শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৩

ইতিহাসের ব্যাখ্যার আলোকে ১৯৭৫-এর সিপাহী-জনতার বিপ্লব


কোনো কোনো জাতির জীবনে রক্তক্ষয়ী এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেগুলো সে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রত্যক্ষ অবদান রাখে। আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার সঙ্গী-সাথীরা অস্বীকার করলেও ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরও বাংলাদেশের জন্য অমন একটি দিকনির্ধারণী ঘটনাই সংঘটিত হয়েছিল। দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন হিসেবে। রক্তক্ষয়ী ও সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর চার বছর যেতে না যেতেই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব সে সময় ভয়ংকর হুমকির মুখে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের পর এদেশের ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনী সেদিন আরো একবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং দেশ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬ নবেম্বর রাত থেকে ৭ নবেম্বরের মধ্যে। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর শেখ মুজিবেরই সহকর্মী ও প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই খন্দকার মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নবেম্বর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে সেনাপ্রধানের পদ দখল করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দী করা হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের ওই অভ্যুত্থান দেশকে বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল।
৬ নবেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্ল¬¬¬¬বে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ নিহত হয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের দল জাসদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। সিপাহীরা ‘গরীবের সন্তান’ বলে ‘ধনীর সন্তান’ অফিসাররা তাদের ওপর নির্যাতন চালান এবং সিপাহী ও অফিসারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা অন্যায়Ñ এ ধরনের বিভেদমূলক স্লোগান তুলেছিল তারা। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। শুরু হয়েছিল অফিসার হত্যার অভিযানও। অনেক নিরীহ অফিসার প্রাণও হারিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে নির্দেশনা এসেছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের বিশেষ তাত্ত্বিক নেতা। তার সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবের আমলে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নেয়া পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহের নিজেকে বঞ্চিত মনে করতেন। তার এ মানসিক বৈকল্যেরই সুযোগ নিয়েছিল ওই দলটিসহ ষড়যন্ত্রকারীরা। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে তারা এমনভাবেই অফিসার হত্যার অভিযান চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো অফিসার থাকতে পারতেন না। আর তাহের নিজে যেহেতু ওই দলটির মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, সেহেতু ধরে নেয়া যায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অফিসারবিহীন হয়ে পড়তো। পরিণতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া কোনো ব্যাপারই হতো না। এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অফিসার শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ গোটা সেনাবাহিনীকেই শত্রু মনে করতো।
ওই ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করেছিলেন সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসাররা। তারাই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন (এ ব্যাপারে কর্নেল তাহেরকে যুক্ত করে একটি বানানো গল্প রয়েছে, তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস যাকে সমর্থন করে না)। জেনারেল জিয়াও বলিষ্ঠতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জনপ্রিয় জেনারেলের এই তৎপরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে দ্রুত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্র বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অনেকের আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল। যেমন একজন সুবেদার মেজর জানিয়েছিলেন, লালমাটিয়ার একটি বাড়িতে কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় তিনি একজন ভারতীয় সেনা অফিসারকে উপস্থিত দেখেছিলেন। এ থেকেই তার মনোভাব পাল্টে গিয়েছিল। তার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরো অনেকেরই। ফলে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও দ্রুত প্রচারিত হয়েছিল যে, অফিসার হত্যার অভিযানের পেছনে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। মূলত এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা ও কারণে জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলেন। সব ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসেছিল শান্তি ও স্থিতিশীলতা। চেইন অব কমান্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বড় কথা, সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করে ফেলা সম্ভব হয়নি। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রকারীরা যদি সফল হতো তাহলে জিয়াউর রহমানসহ শত শত অফিসারকে তখন প্রাণ হারাতে হতো। সশস্ত্র বাহিনীও নির্মূল হয়ে যেতো।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন সরকার ‘বাকশাল’ নামে একটি মাত্র দল রেখে অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী থেকে সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্য বাকশালের সদস্য হওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এ ব্যবস্থায় সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাতারাতি তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। বাকশালেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। দলটির গঠনতন্ত্রে সকল ক্ষমতা এই চেয়ারম্যানের হাতে দেয়া হয়েছিল কিন্তু চেয়ারম্যান কিভাবে নির্বাচিত হবেন তার কোনো উল্লে¬¬খ পর্যন্ত ছিল না। অর্থাৎ শেখ মুজিবকে একই সঙ্গে স্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের আজীবন চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল। তাকে সরানোর বা সরকার পরিবর্তন করার কোনো ব্যবস্থাই বাকশালের গঠনতন্ত্রে রাখা হয়নি। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধরনের স্বৈরশাসন। শেখ মুজিবের তো প্রশ্নই ওঠে না, বাকশাল বা সরকারের বিরুদ্ধেও তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। এই সুযোগে আওয়ামী-বাকশালীরা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সম্ভাব্য বিরোধিতাকারীদের উচ্ছেদের জন্যও একযোগে নিষ্ঠুর অভিযান শুরু হয়েছিল। কোনো হত্যা বা নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তখন প্রতিবাদ জানানোর উপায় ছিল না। সমগ্র জাতি বন্দী হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরের বিপ্লব এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত জেনারেল জিয়াউর রহমান বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরোজা। এর ফলে বাতিল হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো আবারও তৎপরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আওয়ামী লীগকেও ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনাও জিয়ার ঔদার্যেই দেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন (শেখ হাসিনা দেশে এসেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে, জিয়া নিহত হয়েছিলেন ৩০ মে)। জিয়ার এ উদার নীতির সুযোগেই মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ পর্যন্ত বেশ কিছু ইসলামী দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের এই নীতি ও সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার আমলেই প্রথমবারের মতো দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮), সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭৯ সালে। এসবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নবেম্বরের কারণে। ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সফল বিপ্লবই পরিবর্তনের ভিত্তি ও পথ নির্মাণ করেছিল।
সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু আপত্তি ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইতিহাস শেখানোর বিচিত্র অভিযান চালাতে গিয়ে বিশেষ একটি মহল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিন্দিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা এমনকি স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গেও জিয়াকে একাকার করে ফেলতে চাচ্ছেন। তাদের অভিমত, ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ নাকি সংবিধানকে ‘নিম্ন মর্যাদায়’ ঠেলে দিয়ে এরশাদের মতো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন! বিশেষ মহলটি আরও বলেছেন, জিয়ার পথ অনুসরণ করে এরশাদ সংবিধানের ‘ভঙ্গস্তম্ভ’ নিয়ে দেশ চালিয়ে গেছেন। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ ও অভিমত তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই, কিন্তু উল্লে¬¬খযোগ্য বিষয় হলো, মূলত বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য থেকে আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই এরশাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এতদিন পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলসহ এরশাদের যেসব কর্মকা-কে ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে অবৈধ সেসব কর্মকা-কেও আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল। সামরিক শাসনের নয় বছরে (১৯৮২Ñ৯০) নানা কৌশলে এরশাদকে টিকিয়েও রেখেছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানের চাপে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তও শেখ হাসিনা এবং এরশাদ একযোগে কাজ করে চলেছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি এখন আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল। ইতিহাস যারা শেখাতে চাচ্ছেন তারা কিন্তু এসব কথার ধারে-কাছেও যাচ্ছেন না।
অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু জিয়ার সঙ্গে এরশাদকে একাকার করে ফেলার চেষ্টাকে সমর্থন করে না। তাছাড়া জিয়ার বিরুদ্ধে যারা বলছেন তারা আবার একথাও স্বীকার করছেন যে, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। খন্দকার মোশতাক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাৎ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের কোনো রকম প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশাল সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সে বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। জিয়া অবশ্যই সে বিপ্ল¬বের স্রষ্টা ছিলেন না। প্রসঙ্গক্রমে শুরুতে ওই দিনগুলোর সংক্ষেপে বর্ণিত ইতিহাস বিবেচনায় রাখা ও বিশ্লেষণ করা দরকার। দেখা যাবে, জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকেই শুধু রক্ষা ও সমুন্নত করেননি, সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য দরোজা খুলে দেয়ার পাশাপাশি সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যও গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং এমন মন্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় যে, জিয়া ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ’ করেছিলেন। একই কারণে জিয়ার সঙ্গে এরশাদেরও কোনো তুলনা চলতে পারে না। কারণ, জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন ঘটনাক্রমে, অন্যদিকে এরশাদ ছিলেন ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতা দখলকারী। জিয়াকে অনুসরণের বিষয়টিও লক্ষ্য করা দরকার। কারণ, সুদূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে এরশাদ এমনভাবে জিয়ার পদাংক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। সে উদ্দেশ্য অর্জনে এরশাদ অনেকাংশে সফল হয়েছেন বলেই আজকাল এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে, যা পড়ে ও শুনে মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ তথ্যনির্ভর ইতিহাসের পর্যালোচনায় ও সঠিক ব্যাখ্যায় দেখা যাবে, জিয়ার সঙ্গে কোনোদিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলতে পারে না। তা সত্ত্বেও তুলনার আড়ালে জিয়া ও এরশাদকে একাকার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, খন্দকার মোশতাক ছিলেন শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, অন্যদিকে জিয়া সুযোগ পেয়েছিলেন সেনাপ্রধান হিসেবে। মোশতাক ও জিয়াকে যারা একই ‘চক্র’ভুক্ত করছেন তারা কিন্তু একথা বলছেন না যে, জিয়ার আমলে মোশতাককে বছর চারেক কারাভোগ করতে হয়েছিল। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ কথাটা সত্য হলে মোশতাককে নিশ্চয়ই জিয়ার আমলে ‘জেলের ভাত’ খেতে হতো না! ইতিহাস শেখানোর অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা লক্ষ্য করছেন না, দেশে আরো অনেকেও রয়েছেনÑ যারা সঠিক ইতিহাস জানেন, যাদের অনেকে ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষ সাক্ষীও।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, জিয়াউর রহমানকে শুধু ৭ নবেম্বরের জন্য দায়ী করা হয় না। এমন অভিযোগও আনা হয় যেন শেখ মুজিবের হত্যাকা-েও জিয়া প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন! অন্যদিকে ইতিহাসে কিন্তু অমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ঘটনাপ্রবাহে ব্যর্থতা ও দায়দায়িত্বের জন্য আঙুল বরং এমন কারো কারো দিকেই উঠেছে, পরবর্তীকালে যারা ‘মুজিবভক্ত’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ তাদের মধ্যে একজন। এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা এবং শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ২০০৯ সালের আগস্টে নেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত দু’টি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম বলেছেন, সেদিন ভোর পৌনে ছয়টা থেকে ছয়টার মধ্যে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে হামলা হয়েছিল। মাঝখানের এক ঘণ্টার মধ্যে একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে বাসভবন থেকে ‘পালিয়ে যাওয়ার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন! সেনাপ্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’। তাছাড়া হত্যাকা-ের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেতো। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে (২৩ আগস্ট, ২০০৯) শেখ সেলিমের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তিনি নাকি কোনো তথ্যই জানতেন না! কারণ, ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে তার হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেয়া হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি একেবারে ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে পড়েছিলেন! রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং হত্যাকা-ে তার কোনো ‘ব্যর্থতা’ ছিল না। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব তার কাছে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন- এই প্রচারণাকে অসত্য দাবি করে সফিউল্লাহ বলেছেন, রাষ্ট্রপতি নন, তিনিই রাষ্ট্রপতিকে টেলিফোন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছিলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স বোধহয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভবত কামালকে মেরে ফেলেছে। তুমি দ্রুত ফোর্স পাঠাও।’ উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো উত্তর দেননি, টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ পেয়েছিলেন সফিউল্লাহ। তারপর কয়েক মিনিট তিনি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছেন। কিন্তু জবাব পাননি। কিছুক্ষণ পর বেশ কিছু গুলীর শব্দ শুনেছিলেন। শুনে তার ‘মনে হয়েছিল’, রাষ্ট্রপতি হয়তো আর বেঁচে নেই।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর ব্যাপারে সফিউল্লাহ ‘নিশ্চিত খবর’ পেয়েছিলেন সকাল আটটার দিকে। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ তিনি নাকি এরপর ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে ‘আনন্দের আভা’ দেখতে পেয়েছিলেন! ওই সৈন্যরাও নাকি ‘খুনিদের’ সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেখান থেকেই তাকে নাকি ‘চাপাচাপি’ করে রেডিও অফিসে নেয়া হয়েছিল। সেখানে খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং ‘কাজ শেষ হওয়ায়’ বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন (জড়িত না থাকলে ‘অভিনন্দন’ জানানোর, ‘কাজ শেষ’ হওয়ার এবং ‘বিশ্রাম’ নেয়ার প্রশ্ন এসেছিল কিভাবে?)। ‘বিরক্ত’ হয়ে রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও মেজর ডালিম নাকি সফিউল্লাহর ‘পথরোধ’ করেছিলেন। ‘বাধ্য হয়ে’ তাকে নাকি তাহের উদ্দিন ঠাকুরের লিখে দেয়া বক্তব্য ‘পাঠ’ করতে হয়েছিল! ২৪ আগস্ট সফিউল্লাহকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং তিনি ‘বাধ্য হয়ে’ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান। উল্লেখ্য, এরপর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন।
সফিউল্লাহর বক্তব্য থেকে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, সেনাপ্রধান হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ‘অন্ধ ও বধির’Ñ ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে শুধু নয়, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো না থাকার কারণ ছিল ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’, যার কারণে সেনাবাহিনী ঢাল-তলোয়ারবিহীন ‘নিধিরাম সরদারে’ পরিণত হয়েছিল। অন্তরালে ছিল বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটানোর ভয়ংকর পরিকল্পনা। ৭ নবেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব না ঘটলে সেনাবাহিনী আসলেও নির্মূল হয়ে যেতো। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, শেখ সেলিম এবং সফিউল্লাহর মধ্যে কেউই কিন্তু জিয়াউর রহমানকে মুজিব হত্যাকা-ের জন্য দায়ী করেননি।
বলা দরকার, সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কূটিল রাজনীতি করা হয়েছে। দিনটিকে কেন্দ্র করে জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে। এরও সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর দলটি ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’কে বাতিল করেছে। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ৭ নবেম্বরকে আগের সম্মান ফিরিয়ে দিলেও তত্ত্বাবধায়ক নামের মইন-ফখরুদ্দিনদের অসাংবিধানিক সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্তকে কার্যকর করে গেছে। শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের আমলেও ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’কে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হয়েছে। দিনটিকে ক্ষমতাসীনরা বরং আরো একটি হত্যা দিবস হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে সব মিলিয়ে প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। তার এই নীতি-কর্মকা- ও সাফল্যের পেছনে ছিল ৭ নবেম্বরের অনুপ্রেরণা। দিনটিকে তাই যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ ও পালন করা উচিত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads