শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩

সাধারণ মানুষের অসাধারণ কাজ


রাজনৈতিক অঙ্গনের চিত্র দেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের হতাশাবোধ সৃষ্টি করে রেখেছে। বিশেষ করে যে সরকারের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা এবং আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা ও দায়িত্বহীন আচরণ জনগণকে মর্মাহত করেছে। ফলে দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে এখন তারা কুণ্ঠিত। এমন এক পরিস্থিতিতেও যে সাহসী ও মানবদরদী   সাধারণ মানুষ আশাবাদের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে, তেমন চিত্র আমরা লক্ষ্য করলাম মেহেরপুরে।
২০০৯ সালের শুরুতে গ্রিন বাংলাদেশ, সেনাবাহিনী, ইউনিয়ন পরিষদ ও কয়েকটি এনজিও’র তেল উৎপাদনসহ সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসে মেহেরপুরে গড়ে ওঠে ১২০টি পাম বাগান। কিন্তু বছরখানেক পরে কোনো প্রতিষ্ঠানই আর খোঁজ-খবর নেয়নি পাম বাগান কৃষকদের। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দেয় হতাশা ও লোকসানের আশঙ্কা। এই অবস্থায় ডিপ্লোমা কৃষিবিদ সুরুজ শেখ ও হাবিবুর রহমান কৃষকদের চোখের পানি দেখে ভাবেন, কী করে সম্ভাবনাময় এই তরল সোনার মাধ্যমে কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো যায়। এমন চেতনা থেকেই সুরুজ ও হাবিব আরো নয়জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাম বিপ্লবে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানোর ফুরসত পাননি তারা। কৃষকের চোখে পানি দেখে ২০১২ সালে পাম সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহে নেমে পড়েন তারা। সারাদিন বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে পাম গাছের জন্য বিভিন্ন সুষম সার, হরমোন, ট্যাবলেট ও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার সম্পর্কে জানেন তারা। এরপর ফেসবুকে বিভিন্ন পাম বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করেন। তাদের কাছে ডলার পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে তা একটি পাম বাগানে প্রয়োগ করে সুফল পান তাঁরা। এরপর ১১ বন্ধু সাধ্যমতো অর্থ বিনিয়োগ করে গড়ে তোলেন ‘বোটানিকা এগ্রো লিমিটেড’। ইতোমধ্যে তারা মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও খুলনার ১০০ বাগানের মালিকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের বাগানের পরিচর্যা করছেন। এরই মধ্যে ৩৫টি বাগানের ফল পরিপক্ব হয়েছে। এরপর তাদের ভাবতে হয় তেল উৎপাদনের বিষয়ে। মালয়েশিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর সহযোগিতায় দেশি ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ হোসেন ও আবুল হাসানের প্রচেষ্টায় তেল উৎপাদনের মেশিনও তৈরি করে ফেলেন তারা।
বাণিজ্যিকভাবে পাম তেল উৎপাদন ও পাম গাছের সঠিক পরিচর্যা হাতে-কলমে শিখিয়ে হতাশ কৃষকদের মধ্যে আশার আলো সৃষ্টি করলেন দেশের অতি সাধারণ ১১ যুবক। কিন্তু কাজের মাধ্যমে আজ তারা অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। আমাদের বড় বড় রথী-মহারথী, এমনকি সরকারের জন্যও তারা উত্তম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। মানুষের প্রতি দরদ ও অধ্যবসায়ের গুণে তারা সাফল্যের যে পথ রচনা করলেন, সে জন্য আমরা তাদের জাতীয় বীরের সম্মান প্রদান করতে পারি। কারণ যে দেশে বীরের কদর নেই, সেই দেশে বীরের জন্ম হয় না। পাম অভিযাত্রার কাহিনীটির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এনজিওসহ বড় বড় মহারথীরা তো উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলেও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে কৃষকদের মাঠে নামিয়ে সরে পড়লেন। এভাবে কথা ও কাজে গরমিলের কারণে পাম কৃষকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল হতাশা। কিন্তু অতি সাধারণ ১১ দরদী যুবক সততা  ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে কথা ও কাজে মিল রাখার উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। তাদের সাফল্যের রহস্যটা কিন্তু এখানেই নিহিত। দেশের সাধারণ মানুষরা পারলেও আমাদের রথী-মহারথীরা, এমনকি সরকারও কেন কথা ও কাজে মিল রাখতে সমর্থ হচ্ছেন না? এমন ব্যর্থতার কারণেই তো হিংসা-বিদ্বেষ ও সংঘাত-সংঘর্ষের এক অস্বস্তিকর পরিবেশে দিন যাপন করতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদদের উপলব্ধি করতে হবে, আর সবার আগে উপলব্ধি করতে হবে সরকারকে। কারণ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান ও গণ-আকাক্সক্ষা পূরণে তারা ওয়াদাবদ্ধ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads