বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৩

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী অনিবার্য


১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক দল ও আপামর জনতা শহীদ ডা. মিলন ও শহীদ নুর হোসেন এর রক্তের বিনিময়ে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছিল তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। “স্বৈরাচার নিপাত যাক ও গণতন্ত্র মুক্তি পাক” বুকে পিঠে লিখে গণতন্ত্রকে বুকে ধারণ করে স্বৈরশাসকের বুলেট বিদ্ধ হয়ে ১০ নবেম্বর ১৯৯০ প্রাণ দেয়া শহীদ নুর হোসেন জাতির জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে সেই গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূলে শেষ পেরেকটি ঠুকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে মোট ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেন এবং ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে আরও ১৯৬ দিন হরতাল পালন করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল। ১৯৯৬ সালে কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার নিনিয়ান স্টিফেন জাতিসংঘের আহ্বানে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল (তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল) ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল (বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল) এর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। তিনিই প্রথম সর্বদলীয় সরকারের তত্ত্ব দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন যা ক্ষমতাসীন দল বর্তমানে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। স্যার নিনিয়ান স্টিফেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার প্রধান রেখে উভয় দল (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) থেকে ৫ জন ৫ জন করে মোট ১০ জন নিয়ে ক্ষুদ্র মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফর্মুলা প্রদান করেন। সেই ফর্মুলা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিচল থাকেন। তাই আলেকজান্ডারের ভাষায় বলতে হয় “সতিই সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ।” আজকে প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে কি অসংকোচে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক দাবি আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন, ভাবতেই অবাক লাগে। পক্ষান্তরে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার বর্তমান আন্দোলনে যিনি বিন্দুমাত্র আপোষ করা সমীচীন হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনিই এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এদেশের আমজনতা তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আর কত ত্যাগ স্বীকার করবে? আর কত হরতাল, সহিংসতা, গণগ্রেফতার ও রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হলে এদেশে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? তা এদেশের সাধারণ মানুষ জানতে চায়। এই প্রশ্নের উত্তর প্রধানমন্ত্রীই সবচেয়ে ভালো দিতে পারবেন কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস এদেশের মানুষের অজানা নয়। বর্তমানে গণতন্ত্রের নামে যে শাসন ব্যবস্থা এদেশের ১৬ কোটি মানুষের উপর চেপে বসেছে তা নামমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগের গণতন্ত্র নামে অভিহিত করা চলে। প্রকারান্তরে, একে শোষিত শ্রেণীর এক দিনের গণতন্ত্র বনাম শাসক শ্রেণীর পাঁচ বছরের শোষণের হাতিয়ার বলা চলে। কিন্তু কিছুতেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলা যায় না। আরও মজার ব্যাপার এই দ্বি-দলীয় গণতন্ত্রের নামে প্রকৃত পক্ষে বর্তমানে এদেশে চলছে এক ব্যক্তির শাসন, যথা- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। মোঘল সম্রাটদের মত শেখ হাসিনা তার নিজ দলের একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা করছেন। তার মুখের উপরে কথা বলার সাহস বা অধিকার ১৬ কোটি মানুষের কারও আছে বলে প্রতীয়মান হয় না এবং এই ব্যাপারটি এই দেশের সংবিধান সুনিশ্চিত করে দিয়েছে। বর্তমান সংবিধান যিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন তাকেই রাশিয়ার জারের চেয়েও ক্ষমতাশালী করেছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর ১২৩ অনুচ্ছেদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিজে ক্ষমতা না ছাড়লে অথবা অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা না হলে তাকে আজীবনের প্রধানমন্ত্রী পদে সমাসীন করার ব্যবস্থা করেছে। যে কারণে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি এনটিভির এক টকশোতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এর সাথে তুলনা পূর্বক বর্তমান কালের “আয়রন লেডী” হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তার এই বক্তব্যের যথার্থতা কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনা উল্লেখ করলেই কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে এক বক্তৃতায় সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনকে দেশ প্রেমিক সার্টিফিকেট প্রদান করেন। কিন্তু এদেশের অধিকাংশ জনগণ মনে করে আবুল হোসেনের দুর্নীতির কারণেই বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্প আলোর মুখ দেখে নাই। একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী যখন প্রচ্ছন্নভাবে একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীকে প্রশ্রয় প্রদান করেন এবং তাও বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করে তখন তাকে অতীব ক্ষমতাশালী ও আয়রন লেডী আখ্যায়িত করাকে যথার্থ বলেই মনে হয়। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস এর মত একজন নোবেল বিজয়ী সম্মানিত ব্যক্তিকে যখন প্রধানমন্ত্রী তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারীকরণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হন এবং তার আজ্ঞাবহ মন্ত্রীরা ডক্টর ইউনূস সম্পর্কে কটূক্তি করেন তখন পরিষ্কার ভাবেই বুঝা যায় এদেশের প্রধানমন্ত্রী কতোটা পরাক্রমশালী। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান বজায় না রেখে নিজ দলের যুদ্ধাপরাধীদের বাদ রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিচারের যে প্রক্রিয়া বর্তমানে চলছে তা শুধুমাত্র এদেশের মানুষকে দুই ভাগে বিভক্তই করেনি বরং শাহাবাগের মত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে হেফাজতে ইসলাম এর মত সংগঠনের উত্থান হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুর্বলতার ফলশ্রুতি এই হেফাজতে ইসলাম। এটা স্বাভাবিক যে এদেশের মানুষের ধর্ম বিশ্বাস আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস ও ইসলাম ধর্মের কোন অবমাননাও মুসলমান হিসাবে সহ্য করবে না। কাজেই দেশকে নাস্তিক ও আস্তিক এই দু’ ভাবে বিভক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অথবা দায়-দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরই বর্তায়। কারণ সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন উনার মন পড়ে আছে শাহ্বাগে। ৫ মে ২০১৩ শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম এর উপরে যে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অভিযান চালানো হয় তা মোটেই সংবিধান সম্মত ছিল না কিংবা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বজায় রেখে পরিচালিত হয়নি। বরং ওই অভিযান বাংলাদেশকে পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের মত একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত অথবা ষড়যন্ত্র বলে এদেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিশ্বাস করে। আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হীন রাজনীতির শিকার হয়ে হানাহানি ও বিভেদের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ফলাফল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মত এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেওয়ার মত ঘটনাও অদূর ভবিষ্যতে ঘটতে পারে। যদি এখনি এই বাস্তবতা, এদেশের সাধারণ মানুষের মনের ভাষা বুঝতে না পারা যায় তাহলে ফলাফল দুর্বিষহ হতে বাধ্য। বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ এদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে এটাই এদেশের মানুষ আশা করে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিভূ ভাবলে চলবে না। গণতন্ত্রের নামে কোন স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া হলেও বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে না। আবার মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করাও যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ তা ১/১১’র সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে। এছাড়াও লিবিয়ার স্বৈরশাসক গাদ্দাফি পরবর্তী বর্তমান লিবিয়া সাক্ষ্য দেয় কোন প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব হঠাৎ করে হারিয়ে গেলে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় তা সমাধান করাও যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। সুতরাং সকল দলের অংশ গ্রহণে নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করে এমন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমেই বর্তমান সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। মৌলবাদী রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার উত্থান কেবলমাত্র একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও সকল দলের অংশ গ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে যদি এদেশের জনগণ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে গ্রহণ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে তাতেও আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থহানির কোন আশংকা নাই। বরং জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত চাপিয়ে দেওয়া কোন নেতৃত্বকে বহাল রাখার চেষ্টা করা হলে তা সঙ্ঘাতের রাজনীতিকে উসকে দিতে পারে। কাজেই গণতন্ত্রের সঠিক চর্চাই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সঠিক সমাধান এবং জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে দেওয়ার সুযোগ দেয়াই সঠিক পথ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দরকার একটি নির্দলীয় সরকার আর এ জন্য যদি সংবিধানে আরও একটি সংশোধনী আনতে হয় তাহলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সংবিধানের জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের জন্যই সংবিধান। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads