে হাত উঁচু করেন। তবে তিনি হাত নাড়াতে পারছিলেন না। শুধু হাতটি একটু উঁচু করে বের করেছিলেন। উঠে বসতে না পারায় নেতাকর্মীদের চেহারাও দেখাতে সক্ষম হননি। তারেক রহমান অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে স্ট্রেচারে গিয়ে লন্ডনের প্লেনে উঠেছিলেন ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর।
আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠেয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান বিরোধী দলÑবিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে আরও অন্তত চারটি মামলার রায় দেওয়া হতে পারে। ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে কোকোর বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলার রায়।
সবমিলিয়ে নির্বাচনের আগেই জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে সর্বমোট ছয়টি মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে। মামলাগুলোর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সোনালী ব্যাংকের দায়ের করা ঋণ খেলাপির মামলার রায় তারেক রহমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খারাপ খবর বয়ে আনতে পারে। একই ব্যাপার ঘটতে পারে কোকোর বিরুদ্ধে দায়ের করা ঋণ খেলাপি মামলার ক্ষেত্রেও। তবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলার রায় ঘোষিত হলেও তা নির্বাচনে কেমন প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার, ঠিক সেই সময়ে জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়কে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেই দেখছেন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। মামলার রায় প্রভাব ফেলতে পারে নির্বাচনে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads