রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৩

মওলানা ভাসানীর মূল্যায়ন সহজ নয়


মওলানা ভাসানীকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করা সম্ভবপর নয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার মানুষ লক্ষ্য করেছে ঃ মওলানা ভাসানী যেন কোন অনন্ত সত্যের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে একটির পর একটি শব্দ উচ্চারণ করতেন : আর তা সুবেহ সাদেকের নির্মল বাতাসের ন্যায় আমাদের মত সমাজবাদী, গৃহবাসী মানুষের জীবন ধারণের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের মতই স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে পবিত্রতার সুবাস ছড়িয়ে প্রবাহিত হত। মওলানা ভাসানী তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে লক্ষ্য কোটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন। মওলানা ভাসানী অন্যায় হতে ন্যায়কে, কালো হতে আলোকে, অসত্য হতে সত্যকে, অন্ধ সংস্কার হতে যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তকে পৃথক করে জীবনে চলার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।
সভা আহবানের ও বক্তৃতা করার ব্যাপারে মওলানা ভাসানী এই উপমহাদেশে অপরাজেয় হয়ে থাকবেন। কারণ দর্শক কত হতে পারে মওলানা ভাসানী আগেই আন্দাজ করতে পারতেন। তদানুসারে হুকুম করতেন সভাস্থলের অদূরে একশত কিংবা ততোধিক চালাঘর, পঞ্চাশ কিংবা তার অধিক পায়খানা তৈরি হবে। কয়েক ঘণ্টা পর দেখা যেত ঠিক ততটি তৈরি হয়ে গিয়েছে। কে বাঁশ আনল, কে বেত দিল, কামলারা পর্যন্ত জানত না। মওলানা ভাসানী বাকসর্বস্ব, কর্মবিমুখ, পোশাকী নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন জননায়ক। মুসলমান নেতাগণের মধ্যে একমাত্র খান আব্দুল গফফার খানই তাঁর সমকক্ষ।
 ইংরেজ আমলে ১৯৩৮ সালে আসামে ‘লাইন প্রথা’ নিয়ে এক তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলন চলেছিল প্রায় দীর্ঘ দশ বছর-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী। টাঙ্গাইলে জমিদারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মী রূপে হয় তাঁর প্রথম আবির্ভাব। ভাসানীর সততা, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তা কৃষক-জনসাধারণের অন্তরে এতটা সাড়া জাগিয়েছিল যে, অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে তাঁর দলে লাখ লাখ কৃষক কর্মীর যোগদানের ফলে।
জমিদারগণ প্রমাদগুণতে থাকেন। কিছুতেই তাঁকে নত করতে না পেরে জমিদারিরা অবশেষে তাঁকে দেশ ছাড়া করার জন্য ষড়যন্ত্র পাকাতে শুরু করেন। আমলাতন্ত্রের আনুকূল্যে তাঁদের ষড়যন্ত্র সফল হয় এবং মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল ত্যাগ করে আসামে চলে যেতে বাধ্য হন।
মওলানা ভাসানী সরকারি জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর তীব্র প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে আসাম সরকার পুলিশ বাহিনী মংগলদইর উপরোক্ত এলাকায় যে নির্মম ও বর্বর অত্যাচার করে, জুলুমের ইতিহাসে তার নজীর খুবই কম মিলবে। হাতি দিয়ে সে সমস্ত এলাকা বিধ্বস্ত করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, প্রতিটি গৃহে অগ্নিসংযোগ করে তা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এমনকি গৃহ সামগ্রী সরাবার অবসরও তারা কাউকে দেয়নি। ফলে এই হতভাগ্যের দল একেবারে সর্বাত্মকভাবে সর্বহারা হয়ে পড়ে। মওলানা ভাসানী এই সরকারি জুলুমের প্রতিবাদকল্পে এক প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন মংগলদই-এ। অবশেষে তাদের পুনর্বাসন করতে বাধ্য হয় ইংরেজ সরকার।
মওলানা ভাসানী অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। দেশীয় মোটা কাপড়ের লুঙ্গি, খদ্দরের পাঞ্জাবী, মাথায় তালের আঁশের টুপি এবং পায়ে চটি জুতা পরতেন। তার নিজস্ব কোন গাড়ি ছিল না। তিনি গ্রাম্য দরিদ্র মানুষদেরই মতোই ছনের ঘরে বসবাস করতেন এবং গ্রীস্মকালে নবীপ্রেমিক হযরত ওমরের (রাঃ) মতোই ঘাসের ওপর শুয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি কৃষকদের মতোই লাউয়ের পাতার ভর্তা, পাটশাক, গ্রামের তরি-তরকারি, ছোট মাছের চচ্চড়ি, টাকি মাছের ভর্তা, শৈল ও গজার মাছের পোনার ভাজি খেতে পছন্দ করতেন। বড় মাছ, গোশত খেতে যে তিনি একেবারেই অপছন্দ করতেন তা নয়। এগুলো বড়লোকদের খাদ্য বলে তিনি এর প্রতি এতটা প্রলুব্ধ ছিলেন না।
মওলানা ভাসানী অপরের দুঃখে সর্বদা ব্যথিত হতেন। আর্ত-অসহায় মানুষের সেবাকে তিনি পরম সাধনা বলে মনে করতেন। শত্রু পরাভূত হলে মওলানা ভাসানী তার প্রতি কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। কেউ কোন সময়ে কোন কাজে তার অপকার করলে তাকে তিনি ভুলে যেতেন। উপকারীর উপকারের প্রতিদান দিতে তিনি সদা আগ্রহী থাকতেন।
 তিনি খুব অতিথিপরায়ণ ছিলেন। অতিথিকে আগে খেতে দিয়ে পরে খেতেন। প্রতিবেশীকে অভুক্ত জেনে তিনি কখনও আহার করেননি। তিনি গরিব যুবক-যুবতীদের বিবাহ কার্য সম্পাদনে সাহায্য-সহযোগিতা করে আনন্দ পেতেন। কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের উপক্রম হলে দম্পতিদ্বয়ের মধ্যে মিলমিশ করে দিতে পছন্দ করতেন।
পাকিস্তান আমলে পর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শোষণমুক্ত সমাজের প্রত্যাশী জাগ্রত জনগণ স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং ভারতের আগ্রাসী ভূমিকা, স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যদের ভূমিকা অস্বীকার, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নতুন হিংস্র এবং লোভী চেহারা তাদের অত্যাচার, সন্ত্রাস এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের অঙ্কুরিত বাসনা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠছিল। মওলানা ভাসানী সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। জনগণ যে প্রতিবাদের প্রত্যাশী ছিল মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘হক কথা’ প্রকাশ তার প্রাপ্তি তাদের উল্লসিত করে তোলো। হক কথা হয়ে উঠে জনগণের বুকের ভেতর গুমরে উঠা প্রতিবাদী কথামালার কণ্ঠস্বর। সেই ১৯৭২-এর দুঃসময়ে হক কথা রেখেছিল এক প্রচ- প্রতিবাদী দুঃসাহসী ভূমিকা। অনেক গোপনীয় খবর সেখানে প্রকাশিত হতো যা অন্য পত্রিকায় ছাপা সম্ভব ছিল না। হক কথার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ। প্রকাশক ও পৃষ্ঠপোষক মওলানা ভাসানী হক কথার সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন সৈয়দ ইরফানুল বারীর উপর।
১৯৭৩ সালের দিকে ‘এসো দেশ গড়ি’ সেøাগান তুলে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক দলের হাতে ক্ষমতা পরিচালনার লাইসেন্স নেয়ার প্রয়াস চলে। তখন আওয়ামী লীগ ছাড়া ন্যাপ (মোঃ) এবং কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এ ধারার সাথে ঐক্যমত পোষণ করে। সৃষ্টি হয় ত্রি-দলীয় ঐক্যজোট। ১৪ অক্টোবর ন্যাপ (মোজাফফর), আওয়ামী লীগ ও সিপিবি’র সমন্বয়ে ঐক্যজোট গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধাসমূহ দূর করাই ছিল এই জোটের ঘোষিত লক্ষ্য।
ত্রি-দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হলেও তারা আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তখন মওলানা ভাসানীসহ জাসদের নেতা-কর্মীরা মুজিব সরকারের দুঃশাসনের সঠিক চিত্র তুলে ধরলে ন্যাপ (মোঃ) এবং সিপিবি তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে। বিশেষ করে সিপিবি মুজিব সরকারের তোয়াজে তার দিন অতিবাহিত করে। তখন সিপিবি’র নেতা মনি সিংহ মওলানা ভাসানীকে টুকরো টুকরো করার হুমকি দিয়েছিলেন মুজিবের আশীর্বাদে থেকে। জবাবে ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৩ দেশবাসীর উদ্দেশে এক বিবৃতিতে ভাসানী বলেছিলেন, ‘গত ২৯ ডিসেম্বর ত্রিদলীয় ঐক্য জোট কর্তৃক আহূত বায়তুল মোকাররমের এক গণজমায়েতে বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান শ্রী মনি সিং বলিয়াছেন যে, আমাকে বাংলার মাটি হইতে উৎখাত করিবেন এবং টুকরো টুকরো করিয়া ফেলিবেন। তিনি সরকারের সমালোচনাকারী পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেও কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা নস্যাতের অভিযোগ পুনরায় উত্থাপন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, যেহেতু আমি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাইয়াছি তাই আমাকে টুকরো টুকরো করিয়া ফেলাই সাব্যস্ত করিয়াছেন। তাঁহার ভাষণদানকালীন আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা হাজির ছিলেন, ইহাও লক্ষ্যণীয়। শ্রী মনি সিংহ-এর এহেন বাক্যসার বাসনায় আমার কি হইবে না হইবে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও ভাবিয়া দেখিবার প্রয়োজন বোধ করি না। কিšুÍ যে-খুঁটির জোরে তিনি এই কাজ করিয়াছেন তাহাদের গুপ্ত রাজনীতির অশুভ পাঁয়তারা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল বলিয়া দেশবাসীর নিকট শ্রী মনি সিং-এর এই কাগুজে হুংকার দ্বিতীয় বারের মতো ভাবিয়া দেখিতে আলোচনায় অবতীর্ণ হইলাম। তাঁহার উপরিউক্ত ঘোষণা হইতে ইহাই প্রমাণিত হইতেছে যে, ত্রিদলীয় ঐক্য জোট বাংলাদেশে একটি রক্তারক্তি ঘটাইতে বদ্ধপরিকর। এমনিতেই দেশে অরাজকতা বিরাজ করিতেছে। তাহার মধ্যে কোন  দুঃসাহসে রুশ-হিন্দুস্তানের পা-চাটা জোট এই প্রকার ঘোষণা সর্বসমক্ষে করিতে পারিল ইহাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। নানা কারণের সহিত পরস্পর বিরোধী এই জোটের হুংকার মিলাইয়া আমি আজ স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি যে, অচিরেই আন্তর্জাতিক ভয়াবহ এক চক্রান্তের জের স্বরূপ বাংলাদেশে অপ্রতিরোধ্য রক্তপাত ঘটিবে। শ্রী মনি সিংহরা চাহিতেছেন ব্যাপক হারে একদফা হত্যাকা- ঘটাইয়া বাংলাদেশে রাশিয়া ও হিন্দুস্তানের চক্রজাল নির্বিঘেœ বিস্তার করিতে। অতীতেও রাশিয়া, হাঙ্গেরী, মধ্য এশিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়ায় খোলা হাতে রক্তপাত ঘটাইয়াছে। হিন্দুস্তান, নাগা, মিজো, সিকিম, দাক্ষিণাত্য, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি এলাকায় নির্লজ্জ বেপরোয়া হত্যাকা- চালাইয়া মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনকে ধ্বংস করিয়াছে। রুশ-হিন্দুস্তানে সামরিক সাহায্য, গোয়েন্দাগিরিতে সহযোগিতা, সর্বোপরি কূট পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করিয়া ত্রিদলীয় ঐক্য জোট এই সোনার বাংলাদেশকে কেনা গোলামের দেশে পরিণত করিতে চায়। যাহারা তাহাদের গোলাম থাকিবে না বলিয়া তাহারা মনে করিবে তাহাদিগকে ঠা-া মাথায় হত্যা করা হইবে। আমার জানমাল আজ বিপন্ন-এই কথা বলিবার পূর্বে আমি দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই, বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা প্রতিটি রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, শ্রমিক নেতা ছাত্র নেতা এক মহা অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার দিন কাটাইতেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads