রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

জনগণ জানান দিলো


গত ২৭, ২৮ ও ২৯ অক্টোবর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আহ্বানে টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। হরতালের কালচার বাংলাদেশে দীর্ঘ দিনের। কোনো রাজনৈতিক দল হরতাল ডাকে। রাস্তায় পিকেটিং করে। গাড়ি ভাঙচুর করে। টায়ার জালায়। কিছু গাড়ি ঘোড়াও চলাচল করে এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু ওই তিন দিনের টানা হরতালের চেহারা ছিল ভিন্ন।
এ সরকারের পাঁচ বছরের দুঃশাসন অপশাসনে সারা দেশের মানুষ এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যে, তারা যেন এখন ধাক্কা দিয়ে সরকারকে ফেলে দিতে চাইছে। বলতে চাইছে আর এক মুহূর্তও নয়, দূর হ দুঃশাসন। সরকার সারা দেশে এক ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা কখনোই দেখা যায়নি এবার আমরা পাঁচ বছর ধরে সে রকম দৃশ্য অবিরাম দেখছি। তা হলো সরকারের পেটোয়া পুলিশবাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে বিরোধী বক্সের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছে। তাদের সামনেই ম্যাগজিনে গুলি ভরেছে। তাদের সামনেই প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। কখনো পুলিশ হয়েছে ছাত্রলীগের সহযোগী, কখনো ছাত্রলীগ হয়েছে পুলিশের সহযোগী।
আমরা বারবার সতর্ক করেছিলাম, এ পরিস্থিতি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। এই অস্ত্র এক দিন দলাদলি কোন্দলে ব্যবহার হবে। ছাত্রলীগ ছাত্রলীগকে হত্যা করবে। সরকার দেশব্যাপী হত্যার উৎসব চালিয়েছে। প্রতিদিন ১২-১৫ জন নিরীহ মানুষ সরকারের পেটোয়া পুলিশ, র‌্যাব বাহিনী অথবা ছাত্রলীগের হাতে খুন হয়েছে। আর এই ফাঁকে পুলিশ ব্যাপকভাবে করেছে গ্রেফতারবাণিজ্য। এখনো করেই যাচ্ছে। সামান্য একটি ঘটনায় শত সহস্র মানুষকে আসামি করেছে। তার পর যাকে খুশি তাকে ধরে এনে বাণিজ্য চালিয়েছে। তার পর এরা আসামি ধরার নামে গ্রামে গ্রামে হ্নাা দিয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী দলকে প্রতিহত করেছে। রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সারা গ্রামের মানুষ লাঠিসোটা, ঝাঁটা, তীর, ধনুক নিয়ে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলেছে।
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আগে খুব একটা দেখা যায়নি। আমরা ছেলেবেলায় বর্ষাকালে দেখেছি ডাকাত প্রতিরোধের ঘটনা। বর্ষায় গ্রামের প্রতিটি বাড়ি আলাদা দ্বীপে পরিণত হতো। তখন ফারাক্কা বাঁধ ছিল না। ৫৪টি নদীর ওপর ভারতের বাঁধ ছিল না। অবাধে পানি আসত। আমরা প্রথম বর্ষার জন্য অপেক্ষা করতাম। শুকনো খাল রাতারাতি ভরাট হয়ে উঠত। পানি আর পানি। শস্য তলিয়ে যেত। অভিযোগ ছিল না। আধা-পাকা ধান সবাই মিলে কেটে যার যার উঠানে পৌঁছে দিত। এই ছিল আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। সে রকম বাংলাদেশের ভেতরে আমি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছি। পানি আর পানি দেখেছি। এখন কিছুই নেই। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মরা খাল এখন শুকনো হালট্। এখন থেকে গভীর করে মাটি কেটে নিয়ে যে যার মতো নতুন ঘর বানায়। পানি আর আসে না। ভারত পানি দেয় না। আমরা প্রতিবাদহীন।
এ সময় ডাকাতেরা গ্রামে হানা দিত। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামের লোকজন টেঁটা, বল্লম, লাঠিসোটা নিয়ে নৌকায় করে রাতভর গ্রাম পাহারা দিত। এখন আবার সেই একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এখন লোকজন পুলিশ ও ছাত্রলীগ প্রতিরোধ করার জন্য রাতভর গ্রাম পাহারা দেয়। সেই ডাকাতদের থেকে এদের পার্থক্য অনেক বড়। ডাকাতদের সহযোগী হিসেবে কখনো পুলিশ আসত না। পুলিশের সহযোগী হিসেবে কখনো ছাত্রলীগ আসত না। ছাত্রলীগ তখনো ছিল। তখন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র ইউনিয়নে আবার দুই ভাগ ছিল। এক ভাগ মতিয়া গ্রুপ। অপর ভাগ মেনন গ্রুপ। মতিয়া গ্রুপ মস্কোপন্থী হিসেবে বিবেচিত ছিল। মেনন গ্রুপ চীনপন্থ’ী হিসেবে মওলানা ভাসানীর অনুগত ছিল। সেই সময়ও ছাত্রলীগকে গুণ্ডা-মাস্তানের দল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। লেখাপড়া করা দল হিসেবে বিবেচনা করা হতো ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপকে। ফলে ছাত্রলীগের চেয়ে ছাত্র সমাজের ভেতরে ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপকেই সম্মানের চোখে দেখা হতো। সেসব দিন এখন আর নেই। এখন কখনো কখনো পুলিশ ডাকাতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কখনো কখনো বিরোধী দল দমনে ছাত্রলীগের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। কখনো কখনো বিভিন্ন খুনের ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ হাজির হয়।
এর অন্তনির্হিত বার্তা উপলব্ধি করার শক্তি এই জন্মান্ধ সরকারের নেই এবং এরা তা উপলব্ধি করতে চায় না। কী করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে নেয়া যায়, কী করে রাষ্ট্রকে ভারতের পদতলে নিবেদন করা যায়Ñ পাঁচ বছর ধরে এ কাজ করে এসেছে বর্তমান সরকার। কিন্তু এসব কার্যক্রমই ১৬ কোটি জনগণের বিরুদ্ধে কিছু ধারালো জিহ্বা লোকের নির্দেশনায় ঘটেছে। এর যে একটা অশুভ পরিণতি আছে, এসব অ্যাকশনের যে একটা রি-অ্যাকশন আছে তা বোঝার ক্ষমতা শাসকগোষ্ঠীর নেই। এরা মনে করছে জনগণ কলের পুতুল। এরা যা ইচ্ছে করবে, তারা যে নির্দেশ দেবে, জনগণ সে নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য। আসলে এত দিনে যে সে রামও গেছে, সে অযোধ্যও গেছে। এ সরকার সেটা উপলব্ধি করতে পারেনি। উপলব্ধি করতে পারেনি বলেই বিরাট বিপত্তি বেধেছে। সরকার জনগণকে এতই নিরেট গর্দভ মনে করেছে যে, এরা হুকুম দেবে আর জনগণ তা অবনত মস্তকে মেনে নেবে। সে দিন বাসি হয়ে গেছে। এখন শিক্ষার হার বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নে মানুষের সচেতনতার মাত্রা বেড়েছে। আর মানুষ নিজেই বুঝেছে, কী সত্য আর কী মিথ্যা। কোনটি সঠিক আর কোনটি প্রতারণা।
এর মধ্যে বিরোধী দল তথা ১৮ দলীয় জোট সারা দেশে ২৭, ২৮, ২৯ অক্টোবর তিন দিনের টানা হরতাল ডাকল। সরকার ভেবেছিল র‌্যাব, পুলিশ, ছাত্রলীগ দিয়ে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবে। এ তিন দিনে এরা ২১টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা যায়নি। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শেখ হাসিনা একেবারে ‘কেঁদে কেটে খুন’ হয়ে গেলেন। তিনি কি একবারও ভেবেছেন, তার পাঁচ বছরের শাসনকালে তার বিভিন্ন বাহিনী যে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তাদের মা-বোনদের হৃদয়ে কী আকুলতা-হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। তারা কি এসে প্রায় সব টেলিভিশনে একযোগ ভাষণ দিতে পারবে, তাদের হৃদয়ের বেদনা প্রকাশ করতে পারবে, ডজন ডজন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তারা কি নিজের সন্তানের জন্য, নিজের ভাইয়ের জন্য, নিজের বাপের জন্য কাঁদতে পারবেন, যাদের বর্তমান সরকারের বিভিন্ন বাহিনী হত্যা করেছে। তিনি কি তার এসব দলান্ধ মিডিয়াকে বলে দিতে পারবেন, যাও, এসব মানুষের ক্রন্দনধ্বনি নিয়ে আসো। সব টেলিভিশনে একযোগে প্রচার হোক। শেখ হাসিনাও মানুষ। তারাও মানুষ। কিন্তু এসব নাগরিককে তিনি মানুষের মূল্য দিতে পছন্দ করেননি।
বরং বহু ক্ষেত্রে তিনি এসব হত্যাকাণ্ড ডিভেন্ড করেছেন। সগৌরবে হত্যাকারীদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। যার বাপ খুন হয়, যার ভাই খুন হয়, যার চাচা খুন হয়, যার মামাতো ভাই খুন হয়, তাদের জন্য শেখ হাসিনার চোখের পানি ঝরেনি। শুধু নিজের বাপ-ভাইয়ের খুনে তার চোখে পানি ঝরেছে।
বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ফোনালাপে শেখ হাসিনা আশ্চর্য নাটক করেছেন। সে নাটকে তিনি বলেছেন, শেখ মুজিব ও তার পরিবারের হত্যা দিবসে বেগম খালেদা জিয়া কেন তার জন্মদিন পালন করেন। কেক কাটার ছুরি তিনি কিভাবে ব্যবহার করেন। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন মানুষের জন্ম মৃত্যু নির্ধারণ করেন। শেখ হাসিনার সরকার দেশের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। হাজার হাজার খুনের আসামিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্ত করে দিয়েছেন। যেন এরা বের হয়ে নির্বাচনকালে খুনের মহোৎসব চালাতে পারে। জনগণ তফাৎ যাও। বড় সাহেব আ রাহে।
কিন্তু এই তিন দিনে কী ঘটল বাংলাদেশে? কোথায় র‌্যাব, পুলিশ, ছাত্রলীগ, বিজিবি? জনগণ তার সব কিছুই অচল করে দিয়েছে। দেশজুড়ে সরকারের বিরুদ্ধে এক অচল অবস্থার ঘোষণা করেছে। ঢাকা ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকার বাইরে যে মন্ত্রীরা ছিলেন, তারা ছিলেন অবরুদ্ধ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জনতার প্রতিরোধে আটকে ছিলেন। তারপর পুলিশ দিয়ে মন্ত্রীদের উদ্ধার করে আনা হয়েছে। এমপিরা এলাকায় যেতে সাহস পান না। এরা সরকারের বিরুদ্ধে পুলিশের সহায়তার আবেদন জানান। মন্ত্রীদের অবস্থা আরো কাহিল। তারা ঘর থেকে বের হলেই বিপদ। পথে ঘাটে না জানি কোথায় কে তাদের গাড়ি আটকে লাঞ্ছিত করে বসেন।
জনগণের এটি প্রাথমিক রায়। সামনে জনগণের আরো কঠিন ও কঠোর রায় হবে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আজকে এত বিতর্ক, সংবিধান সংশোধন কমিটি যখন এটি নিয়ে আলোচনা করেছিল, সেখানে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কালো বিড়াল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রত্যেকেই বলেছিলেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে হাত দেয়া তাদের কিছুতেই উচিত হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলেন না। সংসদের এসব লোক উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউই আর তার প্রতিবাদ করেননি।
বাংলাদেশে কুন-ফায়াকুনের রাজনীতি চলছে। তত্ত্বাবধায়ক থাকলে ক্ষমতায় থাকা যাবে কি না, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় থাকা যে শেখ হাসিনার চাই-ই চাই। ফলে তার একক সিদ্ধান্তে আর খায়রুল হক নামক অনুদান-খাওয়া এক প্রধান বিচারপতির রায়ে ওই পদ্ধতি রাতারাতি বাতিল হয়ে গেল। এমন নির্লজ্জ বেহায়া লোক একটি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি হতে পারে, এ যেন কল্পনারও অতীত। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তিনি হয়েছিলেন এবং এমন একটি রায় তিনি দিলেন যার কোনো কার্যকারণ নেই। আশ্চর্য! শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, জনগণ কিছুই বুঝবে না। কিন্তু ওই তিন দিনের হরতালে র‌্যাব, পুলিশ, ছাত্রলীগ প্রতিহত করে জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছে, এরাই ক্ষমতার উৎস; র‌্যাব, পুলিশ, ছাত্রলীগ নয়। বিচ্ছিন্ন ঢাকা শহরে বসে অসহায় শেখ হাসিনা ও তার চাটুকারেরা নানা রকম বাগাড়ম্বর করেছে। বুঝতেও পারেনি, জনতার মার দুনিয়ার বার।
আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা এখন সেই মারের মুখোমুখি। জয় বাংলা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads