রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

প্রসঙ্গ : ৫ বছরে আওয়ামী মামলার খড়গ


সাংবিধানিক অধিকার থেকে মানুষকে জবরদস্তিমূলক বঞ্চিত করা হলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। দেশ পরিচালনাকারী ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যদি মানবাধিকারকে বর্বর কায়দায় পদদলিত করেন তাহলে হয়তো তারাও একদিন একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে আইনের রক্ষকের পরিবর্তে ভক্ষকের কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সব ধরনের অপরাধ বেড়ে ওঠার কারণ পুলিশের এসব জঘন্য কাজ। এ রকম চলতে থাকলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এটা কারও জানা নেই। পুলিশের নৃশংসতা, বিতর্কিত কর্মকান্ড, বাড়াবাড়ি এবং বেপরোয়া আচরণের বিষয়টি এখন আর আলোচনা-সমালোচনার পর্যায়ে নেই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িযেছে। অতি উৎসাহ প্রদর্শন, পৈশাচিক নির্যাতন-নিপীড়িন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও আইনবহির্ভূত কর্মকান্ড নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও বিব্রত। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তদন্ত কমিটি ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করছে। বিচার বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে। তবে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন জনসাধারণের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আওয়ামী-মাহজোট সমর্থকদের পৈশাচিকতা এবং বর্বরতা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী, ক্যাডারদের নৃশংসতাকে হার মানাচ্ছেন কোনো কোনো পোশাকধারী কর্মকর্তা। মহাজোটের সাবেক দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের সমাবেশে ঘটেছে এসব বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে। তারা আইন-কানুন, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, সভ্যতা-ভব্যতা সবকিছুকে পদদলিত করে চলেছেন বেপরোয়াভাবে।
মিছিলের মতো সাধারণ রাজনীতি চর্চার অপরাধে প্রকাশ্যে বুকের ওপর বুট দিয়ে দলিত করা ও বিনা উস্কানিতে নির্মম প্রহার করে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের গুরুতর আহত করা হচ্ছে। সংবাদপত্রের  সম্পাদক ও রাজনৈতিক নেতাদের আটক করে ডান্ডাবেড়ি ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নাজেহাল করা হচ্ছে।
৫ বছরে ধরপাকড়, টিয়ারসেল ও জলকামানের পানি নিক্ষেপসহ পুলিশ-র‌্যাবের বাধায় পূর্বঘোষিত বেশ কয়েকটি গণমিছিল করতে পারেনি বিরোধী দল। এখনো চলছে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের বাসায় বাসায় গ্রেফতার অভিযান। রণসাজে সজ্জিত পুলিশ ও র‌্যাব যাকে সুযোগে পাচ্ছে শিকলের ভিতর প্রেরণ করছে।
নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে জলকামান, এপিসি ও র‌্যাব-পুলিশের গাড়ির হুইসেল রীতিমত ঘটনা। প্রতিদিন লক্ষ করা যায় বিজয়নগর ও ফকিরাপুল সড়কের লোকজনদের মুখমন্ডল ‘আতঙ্কে ঢাকা’। অলিগলি ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের যুদ্ধংদেহী অবস্থান।
কোন হরতাল আহবান করলেই হরতালের আগে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। বিরোধী জোটের হরতালকে ঘিরে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে মাঠে নামে। হরতালের দু’দিন আগ থেকেই বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে বিরোধী নেতা-কর্মীদের আটক করে। রাজনৈতিকদের বিভিণœ মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়। বিনা ওয়ারেন্টে আটক করেই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারকৃতদেরকে আদালতে পাঠিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা নির্দিষ্ট করে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হয় কারাগারে।
হরতালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এমন নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের গতিবিধি দু’দিন আগ থেকেই পর্যবেক্ষণ শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তালিকা নিয়ে তাদের বাসাবাড়িতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা দফায় দফায় হানা দেয়। সড়কগুলোতে সন্দেহজনক যানবাহনে তল্লাশি চালানো হয়। নেতা-কর্মীদের খোঁজ করার নাম করে অনেকের বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে ঘরের লোকজনকে হুমকি এবং মালামাল তছনছ করা হচ্ছে। কোনো অভিযোগ না থাকার পরও পুলিশ বিনা কারণে নেতাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছে।
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি এখন সীমান্ত ছেড়ে কাজ করছে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে। নেমেছে কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর ভূমিকায়। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের নামে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর চালাচ্ছে নির্বিচার গুলী। বিজিবির গুলীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। গুলীবিদ্ধ হয়েছে অনেকে।
বিজিবি (সাবেক বিডিআর) বীরত্ব ও ঐতিহ্যের গৌরবম-িত এক সুশৃঙ্খল আধাসামরিক বাহিনী। প্রায় ২২০ বছরের ঐতিহ্য তাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসেনানী ছিল এই বাহিনী। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৮১৭ জওয়ান শহীদ হওয়ার মাধ্যমে এ বাহিনী অপরিসীম বীরত্ব দেখিয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ ৯ জনের মধ্যে দু’জনই এ বাহিনীর। এই বাহিনীর শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। এছাড়া ৮ জন ‘বীর উত্তম’, ৩২ জন ‘বীর বিক্রম’ ও ৭৮ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ঐতিহ্য আর গৌরবের সুষমাম-িত এই বাহিনীর কাজ কি?
বিজিবির কাজ বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী ও শিশু এবং মাদক পাচার-আমদানি প্রতিরোধে ‘অতন্দ্র প্রহরী’র দায়িত্ব পালন করা। পাশাপাশি প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করা। কিন্তু বিজিবি এখন কি করছে? তাদের নিক্রিয়তায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন বিশ্বের সবচেয়ে রক্তঝরা ভয়ঙ্কর সীমান্তে। প্রতিনিয়ত সেখানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী ফোর্স-বিএসএফ নির্বিচারে গুলী চালিয়ে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে। পিটিয়ে, পানিতে চুবিয়ে, পাথর নিক্ষেপ করে, গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েও মানুষ হত্যা করছে তারা। ঘরে ঢুকে নির্যাতন করছে। বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রবেশ করে নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে বিএসএফ। অথচ তাদের মোকাবিলায় নিষক্রিয় বিজিবি।
সীমান্ত ছেড়ে ‘অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা’ নিয়ন্ত্রণের নামে সারাদেশের জেলা-উপজেলায় কত সংখ্যক বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে তার প্রকৃত পরিসংখ্যান নেই। তবে রাজধানীসহ সারাদেশেই বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। অস্ত্রহাতে টহল দিচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তাদের উপস্থিতি বেশি দেখা যাচ্ছে।
মহাজোটের পুরো ৫ বছর টেন্ডারবাজিতে বেপরোয়া রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী দুই সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় টেন্ডার নিয়ে চলছে তাদের হিংস্রতা। সংগঠন দুটির নেতা-কর্মীরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ। কখনো দুই সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ, কখনো বা অভ্যন্তরীণ গ্রুপের মধ্যে লড়াই। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যেখানেই টেন্ডার, সেখানেই হাজির যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। সরকারের তরফ থেকেও দলীয় এই সন্ত্রাসীদের দমনের কোনো পদক্ষেপ নেই।
শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পিডব্লিউডি, ওয়াসা, পূর্ত, খাদ্য বিভাগসহ দেশের প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানই যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দখলে। অবশ্য, সরকারের পালাবদলে এ চিত্রও পাল্টে যায়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো শীর্ষ পর্যায়ের আশকারায় টেন্ডার সন্ত্রাসে মেতে ওঠে। বিএনপি আমলে যুবদল ও ছাত্রদল একই ভূমিকায় ছিল। তবে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। অনেক সন্ত্রাসীও এখন এ সংগঠন দুটোর নেতা। বিশেষ করে যুবলীগে অর্থের বিনিময়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা ঘাঁটি গেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
টেন্ডারবাজি নিয়ে একের পর এক লাশ পড়ছে। কিছু ঘটনায় পুলিশ খুনিদের  গ্রেফতার করেছে। দলও লোক দেখানো বহিষ্কার করেছে। কিন্তু যুবলীগ-ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি বন্ধ হয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেন্ডারের দখল নিতে দুই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সারাদেশে মরিয়া হয়ে ওঠেন। প্রয়োজনে গুলি আর বোমা খরচ করে টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নেন। সরকারের ৫ বছর ধরেই চলেছে এ পরিস্থিতি। এখন ‘আখেরি ধান্ধায়’ নিজেরা খুনোখুনি করছেন।
টেন্ডারবাজিতে যুবলীগ-ছাত্রলীগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাঢ়াটিয়া হিসেবেই কাজ করে। মূল টেন্ডার নেতা-কর্মীরা নেন না। তারা মূলত কোনো বিশেষ পার্টিকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার কন্ট্রাক্ট নিয়ে টেন্ডার আহ্বানকারী প্রতিষ্ঠানে মাস্তানি ও সহিংসতার আশ্রয় নেয়। এ কাজের জন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকা পায়।
টেন্ডার নিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বন্দুকযুদ্ধে বহুসংখ্যক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের টেন্ডারবাজির নির্মম শিকার হয় শিশু আরমান ও যুবলীগ কর্মী সাজু। চট্টগ্রামে রেলওয়ের টেন্ডার জমাদান নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় এরা নিহত হয়। ২৪ জুন ২০১৩ বেলা পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের রেলভবনের সামনে সিআরবি এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। নিহতরা হলো যুবলীগ কর্মী সাজু (২৮) এবং শিশু মোঃ আরমান হোসেন (৮)। কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর গ্রুপ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সাইফুল ইসলাম লিমন গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
সংঘর্ষ-সংঘাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বহিষ্কার ও গ্রেফতারের ঘটনাগুলো একেবারেই লোক দেখানো। কয়েকদিন পরেই তারা ছাড়া পেয়ে যান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফের পদও জুটে যায়। সে কারণে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কমিটিতে সবসময়ই সন্ত্রাসী-মাস্তান ও ক্যাডারদের আধিপত্য বহাল থাকে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই এ দুই সংগঠন টেন্ডার নিয়ে সহিংস হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত টেন্ডার বাক্স ছিনতাই, সশস্ত্র মহড়াসহ সংঘর্ষের দুই শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবসায়ীরাও তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সরকারের মেয়াদের শুরুতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের মধ্যে তুমুল সহিংসতায় লিপ্ত হয় ছাত্রলীগ। সংগঠনটির কার্যক্রম স্থগিত করারও দাবি ওঠে। একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, সরকারের মেয়াদের প্রথম ১৭ মাসে শুধু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনাই ছিল ১৫৮টি। তখন বেশির ভাগ সহিংস ঘটনা অবশ্য নিজেদের মধ্যে ঘটেছে। তাদের হাতে ওই সময়ে নয়জন নিহত ও এক হাজার ৯৪৭ জন আহত হন। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২৪১ জনকে আটক করা হয়। তখন সারাদেশে মামলা হয় ২১৪ জনের নামে। আর সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় ২৬৪ জনকে। তাদের কারণে ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সে সময় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঢাকায় কয়েক মাস আগে বিশ্বজিৎ নামে এক নিরীহ যুবককে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।
দেশের অধিকাংশ সরকারি ও বেশকিছু বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশের নেপথ্যে ছাত্রলীগ। তাদের হাতে শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। আবার ছাত্রছাত্রীদের মারধর করে সার্টিফিকেট আটকে ভর্তিবাণিজ্য নিশ্চিত করা হয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজে বাধা দেওয়া, থানায় ঢুকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া, ওসিকে লাঞ্ছিত করা, বিলবোর্ড বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তারে অস্ত্রের মহড়া, সংঘর্ষ-মারামারিসহ নেতিবাচক নানা কর্মকা-ে জড়িত যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
সারাদেশে যেসব দফতরের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, সার্বক্ষণিক লেগে থাকছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। অধিকাংশ জায়গায় ভাগবাটোয়ারা ঠিকঠাক মতো হয়ে যাওয়ায় বিবাদ প্রকাশিত হয় না। স্বার্থের বরখেলাফ হলেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। দফারফা না হওয়ায় চট্টগ্রামে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে।
ছাত্রলীগ থেকে বিতাড়িত বা অবসর নেয়া অনেক নেতার যুবলীগ বা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে পুনর্বাসিত হওয়া নিয়েও সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার শিক্ষাভবন নিয়ন্ত্রণ করছেন ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত এক নেতা। তিনি পরে যুবলীগে একটি পদ পান। শিক্ষাভবন-সচিবালয়-সেগুনবাগিচা এলাকায় ব্যাপক পোস্টারিং করে নিজের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের বিষয়টি জানান দেন। এর পর থেকে শিক্ষাভবন, বিদ্যুৎভবন, পিডব্লিউডি, খাদ্যভবন এলাকায় তার আধিপত্য বেড়ে গেছে।
আওয়ামী-মহাজোটের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত না হলেও ২০১৩ সালের মধ্যভাগে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসী লাইভ দেখেছিল বিএনপি মহাসচিবসহ দলের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কিভাবে নেতাদের আটক করা হয়। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে যুদ্ধংদেহী অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়েছিল ১৫১ বিএনপি নেতাকে। তাদের অধিকাংশকে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলে পায়ে ডা-াবেড়ি পরিয়ে আটক করে রাখা হয়। এ অবস্থায় তাদের আদালতেও নেয়া হয়।
উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি মিলছে না। মুক্তি পাওয়ামাত্রই জেলগেটে তাদের অন্য মামলায় শ্যোন এরেষ্ট দেখানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যাচ্ছে, সাদা পোশাকের পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, কি মামলায় কোথায় নেয়া হচ্ছে তাও জানা যায় পরে। মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও শুধুমাত্র পুলিশের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত ঢালাওভাবে আসামিকে কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দিচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম ও প্রচার সম্পাদক এবং সাপ্তাহিক সোনার বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অধ্যাপক তাসনীম আলমকে দুর্ধর্ষ অপরাধীর মতো ডান্ডাবেড়ি এবং হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। এমনকি কারাগারে তাদের রাখা হয়েছে দুর্ধর্ষ অপরাধীর মতো।
বিরোধী দলের নেতাদের এমন করে হ্যান্ডকাপ ও ডান্ডাবেরি পরানোর যে নতুন সংস্কৃতি চালু করা হলো এর পরিণাম ভালো নয়। অতীতে এমন করে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা সামাজিক ব্যক্তির চরিত্র হনন করা হয়নি। ডান্ডাবেড়ি ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করছে পুলিশ। কারাগার থেকে আদালতে হাজির করার সময়ে তাদের ডান্ডাবেড়ি ও হ্যান্ডকাফ পরিয়েছে পুলিশ। জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের পরই তাদের সঙ্গে পুলিশ দুর্ব্যবহার শুরু করে। কারাগারেও তাদের সঙ্গে দুর্ধর্ষ অপরাধী কিংবা সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি এ দুই নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই পুলিশ তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করেছে। আটকের পরই তাদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। এমনকি সাধারণ ছিঁচকে অপরাধীর মতো পুলিশ ওই দুই নেতার নাম লেখা স্টিকার বুকে সেঁটে দিয়ে পুলিশের জনসংযোগ বিভাগ থেকে ছবি তুলে দ্রুত তা মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।
৫ জানুয়ারী ২০১৩ জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে নারী অধিকার আন্দোলন এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কার্যালয় থেকে ২০ জনকে গ্রেফতারের পর অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে বেলা আড়াইটায় এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ বৈঠককে কেন্দ্র করে দুপুর থেকেই বিপুল সংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ, মহিলা র‌্যাব ও পুলিশ প্রেস ক্লাবের প্রবেশের পথে অবস্থান নেয়। বৈঠকের নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে বেশ কিছু নারী অধিকার কর্মী প্রবেশ করতে পারলেও সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক চেমন আরা, সহ-সভাপতি মমতাজ মান্নান, যুগ্ম-সম্পাদক নুরজাহান বেগম, অধ্যাপক জোসনা ইদ্রিসসহ ৭ জনকে আটক করে। পরে বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় নেতা-কর্মীরা বের হওয়ার পথে আরও ৫ নারী কর্মীকে টেনেহেঁচড়ে আটক করে পুলিশ। এ সময় এক কোলের শিশুকেও তার মায়ের সাথে নিয়ে যাওয়া হয়।
কোনো নাগরিককে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া শুধু সন্দেহবশত ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেফতার করা যায় না। ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা ও জামায়াতে ইসলামীর মহিলা কর্মীদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্রী সংস্থা কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। একটি ঘরে বসে তারা সংগঠনের বৈঠক করতে পারেন, কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই যদি পুলিশ দিয়ে তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসে, তা গণতান্ত্রিক চর্চার সমর্থক নয়।
মানহানি ও সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা দেবাশীষ বিশ্বাসের দায়েরকৃত মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হারুন অর রশিদ এর আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল। ১৩ মে ২০১৩ হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসাইনের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে এ মামলায় তিনি দু’সপ্তাহের জামিন পান। ওই জামিনের মেয়াদ শেষ হলে তিনি এ আদালতে ফের জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করেন। সাধারণত উচ্চ আদালত থেকে কেউ জামিনে থাকলে উচ্চ আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে জামিনের সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়। কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেট এম কে আনোয়ার ৮১ বছরের বয়োবৃদ্ধ হলেও জামিনের আবেদন সরাসরি নাকচ করে দেন। তিনি দীর্ঘকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিএনপির বিগত দুই মেয়াদেই ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন। একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানেও তিনি সংসদ সদস্য। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে জামিন পাওয়ার বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ করেন তিনি। এছাড়া বয়স্ক এবং অসুস্থ এই দুই বিবেচনাতেও জামিন পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে এবং উচ্চ আদালতের রায়ে জামিনের নির্দেশনা রয়েছে। কিšুÍ ম্যাজিষ্ট্রেট কোনো বিবেচনাতেই এম কে আনোয়ারের জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করেননি। পরে অবশ্য সকল কারাবন্দী এমপিদের সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে দিতে স্পীকারের আহবানের পরে সকল কারাবন্দীদের সাথে   এম কে আনোয়ারও জামিনে মুক্তি পান।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ শীর্ষ নেতাদের জামিনের আবেদনও ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত থেকে নাকচ হয়েছে। ইদানীং বিরোধী দলের নেতাদের জামিনের আবেদন ঢালাওভাবে নাকচ হচ্ছে। পাশাপাশি রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রেও যথাযথ নির্দেশনা অনুসরণ করছে না নিম্ন আদালত।
                                                এর আগে ১৫১ জন নেতা-কর্মী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে জামিনের আবেদন করলেও একজনের ক্ষেত্রেও জামিন মেলেনি। এসব জামিনের আদেশে ম্যাজিষ্ট্রেটের বিচারিক পর্যালোচনায় ত্রুটি রয়েছে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, কোনো মামলায় সব আসামি সমান অপরাধী নয়। অনেকের বিরুদ্ধে অপরাধের তেমন উপাদান নেই, শুধুমাত্র এজাহারে নাম রয়েছে এই বিবেচনায় জামিন নাকচ হতে পারে না।
৫ মে হেফাজত ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির দিন পল্টন-মতিঝিল এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় পরদিন রাতে ১৬টি মামলা দেয় পুলিশ। এসব মামলার একেকটিতে আসামি হিসেবে নিম্নে ৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ২৪৭ জনকে আসামি করা হয়। হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নেতা, বিএনপি, জামায়াত ও দল দুটির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন নেতাকেও আসামি করা হয়। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ শাহজাহানকে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ২৪৭ জন আসামির মধ্যে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী সোহেল, সাধারণ সম্পাদক সরাফত আলী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম, বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দীন (টুকু), ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়াসহ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২০ জন নেতাকে আসামি করা হয়।
আর জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, রফিকুল ইসলাম, শফিকুল ইসলামসহ (মাসুদ) জামায়াত-শিবিরের ৪৬ জন নেতাকে আসামি করা হয়।
যুবদল সভাপতি এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ৮ মে ২০১৩ মুক্তি পেলে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এমন তথ্যের ভিত্তিতেই তাকে আবার গ্রেফতার-দাবি করে পুলিশ। জামিনে মুক্তির পর কারাগারের গেট থেকেই আবার গ্রেফতার করা হয়। ওইদিন রাত পৌনে ১১ টার দিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাকে গ্রেফতার করে মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এর আগে রাত ১০টার দিকে কাশিমপুর পার্ট-১ কারাগার  থেকে তিনি জামিনে মুক্তি পান। শেষ পর্যন্ত নতুন কোন মামলায় গ্রেফতার না দেখানোর উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রেক্ষিতে তিনি মুক্তি পান।
কোনো মামলা ছাড়াই ১৫ মে ২০১৩ নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বের হবার পর বরকত উল্লাহ বুলু এমপিকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাকে মামলায় জড়ানো হয়। কিছুদিন আগেই কারামুক্ত হবার পর তিনি ফের  গ্রেফতার হন। পরে এমপি হিসেবে সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে জামিন পান।
১৬ মে ২০১৩ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক  থেকে পনরায় গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। জামিন পাওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হওয়ার পর সাদা পোশাকের গোয়েন্দা সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে। এরপর শেরেবাংলানগর ও তেজগাঁও থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এর আগে ৮ এপ্রিল বিএনপি নেতা মোর্শেদ খানের গুলশানের বাসা থেকে বের হওয়ার পর সালাউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করেছিলেন সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা। পরে ১ এপ্রিল রাজধানীর পল্টন থানায় দায়ের করা গাড়ি পোড়ানো ও ককটেল বিস্ফোরণের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ওই মামলায় জামিন লাভের পর ১৬ মে দুপুরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সালাউদ্দিন আহমেদ। শেষ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া অন্য কোন মামলায় গ্রেফতার না দেখানোর উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং গ্রেফতার দেখানো মামলায় জামিন নিয়ে তিনি কারা মুক্ত হয়েছিলেন।
বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে রাজধানীর পল্টন থানায় দায়েরকৃত মামলায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে ১৬ মে ২০১৩ ছয় মাসের জামিন দেয় হাইকোর্ট। পরে তিনজনকেই ফের কারাফটক থেকে আটক করে পুলিশ। পরে অবশ্য তারা উচ্চ আদালতের কঠোর আদেশে জামিন লাভ করেন।
১৮ মে ২০১৩ গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে বিএনপির ৫৩ জন নেতা-কর্মী জামিনে বেরিয়ে আসার পর পুলিশ পুনরায় তাদের আটক করে। বিএনপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি মামলা দিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি, প্রফেসর আবু তাহের, বিল্লাল হোসেন, মোঃ বশিরুল হক, মেহেদী হাসান, মোঃ শাহজাহান, তোজাম্মেল হক, কাশেম মজুমদার, আশরাফুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান, আবদুল কাদির জিলানী, আজগর আলী, এশাখুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন, ইমরুল কায়েস, জিয়াউল হক, জুলফিকার আলী ভূঁইয়া, আসাদুজ্জামান, আনোয়ার হোসেন, জুয়েল ও ওমর ফারুক । এরমধ্যে যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ৭৮টি মামলা দেয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও রাজশাহী মহানগর আমীর আমীর আতাউর রহমান ১৬ জুন ২০১৩ জামিন মুক্তি পেয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হলে কারাফটক থেকে আবারো গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শ্যামলী থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জামিনে মুক্তির পর ৬ আগস্ট ২০১৩ তাকে ফের গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। জেলখানা ঘাটে মিছিল করা, রিকশা ভাঙচুর, পুলিশের ওপর হামলা করে তিন পুলিশ সদস্যকে আহতের ঘটনায় তাকে পুলিশ পুনরায় হয়রানিমূলক গ্রেফতার করে।
খুলনা সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলী আকবর বাদী হয়ে খুলনা মহানগর জামায়াতের আমীর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সাইদুর রহমানসহ ১৪ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেন।  জেলগেট থেকে আটক করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আতহার উদ্দিন ও কলেজ ছাত্র ইব্রাহিমকেও উক্ত মামলায়  গ্রেফতার দেখানো হয়। অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনা সদর থানার ২০১০ সালের দ্রুত বিচার আইনে ও পুলিশের কাজে বাধাদানের মামলায় জামিন লাভ করেন। এরপর তাকে খুলনা সদর থানায় মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে এই মামলায়ও তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করেন। পরবর্তীতে তাকে সোনাডাঙ্গা মডেল থানার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এ মামলায়ও  তিনি ৮ জুলাই হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করেন। ৬ আগস্ট তিনি খুলনা জেলা কারাগার থেকে দুপুরে বের হবার সাথে সাথে কারাগারের প্রধান ফটকের ভেতর থেকে তাকে গোয়েন্দা পুলিশের জিপে করে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১২ সালের ১২ নবেম্বর সন্ধ্যার পর ঢাকা মহানগর  গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ  রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ারকে গ্রেফতার করে। ওইদিন রাজধানীর পল্টনে ছিল ১৮ দলীয় জোটের গণমিছিল। মিছিল পূর্ব সমাবেশে মিয়া গোলাম পরওয়ার উপস্থিত ছিলেন। এরপর তিনি গণমিছিলে অংশ  নেন। মিছিল শেষে সন্ধ্যার পর গুলশান এলাকায় যান। সেখান থেকেই ডিবি পুলিশের উত্তর বিভাগ তাকে গ্রেফতার করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়।
৫ বার জামিন পেয়েও কারামুক্তি পাননি ডেমরার ডগাইর দারুচ্ছুন্নাত ফাজিল মাদরাসার আরবি প্রভাষক মাওলানা আবু হানিফ। বিনা কারণে গ্রেফতার হওয়ার ৭ মাসের মধ্যে আদালত থেকে ৫ বার জামিন পেলেও যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ তাকে জেলগেট থেকে প্রতিবারই গ্রেফতার করে। নবজাতক সন্তানের মুখও তিনি দেখতে পাননি। এবারের ঈদ-উল-ফিতরও কাটে থানা হাজতের চার দেয়ালের মধ্যেই। ডায়াবেটিক, বাতজ্বর ও ঠান্ডাজনিত রোগসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত আবু হানিফ দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় তার পরিবার পড়েছে মহাসংকটে। তার একটি স্টেশনারী কাম লাইব্রেরী ব্যবসা রয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ জামায়াতে ইসলামী আহূত হরতালের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় তার ডগাইর বাজারের দোকান থেকে তাকে ডেমরা থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। পরের দিন ৫ ফেব্রুয়ারি  তার বিরুদ্ধে ডেমরা বাঁশের পুলে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে আদালতে পাঠায়। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেল-হাজতে পাঠায়। প্রায় দীর্ঘ দু’মাস পর এপ্রিল মাসে আদালত থেকে জামিন দিলে কাশিমপুর কারাগারের গেট থেকে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ তাকে আবার গ্রেফতার করে দু’টি মামলা দেয়। এর পর মে মাসে আবার জামিন পেলে আবারও কাশিমপুর কারাগার থেকে তাকে আটক করে তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানার অন্য একটি মামলায় আবার গ্রেফতার দেখানো হয়। এর পর জুন মাসে আবার জামিন লাভ করলে ঢাকা  কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে আবারও গ্রেফতার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। রমযান মাসে দু’বার তিনি আদালত থেকে জামিন লাভ করলে দু’বারই তাকে ঢাকা কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ তিনি ৭ আগস্ট আদালত থেকে জামিন লাভ করলে ঈদের দিন বিকেল পাঁচটায় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করলে আবার যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। ঈদের দিন থেকে তাকে থানা হাজতেই আটক রাখে পুলিশ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads