রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৩

এ কেমন উন্মাদনা!


যা লিখব ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি সেখান থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। দেশের অবস্থা প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে। এটা ভাবি তো ওটা হয়। যা কল্পনা করি না হঠাৎ করে তেমন ঘটনা ঘটে। সরকারের কথা ও কাজে আসমান-জমিন ফারাক সৃষ্টি হয়। যেমন, কল্পনা করিনি যে শুক্রবার রাতভর বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান চলবে। বিএনপি অফিস বা বেগম খালেদা জিয়ার বাসা-অফিস পুলিশ ঘেরাও করবে। সেখান থেকে যে বের হবে, সেই আটক হয়ে যাবে। আটকের কারণ হিসেবে বলা হতে পারে যে, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াÑ এরা বোমা মেরেছেন বা বাসে আগুন দিয়েছেন। এমনকি বিরোধীদলীয় নেত্রীর উপদেষ্টা ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিণ্টু ও বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস পর্যন্ত গ্রেফতার হবেন। শুক্রবার রাতেই এই ঘটনা ঘটেছে। শনিবার সকালে যখন এই লেখা লিখতে বসেছি তখনো জানি না, সারা দিনে কী ঘটবে। রোববার, সোমবার কী ঘটবে। 
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার সব দিক থেকে একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের ভেতরে এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করছে। গণতন্ত্র তো অনেক পরের কথা, সাধারণ বিচারেও এ কথা বিশ্বাস হতে চায় না যে, সরকার কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কর্মপন্থা সম্ভবত একটাইÑ সেটা হলো, কোনো অবস্থাতেই যাতে বিএনপি নির্বাচনে না আসতে পারে। কারণ গত পাঁচ বছরে সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন ও লুণ্ঠন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কেউ আর এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কিছুকাল যাবৎ এমনকি সরকার সমর্থক পত্রপত্রিকাগুলোও যেসব জনমত জরিপ প্রকাশ করছে তাতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় অবিরাম ধস নামছে। আর বিএনপির জনপ্রিয়তা অতি দ্রুত বাড়ছে। এসব জরিপে প্রধানমন্ত্রীসহ তার চমকের মন্ত্রিসভার সদস্যরা খুবই ুব্ধ। কিংবা ুব্ধ জনগণের ওপরই। সারা দেশে তারা তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এত সব বিলবোর্ড টানালেন, প্রায় প্রতিটি অফিসের সামনে বর্তমান সরকারের আমলে যে বিশাল কর্মযজ্ঞঅনুষ্ঠিত হয়েছে, তার তালিকা টাঙিয়ে রাখলেন, তাতেও কোনো ফায়দা হলো না। মূর্খজনগণ তবুও প্রতিনিয়তই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে, তারা বিএনপিকেই ভোট দেবেন। এ-ও কি সহ্য হয়! 
সুতরাং এই জনগণের ওপর আরেক দফা প্রতিশোধ নিতেই হবে। রাজনীতিতে আসার সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘তিনি রাজনীতিকে ঘৃণা করেন। কিন্তু পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তিনি রাজনীতিতে এসেছেন।সে প্রতিশোধ তিনি সম্ভত নিয়েছেন। কিন্তু এটা তিনি বিবেচনায় নিতে পারেননি যে, এত বড় একজন নেতার হত্যাকাণ্ডের পরেও সে সময় সাধারণ মানুষের মনে কেন প্রতিক্রিয়া হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডে ইন্ধনদাতাদের কেউ কেউ এখন তার মন্ত্রিসভার সদস্য। তার রহস্যও বোঝা দুষ্কর। স্কুলের ফুটবল খেলার মাঠে কোনো কোনো খেলোয়াড় নামেন, তিনি কোন পোস্টে খেলছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বল পেলেই লাথি মারছেন তা নিজের গোলপোস্ট ভেদ করল, নাকি প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট ভেদ করল সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। লেফট আউটে দাঁড়িয়ে রাইট আউট বা স্ট্রাইকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। খেলা বলে কথা, বল কোন দিকে গেল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের গ্রামাঞ্চলে ছেলেবেলায় আমরা এই ধরনের খেলোয়াড়কে হাজটবলতাম। সরকার এখন হাজটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। 
এ রকম গল্প শেখ মুজিবুর রহমানও বলেছিলেন। সম্ভবত তার এলাকায় এ রকম খেলোয়াড়দের নাম রাজা মিয়া বলে অভিহিত করা হতো। গোপালগঞ্জের একজন নামকরা ফুটবলার নাকি ছিলেন তার নাম ছিল রাজা মিয়া। রাজা মিয়ার পায়ে বল এলেই গোল দিতেন। গোল করা ছিল তার কাছে নেশার মতো। তবে তিনি নিজ দলের গোলপোস্টেও গোল দিতে কসুর করতেন না। তৎকালীন জাতীয় সংসদে এই রাজা মিয়ার গল্প শুনিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিগত বিএনপি শাসনামলে জাতীয় সংসদে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা একই গল্প শুনিয়েছিলেন। একই গল্প তিনি শুনিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও। কিন্তু হাসিনা সরকারই এখন হাজটবা রাজা মিয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। 
শুক্রবার রাতেই যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। জনাব মিন্টু এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। এখন তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। জনাব মিন্টুর কী দোষ? সেটা খুব স্পষ্ট নয়। তিনি প্রায় নিভৃতে আওয়ামী লীগ ছেড়েছেন। শেখ হাসিনার ডেকে আনা সামরিক সরকারের রিমান্ডে তার অতি নিকটজনেরা সম্ভবত নানা চাপের মুখে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মিন্টু শত চাপের মুখেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তেমন কোনো কথা বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন, আমি ব্যবসায়ী মানুষ। বাংলাদেশে যেভাবে ব্যবসা করতে হয় আমি তা-ই করেছি। এর বাইরে কিছু করিনি। 
কিন্তু সম্প্রতি ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তাতে আবদুল আউয়াল মিন্টুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছ থেকে তিনটি বিষয় শিখেছিলামÑ এক. নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, দুই. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা এবং তিন. নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা তৈরি করা। ১৯৯৬ সালে এই তিন দাবি নিয়ে আপনারই নেতৃত্বে রাজপথে নেমেছিলাম। আজো রাজপথে আছি। আমি এখনো আপনার শিক্ষা দেয়া সে দাবি নিয়েই রাজপথে আছি।হতে পারে এটাই আবদুল আউয়াল মিন্টুর দোষ। আর সে কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার বাসভবন থেকে বের হওয়ার পর শুক্রবার রাত শোয়া ১টার দিকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 
এসব ঘটনার আগামাথা কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে যে, ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা কী ভয়ঙ্কর উত্তেজনায় ভুগছেন। গণতন্ত্রের কথা আমরা তার মুখে অবিরাম শুনছি। ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ কিন্তু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আর ফিতা কাটার ধুম লেগেছে। এমন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও। ইন্দিরা গান্ধীও একবার ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগে এভাবেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। শত-সহস্র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল কিন্তু কোনোটিরই কাজ শুরু হয়নি। শেষে এক আমলা তার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্যার এত যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো কিন্তু তার একটিরও কাজ শুরু করা হলো না। এখন এগুলোর কী হবে?’ ঊর্ধ্বতন আমলা বললেন, তাহলে এক কাজ করো। এসব ভিত্তিপ্রস্তর রাখার জন্য একটি জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীকে তা উদ্বোধনের জন্য নিমন্ত্রণ করো।এটি ছিল পত্রিকার রসিকতা। 
শনিবারের সংবাদপত্রেই এর একটি উদাহরণ ছাপা হয়েছে। ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল ২৬ কিলোমিটারের এক উড়াল সড়ক নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিত্তিপ্রস্তরটি সেখানে এখনো আছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তাতে একটি ইটও বসেনি। এ রকম অসংখ্য ভিত্তিপ্রস্তর শেখ হাসিনা স্থাপন করেছেন। ক্ষমতার শেষ দিনেও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যাচ্ছেন। জানি না কোনো দিন এসব ভিত্তিপ্রস্তর রাখার জন্য একটি জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রয়োজন পড়বে কি না। শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীদের কথা শুনলে মনে হয়, বাংলাদেশে দুধের নহর বইছে। উন্নয়নের জোয়ারে দেশ সয়লাব। মাথাপিছু আয়ের বড়াই করেন। সে বড়াই যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফাঁকা বুলি সেটি বলে বোঝানোর প্রযোজন নেই। ভারতেরও মাথাপিছু আয় ভালো। কিন্তু ১১৫ কোটি মানুষে মধ্যে ৭০ কোটি মানুষের আয় বাংলাদেশী টাকায় ৪০ টাকার নিচে। তাদের পায়ে জুতা নেই। গায়ে পরার মতো জামা নেই। মলমূত্র ত্যাগের জন্য কোনো পায়খানাও নেই। এরা ভারতের উচ্চ শ্রেণী কর্তৃক শোষিত, নির্যাতিত ও নিগৃহীত। বাংলাদেশের অবস্থাও তার চেয়ে উন্নত নয়। 
ফলে জনমত যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শোষিত, নিগৃহীত, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত মানুষেরা শেখ হাসিনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রথম আলো, যুগান্তর প্রভৃতি প্রত্রিকায় যে জনমত জরিপ ছাপা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে জনসমর্থনে বিএনপি থেকে অনেক পেছনে পড়ে যাচ্ছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ ডেইলি স্টার ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এক জনমত জরিপ ছাপা হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। তাতে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৫৫ ভাগ লোক বলেছে আগামী নির্বাচনে তারা বিএনপিকে ভোট দেবে। আর ২৮ ভাগ লোক বলেছে তারা ভোট দেবে আওয়ামী লীগকে। অর্থাৎ ভোটের পাল্লায় বিএনপির থেকে একেবারে অর্ধেকে নেমে এসেছে আওয়ামী লীগ। এও কি সহ্য হয়! কেন জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না? এবার জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়ব। সেই জেদেই বাতিল হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। শেখ হাসিনা নিজে যেন কাঁচাকঞ্চি হাতে হেডমাস্টারের মতো বেরিয়ে পড়বেন। 
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর। সংবিধান সংশোধন কমিটি যখন গঠন করা হয়, তখন কমিটির কেউই বলেননি যে, এই ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। কেউ কেউ বলেছিলেন, এতে হাত দেয়াই ঠিক হবে না। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে অনুদান-খাওয়া প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের এক বিতর্কিত বিভক্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। কমিটিতে আলোচনায় যারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলেন, তারাও সংসদে চুপচাপ হাত তুলে বাতিলের আইনটি পাস করিয়ে দেন। মেরুদণ্ড সোজা করে কেউ দাঁড়াতে পারেননি। ফলে দেশে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেই এই সঙ্কটের সমাধান করা সম্ভব, অন্য কোনো পথে নয়।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads