বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৩

এরশাদ নাচে সুতার টান



জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাজোট সরকারের পার্টনার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনেও যাচ্ছেন। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফীর সাথে দেখা করে নির্বাচনে যাওয়ার এই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি হেফাজতের আমিরের সমর্থন ও দোয়া চাইতে গেলেও তা পাননি। বিফল মনে ঢাকা ফিরেই মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে এখন প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইছেন। হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, দুপুরে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে বিকেলে তার দল থেকে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। আরেকজন মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা হয়েছেন। অর্থাৎ মহাজোটের পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্য আগের একজন থেকে বেড়ে ছয়জনে দাঁড়িয়েছে। জি এম কাদেরের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না হলে আরো একজন বাড়বে। নির্বাচনে যোগদান ও মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সদস্য বাড়ানোর জন্য দরকষাকষির অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহে এরশাদ নাটক সাজাতে থাকেন। তা সফলভাবে মঞ্চস্থ হয় বঙ্গভবনে, যেখানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’জনই উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির শীর্ষ নেতারা যখন কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে তখন এরশাদ হঠাৎ করে আওয়ামী সরকারবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অথচ তার ভাই তখনো মন্ত্রিসভার সদস্য। ১১ নভেম্বর এরশাদ বলেছিলেন, দেশের যা অবস্থা তাতে আওয়ামী লীগের সাথে গিয়ে মানুষের ঘৃণা নিয়ে মরতে চাই না। আমার তো চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি বেহেশতে যেতেও রাজি নন। এর আগে ১২ নভেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে তিনি নির্বাচনে যাবেন না। তিনি নিজেই প্রশ্ন রেখে বলেনÑ নির্বাচনে গেলে কী হবে? মানুষ জানবে, বুঝবে আমি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নির্বাচন করছি। তখন মানুষ বলবে এরশাদ সাহেব কথা রাখেন না। সম্মান বড়, না জেল বড়। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ আমাকে থুথু দেবে। এরচেয়ে জেলেই মরে যাওয়া ভালো। এই যোগদানের পর মানুষ এরশাদকে থুথু দেবে কি না, তা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে। তবে তিনি মাটিতে ফেলে দেয়া নিজের থুথু বহুবার গিলেছেন; এবারো তাই করেছেন। ১৬ নভেম্বর তিনি বলেছিলেন নির্বাচনের প্রশ্নে তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। নির্বাচনে অংশ নিলে তাকে সবাই বেঈমান বলবে। আর নির্বাচনে অংশ না নিলে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অবশেষে এরশাদ পথের দিশা পেয়েছেন। তিনি অতীতের মতো নির্দেশিত পথে হাঁটছেন। নির্দেশের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। এই পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে। তার এই পথচলার সাথীও তখনই ঠিক করা হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা নেয়ার পরপরই বলেছিলেনÑ আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। বর্তমান বিএনপি নেতা ও এরশাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ তার বইয়ে দু’জনের রাজনৈতিক আলোচনায় লং ড্রাইভের বিবরণ দিয়েছেন। এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মওদুদ আহমদ তার ‘ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড দি চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ে লিখেছেনÑ কমপক্ষে দুইবার এরশাদ গোপনে হাসিনার সাথে দেখা করেছেন। একবার তিনি হাসিনাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যান এবং তাকে আশ্বস্ত করেন, শেখ মুজিবকে সরকারিভাবে জাতির পিতা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে, মুজিব হত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। শেখ হাসিনার সাথে এরশাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলায় মান-অভিমান থাকলেও বিচ্ছেদ ঘটেনি। দু’জনেই রাজনৈতিক নাটকে দারুণ পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। রাজনৈতিক ময়দানে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অনেকটা পরিপূরক। দুই দলই পরস্পরের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তার সরকারের বৈধতার পথ খুঁজতে থাকেন। ’৮৬ সালের নির্বাচন ছিল এরশাদের সামরিক শাসনের বৈধতার নির্বাচন। এ জন্য তিনি খুব সহজেই আওয়ামী লীগকে পেয়েছিলেন। বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাম জোটের ৫ দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল। এই নির্বাচনে রামদা, বন্দুক, বল্লম হাতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্র দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার আসনে ভোট শুরু হওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি ভোট পড়ে। ভোটের দিন ১৫ জন খুন হন, ৭৫০ জনের হাত-পা কেটে যায় আবার কারো বা মাথা ফেটে যায়। নির্বাচনে সরকারিভাবে ৫৪ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হয়েছিল বলে দাবি করা হলেও পর্যবেক্ষকদের ধারণা ভোট ডাকাতির সহিংসতায় ১৫ শতাংশের বেশি লোক ভোটকেন্দ্রে আসেনি। জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে বিজয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬ আসন। জামায়াত পেয়েছিল ১০ আসন। এটাই ছিল বাংলাদেশে আদিম হিংসা ও অমানবিকতার প্রথম অবাধ নির্বাচন। এমন একটি নির্বাচনের পথে হয়তো আবার দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনী নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী বদল হয়েছে। এবার সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এরশাদ বিরোধী দলের ভূমিকায়। ’৮৬ সালে নির্বাচন বর্জন করা রাশেদ খান মেননও শেখ হাসিনার নৌকায় উঠে পড়েছেন। বিএনপি একতরফা নির্বাচন বর্জনের আগের ভূমিকায়; এবার সাথে যোগ হয়েছে জামায়াত। ’৮৬-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পরস্পরের বিরুদ্ধে ভোট ডাকাতিসহ নানা অভিযোগ আনলেও বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরশাদের ছিল বৈধতার সমস্যা; এই নির্বাচনে শেখ হাসিনা সেই সঙ্কট থেকে এরশাদকে উদ্ধার করেছিলেন। একইভাবে শেখ হাসিনা ’৯৬ সালের নির্বাচনে ১৪৬ আসনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। এটাই ছিল নির্বাচনের সাহায্যের জন্য এরশাদের পক্ষ থেকে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিদান। জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে করা হয়েছিল মন্ত্রী। সেই সরকারের নাম দেয়া হয়েছিল ঐকমত্যের সরকার। এবার নাম দেয়ার চেষ্টা চলছে সর্বদলীয় সরকার, যদিও এটা পুরোপুরিভাবে চারদলীয় মহাজোটের সরকার। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের পর থেকে এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন। তিনি মহাজোটে যোগদান করেন। নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৭ সালের মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল উভয় দল। হাসিনা-এরশাদ উভয়ই বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন। এরশাদের দাবিÑ নির্বাচনের আগে তাকে রাষ্ট্রপতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আরো মন্ত্রী নেয়ার ওয়াদাও ছিল। কিন্তু সেই ওয়াদা পূরণ হয়নি। শুধু ভাই জি এম কাদের ছিলেন মহাজোট মন্ত্রিসভার সদস্য। এরশাদের আক্ষেপের শেষ ছিল না। কিন্তু মেরুদণ্ডতে আগেই মাখন লাগানো ছিল। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি, বরং ২০০৯ সালের আগস্টে রংপুরে এক সভায় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছোট বোন। বোনের বিপদ-আপদে সব সময় তার পাশে থাকবেন। সম্ভবত এরশাদ একটি ওয়াদা ঠিকমতো প্রতিপালন করেছেন; তা হচ্ছে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানো। সত্যিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বিপদে আছেন; বিরোধী দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছে না। অবাধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দেশী-বিদেশী চাপ বাড়ছে। বারিধারা প্রেসিডেন্টপার্কের বাসায় ১১ নভেম্বর এরশাদ নিজেই সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর এত দুর্যোগময় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি দেশে আসেনি। গ্রামগঞ্জে যেভাবে মানুষ নেমে পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সরকার যা করছে তাকে কোনোভাবেই গণতন্ত্র বলা যায় না। গণতন্ত্রচর্চার নামে গণতন্ত্রের কবর রচনার চেষ্টা করেছেন।’ ৯ বছরের শাসনে গণতন্ত্রের কবর রচনার কাজটি তিনিও করেছেন। এটা তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। এখন কবর খোঁড়ার কাজে তিনি বোনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি বন্ধুত্বে সব সময় সেতুবন্ধনের কাজটি হয়েছে দিল্লিতে। দিল্লির পরিকল্পনার বাইরে এরশাদ কখনোই যেতে পারেননি। সেনাপ্রধান এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণকে রাজনৈতিকভাবে প্রথম স্বাগত জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তেমনি এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণে দিল্লিতে ছিল উল্লাস। কংগ্রেসের সমর্থক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের ঢাকায় আনাগোনা সে সময় থেকে বাড়তে থাকে। এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণের পর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় ছিল বন্দুকের নলে প্রজাপতি। অপর দিকে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বাংলার বাণীর শিরোনাম ছিলÑ একটি গুলিও ফোটেনি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও যখনই এরশাদকে বড় কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, ছুটে গেছেন দিল্লিতে। পুনর্গঠিত মহাজোট সরকারে যোগ দেয়ার আগে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে দিল্লি যান। সেখান থেকে এসেই তিনি সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে থাকেন। সবই ছিল তার সাজানো নাটক। তবে বয়সের ভারে কিংবা চিরাচরিত অসত্য বলার অভ্যাস থেকে এবার হয়তো একটু বেশিই বলে ফেলেছিলেন। এর মধ্যে তার কূটকৌশল থেমে থাকেনি। বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম রবের নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে এই জোট হাইজ্যাক করতে চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আরো বেশি কিছু আদায় করা। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম রব সম্ভবত আগেই টের পেয়েছিলেন। তার সাথে জোট করেননি। কাদের সিদ্দিকী হুঁশিয়ার করে দিয়েছেনÑ বেশি খেলা ভালো নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দরকষাকষিতে তিনি ভালোই জিতেছেন। দলের ভারতপন্থী সব নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়েছে। নিজের প্রথম স্ত্রীকেও মন্ত্রী বানিয়েছেন। গত চার বছরে যেখানে বহু দেনদরবার করেও নিজের ভাই ছাড়া কাউকে মন্ত্রী করতে পারেননি সেখানে ছক্কা মেরেছেন। শেখ হাসিনা কি বড় ভাইয়ের প্রতি উদারতা দেখিয়েছেন। না। শেখ হাসিনাও ভালো খেলেছেন। এরশাদকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন। মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এরশাদের এবারের খেলায় তার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার দায় এখন তাকেও নিতে হবে। এরশাদ যে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ দেখছেন। সেখানে সবচেয়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি এখন দেশের উত্তরাঞ্চলে। আঞ্চলিক দল হিসেবে উত্তরের জনপদে তার ভোটব্যাংকে এখন ধস নামার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর খোঁড়ার যে আয়োজন চলছে তার আগেই হয়তো এরশাদের রাজনৈতিক মৃত্যু হবে। শেখ হাসিনা বেশ চতুরতার সাথে এই কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছেন। জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভের আরেকটি লক্ষ্যবস্তু হলো এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads