শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৩

এক দলীয় নির্বাচনের পথে আঃ লীগঃ বিরোধী নেতৃবৃন্দের ব্যাপক ধরপাকড়


বাংলাদেশ অবশেষে সত্যি সত্যি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হলো। মুসোলিনী এবং হিটলার যে কায়দায় ইটালী এবং জার্মানী শাসন করেছিলেন, স্বৈর শাসনের যে জগদ্দল পাথর এসব রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে বসেছিল, সেই একই কায়দায় দেশ শাসন করছেন শেখ হাসিনা। একই ধরনের জগদ্দল পাথর আজ চেপে বসেছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বুকের ওপর। তা না হলে এক দিকে সরকার যেখানে সংলাপের মূলা ঝুলিয়ে রাখেন, অন্যদিকে তেমনি সারা দেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ধরপাকড়ের অভিযান চলে কিভাবে ?
গত শুক্রবার বিকেল থেকেই বাসায় বেশ কয়েকজন মেহমান এসেছিলেন। সে কারণে টেলিভিশন খোলা হয়নি। এর মধ্যেই আমার এক ভাগ্নি টেলিফোনে জানালো সেই সংবাদ। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং জনাব এম কে আনোয়ার কিছুক্ষণ আগে অর্থাৎ রাত সাড়ে ৮ টার দিকে গ্রেফতার হয়েছেন। টেলিফোনে খবরটি শোনার সাথে সাথে টেলিভিশন খুললাম এবং দেখলাম যে খবরটি সত্যি। নিজের চোখ এবং কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রাত ১০ টার এবং ১১ টার খবর শুনলাম। আরও হতভম্ব হয়ে গেলাম। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সকলেই বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা স্ট্যান্ডিং কমিটি বা স্থায়ী কমিটির সদস্য। ১০ টা এবং ১১ টার খবরে জানা গেল যে, আরও ৩ জন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বাসায় পুলিশ হানা দিয়েছে। আর একটি চ্যানেলের খবরে জানা গেল যে, পুলিশ ব্যারিষ্টার নাসির উদ্দিন অসীম এবং তার শশুর ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মান্নানের বাসায়ও হানা দিয়েছে। হানা দিয়েছে যুব দলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতি সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বাসাতেও। আর একটি চ্যানেলে জানা গেল পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতেও। যাদের বাসায় পুলিশ হানা দিয়েছে তারা কেউই বাসায় ছিলেন না। তাই তারা গ্রেফতার হননি। অন্যদিকে পুলিশ বিএনপির নয়া পল্টন অফিস এবং চেয়ারপারসনের গুলশান অফিস ঘেরাও করে রেখেছে। পুলিশের মতলব টের পেয়ে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আগেই সরে পড়েছেন। তার একটি জরুরী প্রেস কনফারেন্স ছিল। সেটি তিনি বিএনপি অফিসে না করে প্রেস ক্লাবে করেছেন। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয় পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। পত্র পত্রিকায় পুলিশ বেষ্টনির ছবিও এসেছে। সেখান থেকে রাত ১ টা ১০ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এফ বি সি সি আই এর সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস বেরিয়ে আসছিলেন। তাদেরকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ‘দৈনিক জনকন্ঠের’ খবরে প্রকাশ, সারা রাতব্যাপী পুলিশ ঢাকা এবং সারা বাংলাদেশ জুড়ে গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে। কোথায় কাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটি জানা যায়নি। তবে এই ভাষ্য লেখা যতই এগিয়ে যাবে ততই খবর গুলো টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়াতে পাওয়া যাবে। পাওয়া গেলে আমি এই লেখার মধ্যে সেটি ঢুকিয়ে দেব।
॥দুই॥
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, বিগত শুক্রবার ৭২ ঘন্টার হরতাল আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষিত হওয়ার ৫ ঘন্টা পর থেকেই গ্রেফতার অভিযান  শুরু হয়। তাহলে কি বলতে হবে যে দেশে হরতাল ডাকাও পরোক্ষ ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেল? অথচ হরতাল প্রতিটি দেশেই জনগণের একটি গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার। যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পরিবার এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দ পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছেন যে কেন নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে? তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কি? পুলিশ এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। তারা বলেছে যে, পরে এ সম্পর্কে তারা বিস্তারিত জানাবে। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার ১৮ ঘন্টা পরেও পুলিশ এ সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আলাদা আলাদা ভাবে সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য রেখেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। কারণ আটক ব্যক্তিরা হরতালের মধ্যে বোমা মেরে এবং পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। এর দায় দায়িত্ব বেগম জিয়া এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এড়াতে পারেন না। তাদের বিরুদ্ধে সরকার হত্যা মামলা দায়ের করবে এবং তারপর আইন তার নিজ গতিতে চলবে। পক্ষান্তরে হাসানুল হক ইনু বলেছেন যে, এসব নেতা তাদের বক্তব্য ও বিবৃতির মাধ্যমে হানাহানি এবং সহিংসতা উস্কে দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য এবং বিবৃতির কারণেই দেশে নাশকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য তাদেরকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। মন্ত্রীদের এসব কথা থেকে একটা জিনিস খুবই পরিষ্কার যে, রাজনৈতিক কারণেই এদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ এই সরকারই বিগত পৌনে ৫ বছর ধরে লাগাতার বলে আসছে যে, রাজনৈতিক কারণে একজনকেও আটক করা হয়নি। যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদেরকে ক্রিমানাল অফেন্স বা ফৌজদারী অপরাধের কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ এখন অনেক চালাক হয়েছেন। তারা আর আইয়ুব এবং ইয়াহিয়ার জামানায় বাস করছেন না। তাদেরকে এখন যা খুশি তাই বুঝিয়ে বেকুব বানানোও যাবে না। আর বিভ্রান্তও করা যাবে না।
এসব গ্রেফতারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ যদিও বগুড়ার নির্বাচনী এলাকা থেকে উপ নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন, কিন্তু তার আসল নির্বাচনী এলাকা হলো নোয়াখালী জেলার লক্ষীপুর এলাকা। নোয়াখালীর একাধিক স্থানে ব্যারিষ্টার মওদুদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে গাড়ি ভাঙ্গচুর হয়েছে এবং একাধিক গাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার লক্ষীপুরে হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। জনাব এম কে আনোয়ারের নির্বাচনী এলাকা হলো কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা। এবার বিপুল প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও এম কে আনোয়ার আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার মতো জনপ্রিয় সংসদ সদস্যের এই গ্রেফতারে স্বাভাবিক ভাবেই তাৎক্ষণিক ও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। গাড়ি ভাঙ্গচুর হয়েছে এবং অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তার নির্বাচনী এলাকায় গতকাল শনিবার হরতাল পালিত হয়েছে। এছাড়া এই ৩ নেতার গ্রেফতারের প্রতিবাদে বগুড়ায় ঢাকা বগুড়া মহাসড়ক ২ ঘন্টার জন্য অবরোধ করা হয়। শনিবার দিনে এবং রাতে আর কি কি প্রতিক্রিয়া ঘটে সেগুলি দেখার অপেক্ষায় আমরা বসে রইলাম।
॥তিন॥
আসলে সরকার কি চাচ্ছে? এ ব্যাপারে নেতাদের চেয়ে জনগণ অনেক এগিয়ে আছেন। জনগণের মধ্যে কিন্তু একটি কথা ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেছে যে, এই সরকার অনেক দিন থেকেই এক দলীয় সরকার গঠনের অপচেষ্টা করে যাচ্ছিল। শুরু থেকেই তারা শুরু করেছিল অপশাসন। তারা শাসন নয়, শুরু করেছিল লুটপাট। যতই দিন গেছে ততই এই লুটপাটের মাত্রা বেড়ে চলেছে। জনগণ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। জনগণের মনের ভাষা বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে বাঙময় হয়ে উঠেছে। ফলে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর ওপর নেমে এসেছে অত্যাচার এবং নির্যাতনের খড়গ। জনগণ এগুলো সবই জানেন। তাই সেগুলোর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নাই। কিন্তু দেখা গেছে যে, সরকারের জুলুম ও নির্যাতন যতই বেড়েছে তাদের জনপ্রিয়তায় ততই ধস নেমেছে। জনপ্রিয়তা যতই কমেছে ততই শাসক দলের রাগ বেড়েছে। এই রাগ ঝেড়েছে তারা বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর। জনরোষের প্রতিফলন ঘটেছে হরতাল এবং মহা সমাবেশের মধ্য দিয়ে। যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে যে, হরতালে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বহু স্থানে পিকেটিং ছাড়াই হরতাল হয়েছে। এই ভাষ্যকার হরতালের সময় বিভিন্ন রাস্তাঘাট ঘুরে দেখেছেন যে, পিকেটিং নাই, কিন্তু সবগুলো দোকান পাট বন্ধ। যানবাহন নাই, তবে বিআরটিসি যেহেতু সরকারি সংস্থা তাই বিআরটিসির বাস গুলো রাস্তায় নামানো হয়েছে। অবশ্য রাস্তায় আরেক ধরনের যানবাহন চলাচল করেছে। সেটি হলো আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক বা নেতা কর্মী, যারা বাসের মালিক তারা হরতালের মধ্যে রাস্তায় বাস নামিয়েছে। এই দুই ক্যাটাগরি ছাড়া রাস্তায় আর কোন যানবাহন চলেনি।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দল। তারা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে যে, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি দ্রুত সরে যাচ্ছে। এছাড়া কয়েক দিন আগে ৪ টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এগুলো হলো রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা। এর সবগুলোতে সরকার হেরেছে। গাজীপুর, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও সরকারের ভরাডুবি হয়েছে। ভরাডুবির আশঙ্কায় একটির পর একটি বাহানা করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন ক্রমাগত পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার আগে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয় অবধারিত জেনে, সেই সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। সরকার পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে যে, এখন যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী প্রার্থী গো হারা হারবে।
এসব বিষয় ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছে বলেই আওয়ামী লীগ চাচ্ছে না যে, বিএনপি নির্বাচনে আসুক। এমনকি শেখ হাসিনার অধীনেও যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলেও আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে। তাই কোন সংলাপ বা সমঝোতা তো দূরের কথা, আওয়ামী লীগ একের পর এক উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। তারা অপ্রয়োজনে বিএনপি এবং জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতা কর্মীদেরকে গ্রেফতার করছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিচ্ছে এবং রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করছে।
এসবই হলো আওয়ামী লীগের কূটচাল। তারা চাচ্ছে যে, ত্যাক্ত বিরক্ত হয়েই হোক, বা ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই হোক, বিএনপি যেন বলে যে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। যদি বিএনপি এবং জামায়াত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করে সেটি হবে আওয়ামী লীগের জন্য পোয়া বারো। তারা ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, আওয়ামী লীগ গায়ে পড়ে ঝগড়া করছে কেন? অনেকে এই প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজে পান না। আসল কথা হলো, যে কোন ধরনের নির্বাচন দিলে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াত অংশ গ্রহণ করলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি কেউ রুখতে পারবে না। প্রথমে সরকার টার্গেট করেছিল জামায়াতে ইসলামীকে। অনেক নেতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে, হাজার হাজার নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে এবং দলটির নিবন্ধন বাতিল করে সরকার এই মর্মে তৃপ্তি পাচ্ছে যে, জামায়াতে ইসলামীকে সাইজ করা সম্ভব হয়েছে। এবার বিএনপিকে সাইজ করো। তাহলে ইলেকশনে তাদেরকে ঠেকায় কে? সেই কাজটি ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads