শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩

মূল ইস্যুটি আস্তিনের নিচে লুকানো আছেঃ সেটি হল সর্বদলীয় বনাম নির্দলীয় সরকার


সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে হতেও সেই সংলাপ হয় না কেন? আপনারা কি মনে করেন যে, বিরোধটি দাওয়াত নিয়ে? এখন কে কাকে ফোন করবে আগে? শেখ হাসিনা আগে খালেদা জিয়াকে ফোন করবেন? নাকি খালেদা জিয়াই আগে হাসিনাকে ফোন করবেন? এটি নিয়েই কি বিরোধ? তর্কের খাতিরে ধরা যাক যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধ রক্ষা করে বেগম খালেদা জিয়া ৬০ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহার করলেন, তাহলেই কি সংলাপ অনুষ্ঠিত হতো? এবং সেই সংলাপ সফল হতো? বিষয়টি এত সহজ সরল নয়। এ কথা সত্য যে, শেখ হাসিনা কর্তৃক খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ৬০ ঘন্টার হরতাল প্রত্যাহার করানো। কিন্তু সেটাই সব নয়। সেটি ছিল নেহায়েত সাময়িক, তাৎক্ষণিক ইস্যু। আসল ইস্যুর কথা বিরোধী দল মুখ ফুটে বললেও সরকারি দল তাদের আস্তিনের নিচে লুকিয়ে রাখা ইস্যুটি প্রকাশ করছে না। প্রকাশ করলেই তাদের সব জারি জুরি ফাঁস হয়ে যাবে। সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে শুনে মনে হচ্ছে যে, সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেয়া যায় যে, দেশী বিদেশী বিভিন্ন চাপে শেখ হাসিনা যদি সংলাপ অনুষ্ঠানে বাধ্যও হন তাহলেও সে সংলাপ সফলতার মুখ দেখবে না। কারণ সংলাপের টেবিলে বসলে দুই নেতাকেই তাদের আসল ইস্যুকে আস্তিনের ভেতর থেকে বের করে এনে টেবিলে প্লেস করতে হবে। তখন দেখা যাবে যে, দুই নেত্রীর দুই ইস্যু দুই মেরুতে অবস্থিত। দুই মেরু হলো সু মেরু- কু মেরু বা উত্তর- দক্ষিণ মেরু। এখন বেগম জিয়ার এজেন্ডা হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। সেটিকে আপনি তত্ত্বাবধায়ক বা যে নামেই ডাকেন না কেন। শেখ হাসিনার এজেন্ডা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন। তবে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান যেহেতু কেউই সমর্থন করবে না, তাই এক দলীয় সরকারের নাম বা সংজ্ঞা পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে সর্বদলীয় সরকার। আসলে এটি আর কিছুই নয়। এটি হলো, যার নাম চাল ভাজা তার নামই মুড়ি ভাজা। অথবা উত্তর বঙ্গের ভাষায়, “ঘুরে মাগুর চ্যাং”। আপনারাই দেখুন, হাসিনার সরকারকে বলা হয় মহাজোট সরকার। মহাজোটে আছে ১৪ দল। ১৪ দলের মধ্যে মাত্র ২ জনকে মন্ত্রী নেয়া হয়েছে। তারা হলেন, এরশাদের পার্টি থেকে তার আপন ভাই জি এম কাদের এবং জাসদ থেকে হাসানুল হক ইনু। এরা সকলেই নামকা ওয়াস্তে মন্ত্রী। এদের মূল কাজ হলো শেখ হাসিনার সারিন্দা বাজানো। কারণ দলপতি জেনারেল এরশাদ তো দিনের পর দিন বলে যাচ্ছেন যে, হাসিনা সরকার তাদেরকে অর্থাৎ এরশাদের পার্টিকে ভাল ভাবে মূল্য দিচ্ছে না। যত গুরুত্বপূর্ণ বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হয় সে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ইনু এবং জি এম কাদেরের সাথে মোটেই আলোচনা করেন না শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তাদের কাউকে কোন পাত্তা দেন না। ফলে এটি হয়েছে একান্তই আওয়ামী লীগের সরকার। শেখ হাসিনার কথা মতো সর্বদলীয় সরকার গঠিত হলে সেটিও হবে আওয়ামী ঘরানার সরকার। কারণ জাতীয় সংসদের তিন শতাধিক আসন হলো আওয়ামী লীগের । অবশিষ্ট দু চারটি সংরক্ষিত মহিলা আসন জাপার। শেখ হাসিনার কথা মতো জাতীয় সরকার গঠিত হলেও সেখানে জাতীয় পার্টি এবং খুচরা বামপন্থী দলগুলোর কোন কথা খাটবে না। সুতরাং ঘুরে ফিরে ওটা সর্বদলীয় নামে এক দলীয় সরকারই হবে।
॥দুই॥
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জোটের সম্প্রসারণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলের কলেবর বৃদ্ধির জন্য জোটের বাইরের সমমনা দলগুলোর সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিপিবি এবং বাসদের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তাৎক্ষণিক কোন ফল হয়েছে কিনা সেটি জানা যায় নাই। এই বৈঠকের পর সিপিবির প্রেসিডেন্ট মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জমান সহ অন্য নেতারা ‘চ্যানেল ২৪’ এবং ‘ইনডিপেন্টেড’ টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অন্য এক খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদীয়মান তৃতীয় শক্তি বলে পরিচিত নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। জানা গেছে যে, গত সোমবার মন্ত্রী সভার বৈঠকের পর শেখ হাসিনা তৃতীয় শক্তির নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলার জন্য দুই জন আওয়ামী নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ড. কামাল হোসেন এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত দেশের বাইরে ছিলেন। তাই শেখ হাসিনার প্রতিনিধি কামাল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। ঐ জোটের অপর নেতা ড. বি চৌধুরী এমন কিছু করতে চাচ্ছেন না যার ফলে দীর্ঘ দিন ধরে বিএনপির সাথে মেরামত করা সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলতে চান না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে আগ্রহী নন। তবে তাকে নিতে না পারলে ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকেও দলে ভেড়ানো যাবে না। মাহমুদুর রহমান মান্না ‘ওয়েট এন্ড সি’ করছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ সমঝোতা না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আ স ম আব্দুর রব সরকার বিরোধী কঠোর বক্তব্য দিতেই থাকবেন। এমন পরিস্থিতিতে এসব নেতার সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে এই ধরনের চিন্তাধারা বিরাজ করছে যে যদি বর্তমানে বিরাজমান ১৪ দল, সিপিবি, বাসদ এবং আলোচ্য ৫ নেতার অনুসারীদেরকে নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠন করতে পারেন তাহলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়েই তারা আসন্ন নির্বাচনকে অর্থবহ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সম্ভবত নির্বাচন বানচাল করতে পারবে না। এ ছাড়া মার্কিন- ভারত অক্ষ শক্তিকেও তিনি বোঝাতে পারবেন যে, নির্বাচনে সব শ্রেণীর জনমতের প্রতিনিধিত্ব ঘটেছে। এ ছাড়া পেশী শক্তির জোরে আওয়ামী লীগ  বিএনপিকে সহজেই পরাস্ত করতে পারবে। সে জন্যই আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চায়।
পক্ষান্তরে ১৮ দলের সামনে প্রধান এবং এক মাত্র ইস্যু হলো নির্বাচন কালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন। এত দিন পর্যন্ত আওয়ামী সরকার ১৮ দলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। আন্দোলন গড়ে তোলার ‘মুরোদ’ ১৮ দলের আছে কিনা সেটি নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু বিগত ৬০ ঘন্টার সফল হরতাল সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছে যে, জনগণ বিপুল ভাবে বিরোধী দলের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ঢাকা ছাড়া মফস্বলের প্রায় সবকটি জেলায় এখন বিরোধী দলের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। জনগণ আওয়ামী লীগের ওপর এতই ক্ষুব্ধ যে কয়েকটি মারমুখী ঘটনায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এখন যদি পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির প্রটেকশন না থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্দোলনের নামে রাস্তায় নামা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ডেইলি স্টারের খবরে প্রকাশ চলতি সালের অক্টোবর পর্যন্ত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির গুলী এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় এ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ এবং বিএনপি ও জামায়াত কর্মী সহ মোট ২৫৯ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। রাজনীতির অমোঘ সত্য এই যে, কোন রক্তপাতই কোনদিন বৃথা যায় না। এই ২৫৯ জন মানুষের রক্তও বৃথা যাবে না। এই রক্তের ওপর গড়ে উঠেছে বিরোধী দলের ন্যায্য আন্দোলন। এই আন্দোলন বৃৃথা যেতে পারে না।
॥তিন॥
এর আলামত ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের ছোট বড় সব ধরনের নেতা এত দিন বিএনপিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে। গত ২৭ থেকে ২৯ শে অক্টোবর- এই ৬০ ঘণ্টার সর্বাত্মক সফল হরতালে জনগণ স্পষ্ট ভাষায় হাসিনা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে যে, এই সরকারকে তারা আর ক্ষমতায় দেখতে চান না। এই সরকার যত তাড়াতাড়ি জনগণের ঘাড়ের ওপর থেকে নেমে যায় ততই জনগণের মঙ্গল। কিন্তু নেমে যাওয়া তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ঘাড়ে আরও বেশী করে জাঁকিয়ে বসতে চাচ্ছে। তাই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের পক্ষে রাজপথ ছাড়ার কোন উপায় নাই। সে জন্য ১৮ দল আবার ৬০ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে। আগামী কাল সোমবার সকাল ৬ টা থেকে বুধবার সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ ব্যাপী ৬০ ঘন্টার সকাল সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বিগত হরতালের মতোই এই হরতালও সর্বাঙ্গীন সফলতা অর্জন করবে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার এখন হয়ে উঠেছে রক্ত পিপাসু সরকার। বিগত হরতালে তারা জনগণের মধ্যে থেকে ২৭টি প্রাণ সংহার করেছে। এই হরতালেও তারা অনেক মায়ের কোল খালি করবে। মানুষের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আমাদের হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু এই জালিম সরকার জনগণের জন্য আর কোন পথ খোলা রাখেনি। আওয়ামী সরকারের পায়ের তলায় কোন মাটি নাই। এটি শুধু আমাদের কথা নয়। সর্বশেষ জনমত জরীপেও এই কথাটি বেরিয়ে এসেছে। জনমত জরীপ পরিচালনা করেছে যৌথ ভাবে এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং ইংরেজী ডেইলি স্টার। এই জরীপে দেখা যায় যে, এখন যদি নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগ পাবে ২৮ শতাংশ ভোট এবং বিএনপি পাবে ৫৫ শতাংশ ভোট। অন্যেরা পাবে ৫ শতাংশ ভোট। আর ১২ শতাংশ ভোটার কোন মতামত দেননি। ঐ জরীপে আছে পল্লীগ্রামে, শহরাঞ্চলে, পুরুষ, মহিলা এবং যুব সমাজের কত শতাংশ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে, আর কত শতাংশ বিএনপিকে ভোট দেবে। এই ৫টি ক্যাটাগরীতে আওয়ামী লীগ পাবে গড়ে ২৭.৪ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পাবে গড়ে ৫৪.৪ শতাংশ ভোট।
দেয়ালের লিখন খুব স্পষ্ট। এখনও সময় আছে, আওয়ামী লীগ দেয়ালের লিখন পড়–ক এবং জনগণের ঘাড় থেকে নেমে যাক। সেটি করলে জনগণও বেঁচে যাবেন আর আওয়ামী লীগও বেঁচে যাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads