শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৩

বেগম জিয়ার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত


বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব কার্যত প্রত্যাখ্যান করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সংসদ সদস্যদের নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২১ অক্টোবর বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে সরকার ও বিরোধী দলের মনোনীত পাঁচজন করে উপদেষ্টা নিয়ে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন বিশিষ্ট নাগরিককে প্রধান উপদেষ্টা করে নির্বাচনকালীন অন্তর্বতী সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করেন। বেগম জিয়া তার প্রস্তাবে আরো বলেন, মনোনীত প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাদের রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যদের মতো সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত করে নেয়া যেতে পারে। তিনি এই প্রস্তাব দেয়ার এক দিন পরই দিনাজপুরে দলীয় জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ চলবে সংবিধান অনুযায়ী। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিলাম। বিরোধীদলীয় নেতার তা পছন্দ হয়নি। উনি ফিরে গেলেন ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে। আমরা জনগণকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আর বিএনপি নেত্রী দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চান।দুই নেত্রীর দুটি প্রস্তাবের কোনোটিই নতুন নয়। দুই নেত্রী তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলা যাবে না। সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আগেও একবার লন্ডনে বসে প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন। আর বিরোধীদলীয় নেতাও তার প্রস্তাবিত নির্দলীয় সরকারের কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই বলে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকেই মূলত প্রস্তাবটি দিয়েছেন। অর্থাৎ তার প্রস্তাবিত সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন দলের হলেও সরকারপ্রধান তিনিই থাকবেন। এ ব্যাপারে ছাড় দেয়ার কোনো ইঙ্গিত তার প্রস্তাবে নেই। অন্য দিকে বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবিত সরকারে তার নিজের কিংবা তার দলের সম্পৃক্ত হওয়ার দাবি করা হয়নি। নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা তিনি বলেছেন। এ দিক থেকে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা অনেক বেশি উদারতা ও নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তদুপরি বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবে একটি নতুনত্ব আছে। তা হলো অতীতে যা বলেননি এবার তিনি তা বলেছেন। তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হতে পারেন। বিরোধীদলীয় নেতার এ প্রস্তাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনেক বিতর্কের অবসান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে আমার ধারণা। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার এ সমালোচনার মূল কথা হচ্ছে, বিরোধীদলীয় নেতা অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছেন, যা সংবিধান এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি সংবিধান ও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি অন্তত বাহ্যিক আনুগত্য দেখানোর বিষয়টি প্রশংসার বৈকি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এ অভিমত দেয়া হয়েছে যে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করা যাবে না। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগঠনেরর বিধান ত্রয়োদশ সংশোধনীতে ছিল বিধায়, তা সংবিধানের মূল চেতনা বিরোধী’Ñ এ অজুহাতেই সর্বোচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেন এবং পরবর্তী দুটি সংসদনির্বাচন সংসদের বিবেচনাসাপেক্ষে সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালত এ অভিমতটা দেন পূর্ণাঙ্গ রায়ে। তবে এ রায় প্রকাশের ১৬ মাস আগেই ২০১১ সালের ১০ মে এ-সংক্রান্ত যে সংক্ষিপ্ত রায় দেয়া হয়, তাতে কিন্তু নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে বা সংসদের বিবেচনাসাপেক্ষে আরো দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারেÑ এমন কোনো কথা ছিল না। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আরো দুটি নির্বাচন করা যেতে পারে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তাই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। প্রয়োজনের তাগিদে (Doctrine of Necessity) অবৈধ আইনও বৈধ হতে পারে।অত্যন্ত যৌক্তিক ভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সর্বোচ্চ আদালত ৪:৩ মেজরিটিতে বাতিল করায় স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অনেকেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে স্ববিরোধিতা আছে বলে মনে করেন। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। কারণ এতে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা বরং আরো ঝুঁকির মধ্যেই পড়ে গেছে। তার পরও বলা যায়, সর্বোচ্চ আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়টি বহাল থাকলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজকের পর্যায় আসত না। কিন্তু সরকার সংক্ষিপ্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করলেও আরো দুটি নির্বাচন বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তটি একদম আমলে নেয়নি। সবার মতকে উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধনকরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা করার পর প্রধানমন্ত্রী বলতে শুরু করেন, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে আর রাষ্ট্রপরিচালনা নয়। এ বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সর্বোচ্চ আদালতের এ অবস্থান পরিবর্তন আইনসম্মত কি না, এ নিয়ে জোরালো প্রশ্ন আছে। সরকার ও সর্বোচ্চ আদালতের বর্তমান অবস্থান হচ্ছে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করা যাবে না, কারণ তা গণতন্ত্র এবং আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের মূল চেতনাবিরোধী। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচিত সরকার প্রীতির প্রসঙ্গে তাকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তা হলোÑ তার মরহুম বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত আট মাসের সরকারও কিন্তু নির্বাচিত সরকার ছিল না। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রিত্বে সংসদীয় পদ্ধতির যে নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়েছিল, ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেই সরকার বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। চতুর্থ সংশোধনী অনুযায়ী ৪৮ (১) ধারায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন। এ ধারার মর্ম কথা ছিল, রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু এই বিধান থাকা সত্ত্বেও শুধু বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে চতুর্থ সংশোধনীর ৩৪ দফায় রাষ্ট্রপতিসংক্রান্ত বিশেষ বিধান সংযোজন করা হয়। এ দফার (ক)-তে বলা হয় এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শুন্য হইবে।’ (খ) তে বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহার থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।তা হলে দেখা যাচ্ছে চতুর্থ সংশোধনীর ৪৮ (১) ধারায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা থাকলেও কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা না করেই সংশোধনীর ৩৪ (খ) দফায় এসে বঙ্গবন্ধুকে পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হলো এবং বলা হলো, ধরে নিতে হবে বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। অনেকের ভাষায় এটা ছিল এক ধরনের সাংবিধানিক ক্যু। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সরকার অনির্বাচিত সরকারে পরিণত হয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন, বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত না হলেও সংসদ তো নির্বাচিত ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার আর রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে সংসদ থাকে রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে নির্বাহী ক্ষমতা থাকে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ায় সংসদ গুরুত্বহীন পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর পদও নিয়ম রক্ষার পদে পরিণত হয়। সব নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির আজ্ঞাবহে পরিণত হন। ফলে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রপতি অনির্বাচিত থাকায় তার মন্ত্রিসভার কেউ নির্বাচিত থাকলেও তাতে ওই সরকারকে নির্বাচিত সরকার বলার সুযোগ নেই। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী নিজে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন, সেখানে ৫৭ (৩) ধারায় তার নিজের এবং ৫৮ (৪) তার মন্ত্রিপরিষদের সংসদের মেয়াদ পূর্তি বা ভেঙে যাওয়ার পরও স্বীয় পদে থাকার যে বিধান করে নিয়েছেন, তা কি নির্বাচিত সরকারের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? কাজেই সব ক্ষেত্রেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর গোঁ ধরাটা তার বাবার বিরুদ্ধে তো বটেই তার নিজের বিরুদ্ধেও যায়। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর চাহিদা এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। বেগম জিয়া তার প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও মহিলা সংসদ সদস্যরা যেভাবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন সেভাবে তার প্রস্তাবিত নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টাদের সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত করার কথা বলেছেন। বেগম জিয়া এ প্রস্তাব দিয়ে অনেক সমস্যা সমাধানের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। এটি যতটা গুরুত্ব বহন করে, সে তুলনায় এ নিয়ে আলেচনা নেই বললে চলে। বরং বেগম জিয়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা মনোনীত করার যে কথা বলেছেন, তা নিয়ে অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। বেগম জিয়ার প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটি হাইলাইট করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত করে নিলে বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো আর অনির্বাচিত থাকবে না। অন্তর্বর্তী সরকারও নির্বাচিত সরকারে পরিণত হবে। সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম। রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের মতো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারলে তিন মাসের নির্বাচনকালীন সরকারের বেলায় সেটি করা যাবে না কেন? বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করলে সংবিধান সংশোধন করার মতো ঝামেলায় পড়তে হবে বলে কিছু প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এ প্রক্রিয়ায় যেতে অনীহা প্রকাশ করছেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেও জটিল নয়। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে সহজেই এটি করা সম্ভব। কারণ সংসদ এখনো বহাল আছে। আমরা জানি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়েছিল মাত্র কয়েক মিনিটে। পঞ্চদশ সংশোধনীও সেভাবেই পাস হয়েছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করতে লেগেছিল এক রাত। কাজেই প্রস্তাবিত সংশোধনীর ক্ষেত্রেও উল্লিখিত তিনটি সংশোধনীর চেয়ে বেশি সময় লাগবে না। এ ক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে। সেটি হলো সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হলে তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে হয়তো বিবেচিত হবেন। কিন্তু তারা তো সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করলে সর্বোচ্চ আদালতের রায় অমান্য করার ঝুঁকি নিতে হবে। সর্বোচ্চ আদালত এটিকে কিভাবে গ্রহণ করবেন, তাও বিবেচনায় আনতে হবে। আমার বিশ্বাস, সর্বোচ্চ আদালতও এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আমাদের দেশে দুই দফায় পরিচালিত সামরিক শাসনামলের কর্মকাণ্ড এবং সর্বশেষ মইনদ্দীন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরের কর্মকাণ্ড মার্জনা করে বৈধতা দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। এ ক্ষেত্রে তো ওই রকম অবৈধতার বালাই নেই। বেগম জিয়ার প্রস্তাবের সাথে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মূল চেতনার (নির্বাচিত ব্যক্তি) কোনো বিরোধ নেই। বিরোধ শুধু এতটুকুইÑ সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত উপদেষ্টারা সংসদ সদস্য হবেন না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সর্বোচ্চ আদালত এই ছাড়টুকু দেবেন না, এটি মনে করা যায় না। বেগম জিয়ার প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কয় মেয়াদে হবে, সেটি আলোচনার বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে আগামী দুই টার্মকেই বেছে নেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে আবার জটিলতা না হয়, সে লক্ষ্যে দুই টার্ম পরে কোন সরকারের অধীনে কিভাবে নির্বাচন হবে সেই বিষয়ও আগাম ফায়সালা করে সব পক্ষ একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারে এবং প্রয়োজনে চুক্তিটি সংসদে পাস করিয়ে নেয়া যেতে পারে। এ কাজগুলো করতে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠানে কিছুটা দেরি হয়ে যায়, তাতে আইনগত সমস্যা হবে না। আমাদের সংবিধানের ১২৩ (৩)(ক) ধারায় আছে সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে এবং ১২৩ (৩) (খ) ধারায় আছে মেয়াদ পূর্তি ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। এখন যদি আলোচিত বিষয়গুলো সমাধান করার পর দেখা যায়, যে সময় আছে তাতে পূর্বের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংবিধানসম্মতভাবেই নির্বাচন করা যাবে। আসলে আন্তরিকতা থাকলে জাতীয় স্বার্থে যেকোনো সমঝোতাতেই আসা যায়। আইন, আদালত, সংবিধান কোনো কিছুই এতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তবে চলমান পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ পুরো বিষয়টি এখন তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছাই বর্তমান সঙ্কট সৃষ্টি করেছেÑ বিরোধী দলের এ প্রচার দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে তার নিজেরই সরকারপ্রধান থাকার কথা আছে। বেগম জিয়ার প্রস্তাবে নিজের কথা নেই, আছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা। চলমান সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী ছাড় না দিলে জাতীয় বিপর্যয়ের দায় যে, শেষ পর্যন্ত তাকেই বহন করতে হবে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads